কান্না আমায় ক্ষমা করো

পূর্বের যেদিকে ঠাকুরঘরটা ছিল সেখানটাতে এখনো আগুন দেখা যাচ্ছে। সানবাঁধানো বেদীতে যত্নে বেড়ে ওঠা তুলসীগাছের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুয়ারের এদিক সেদিকে। প্রতিদিনের মত আজকের সন্ধ্যাতেও আলোকিত হয়েছিল যেই তুলসীতলা, অর্ধেক ভাঙ্গা কদমা আর জল ঢেলে দেয়া হয়েছিল যার গোড়ায়,তুলসীরুপী নারায়ণকে উদ্দেশ্য করে। আনত সিঁদুর আর জোড়া শাখার যুগল মিলনে স্বামীর কল্যানে ভগবানের কৃপা চাওয়ার তুলসীতলা। মঙ্গলদীপ আর শান্তিকামনার গুণগুণ গানে সরব থাকা সন্ধ্যেবেলার তুলসী তলা। মঙ্গলদীপটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে অদূরে। মাটির কিছু অংশ ভিজে আছে প্রদীপের তেলে।

-খাড়ায় খাড়ায় দেহস কি? কাঠিডা ঘষা দে, শালার মালায়নের বাচ্চার ভোট দেওয়ার শখটা বাইর কইরা দে। শালায় ভাগছে আগেই,খবর পাইয়া,ভারতের দালাল শালায় ভারত যাইব গা। খাড়া খাড়া, দুইডা মিনিট খাড়া, আগেই কাঠি ধরাইস না।

শোকেসের দিকে কিছু একটা চকচক করছিল।দেখতে পেয়ে এগিয়ে যায় সাদেক, আজকের রাতের এই দলের নেতা সে, পার্টিতে ভাল অবস্থানের জন্য আজকের রাতটা একটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছে তার জীবনে।তিনটি কাসার বড় বড় থালা নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে শরিফকে আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দেয় সাদেক। এই সময়ে তার কাঁধের একটা ভাজ করা শাল দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ ছিল না।

-সাদেক ভাই, শালডা আমারে দেন। আমি নেই এইডা।
-হালার কি আর কমু, কাম শেষই হইল না, তার আগেই এইডা দাও, ওইডা দাও! আগুন জ্বালা ব্যাটা, মাল সব পরে ভাগ হবে। ঐ আজীজ, চোদানীর ব্যাটা রুপ দেহস? ক্যারাসিন ঢালস না ক্যান? সাদেক উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

একপাশে ততক্ষণে আগুন দেওয়া হয়ে গেছে। কেরোসিনে ভেজা জিনিসগুলো আগুনের ছলনায় পুড়ে চলেছে। শরীফ ঘরের বাইরে দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। দুটো বস্তায় লুট করা জিনিসগুলো ভরা হয়েছে। এইমাত্র বের করা কাসার থালা দুটো অযত্নে রাখা বস্তার উপরে। সিগারেট জ্বালায় শরীফ। শীতের রাতে আগুনের উষ্ণতা ভাল লাগে তার। আগুনের শিখা আমগাছ ছুই ছুই করছে তখন । কাসার প্লেটে আগুনের প্রতিফলন হচ্ছে। কিছু একটা লেখা দেখা যাচ্ছে খোদাই করা। কাছে যেয়ে দেখে শরীফ পড়ে। “নারয়ায়ণ-মালতির বিয়েতে-বড় জ্যাঠা” তারিখটা ভাল করে খেয়াল করে, ২৭.০৫.১৯৭৩।বুকের ভিতর আরেকবার মোচড় খায় শরীফ। এতদিনের সাজানো সংসার, এতদিনের স্মৃতি, এতদিনের ভালবাসা,মান-অভিমান যত্ন আর প্রেমে গড়ে তোলা সংসার পুড়ে যাচ্ছে তার চোখের সামনে। পুড়িয়ে দেওয়া দলের একজন সদস্য হয়ে এসেছে সে আজকে। সক্রিয় না থাকলেও, এই পশুদের সাথে সে এসেছে। এটাই বা ক্ষমার যোগ্য কেন?

সরে পড়তে হবে তাড়াতাড়ি এখান থেকে। শাল গায়ে তদারকি আর গালিগালাজ করছে সাদেক। মুখে প্রশান্তি,মালাউন মারলে কোন দোষ নাই। শালটা পছন্দ হয়েছে তার। কাল নেতার সাথে দেখা করতে যাবে এই শাল পড়ে।

নভেম্বরের মাঝামাঝি,পাকিস্তানীদের অস্থায়ী ক্যাম্পের ১০ গজের মধ্যে যেয়ে গ্রেণেড চার্জ করে পালিয়ে আসার সময় দলছুট হয়ে পড়ে নারায়ণ। পেছন দিক থেকে ছুটে আসছে মৌমাছির মত গুলির ঝাঁক। মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। গুলি করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে পাকবাহিনী।জীবন বাঁচাতে একটা বাড়ির পিছনের পুকুরে ঝাঁপ দেয় সে। গোলাগুলি থামে প্রায় দুই ঘন্টা পর। এরও প্রায় এক ঘন্টা পর বাড়ির মুরব্বী হারিকেন নিয়ে আসেন পুকুরের কলমীগাছের জংলার দিকটাতে। আস্তে করে বলেন “ভয় নাই,খানেরা চইল্ল্যা গ্যাছে”। মুরব্বীর কন্ঠে বিশ্বাস পেয়ে সামনে আসে নারায়ণ। বাড়িতে নিয়ে যান নারায়নকে। সম্ভ্রান্ত খাঁ পরিবার, বড় বাড়ি। শুকনা লুঙ্গি দেন,গায়ে জড়াবার কাপড় দেন,পরম যত্নে পাশে বসিয়ে খাওয়ান,রাতে থাকার ব্যবস্থা করেন গৃহকর্ত্রী আর কর্তা মিলে। সকালে চলে আসার সময়ে গৃহকর্ত্রী ছলছল চোখে একটা শাল বের করে দেন “বাবা,চাদরটা গায়ে জড়ায় যা, শীতের মধ্যে কই থাকস না থাকস,চাদরটা গায় দিয়া থাকিস ঠান্ডায় কষ্ট করিস না বাবা।” নারায়ণ শালটা হাতে নেয়,কিছু বলে না। মহিলার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে আবেগ থাকতে নেই। নিজের বাবা-মা এর খোঁজ জানে না সে, বেঁচে আছে নাকি তাও জানে না। অথচ এই যুদ্ধক্ষেত্রে একরাতের পরিচয়েই একজন অপরিচিতা তার মায়ের মত দুশ্চিন্তা করছে তার জন্য। বিদায় বেলায় মায়ের মত করেই ‘তুই’ করে ডাকছেন। অজান্তেই চোখের কোনটা ভিজে ওঠে নারায়নের।

সেদিনের সাহসী যোদ্ধাই আজকের নারাণ মাস্টার। সেই শালটাকে এখনো রেখেছেন পরম মমতায়, আর শ্রদ্ধায়। এর সাথে জড়িয়ে থাকা মমতা আর মাতৃস্নেহকে তিনি তার মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে দেখেন। তার সকল ছাত্রকেই তিনি এই শালের গল্প শোনান। কোন একদিন নারায়ন স্যারের ক্লাসে বসে এই গল্প শুনেছিল শরীফও।

সাদেক এর পিছন পিছন ক্ষেতের আইল ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শরীফ। দলের বাকী সবাই যার যার মত বাড়ি চলে গেছে লুট করা জিনিস ভাগাভাগি করে। শরীফ কিছু নেয় নি। সবাই টিটকিরি করেছে, হাসাহাসি করেছে এ নিয়ে। মাঝপথে শরীফ আবার সাদেকের কাছে ফিরে এসেছে। ব্যাগের ভিতরে থাকা লুট করা জিনিসগুলো থেকে শালটা তাকে দিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করছে আবার। জিদ চেপে গেছে সাদেকের, সে দলের নেতা, এই শাল সেই পাবার যোগ্য। শাল না দিয়ে আরও একবার গালিগালাজ করে বাপ-মা তুলে শরীফকে। শরীফ নীরবে এগিয়ে চলে সাদেকের পিছনে পিছনে।

উত্তুরে বাতাস আসছে। সিগারেট জ্বালায় শরীফ। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে রক্তে নিকোটিন সঞ্চার করে। কোমরে গোঁজা ছোট চাপাতিটা বের করে ঠান্ডা মাথায় প্রথম কোপটা দেয় সাদেকের পিঠ বরাবর। এরপর কি যেন হয়। পাগলের মত সাদেকের উপর চাপাতি চালায় শরীফ। বাঁধা দেওয়ার আগেই পাশের ধান ক্ষেতে পড়ে যায় সাদেক। এভাবে আরো কিছুক্ষণ এলোপাথারি চাপাতি চলে জনমানবহীন জায়গাটিতে।

শরীফের হাতে রক্ত লেগে আছে। রক্তমাখা হাতে সে তার স্যারের প্রিয় শালটা ধরতে চায় না। কিন্তু সেটা নিতে হবে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে শরীফ। পাগলের মত কেঁদে চলে। কি করবে বুঝতে পারে না। কেঁদেই চলে। বারবার ক্ষমা চাইতে থাকে। কার কাছে ক্ষমা চাইছে বুঝতে পারে না। একফালী মেঘ ভেসে আসে কোথা থেকে। অর্ধেক চাঁদটাকে আড়াল করে দেয়। উত্তরের বাতাসটা আরো জোরে বইতে থাকে। কান্নার শব্দকে মিলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হিম-শীতল উত্তুরে বাতাস।

উপরে বর্ণিত সকল স্থান,কাল,পাত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।

২,৫৯৫ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “কান্না আমায় ক্ষমা করো”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    কিচ্ছু বলার নেই, শুধু চুপচাপ পড়েই যেতে পারি...


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    পড়লাম তো আগেই, নতুন করে আর কি বলব, সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা না করতে পারলে জাতি যেখানে ছিল, সেখানেই থেকে যাবে।


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    আগুন জ্বলুক। ৮% দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত ভাল লাগছে না। এরপরে ধরবো গীর্জা আর বৌদ্ধ মন্দির গুলো। ১০০% খাঁটি মোসোলমানের দেশ না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাচ্ছি না! নারায়ে তাকবীর.....


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  4. মহিউদ্দিন (২০০২-২০০৮)

    বরাবরের মতোই ভালো লিখা। যদিও ব্লগে আমি এলিয়েন সম, তবুও ক্রিটিক হবার দুঃসাহস দেখাচ্ছি। বানান ভুল দূষণীয়। খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন আপনি বোঝা যাচ্ছে। আপনার তপ্ত প্রেমের গল্পগুলো মিস করছি। :frontroll: :frontroll: :frontroll:


    Prisoner of Own Mind

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সৌরভ(০৬-১২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।