উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি – ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারেরই কুফল

অতি ক্ষুদ্র পরিসরে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেহারাটি সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আজ অনেকেই ভারতের দালাল বা চর, আবার অনেকে একে পাকিস্তানের দোসর বা ভূত ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করেন। যে কেউই যে কারোরই যে কোনো উন্নত চিন্তা, চেতনা, নীতি-আদর্শ বা পদ্ধতি সানন্দচিত্তে গ্রহণ করতে চায় করুক। কিন্ত তার মানে এই নয় যে, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশকে নিজের স্বকীয়তা ও আত্মসম্মানবোধ টুকুকে জলাঞ্জলি দিয়ে সেই অন্য কারোরো দাসত্ব্য বা দালালী করতে হবে।

ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে আমাদেরকে সশস্ত্র সহযোগিতা করেছিলো তারা। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভারতের অযাচিত “দাদাগিরি” মেনেই আমাদেরকে আমাদের সমস্ত পদক্ষেপ বা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে? ভারত সীমান্তে মানুষ হত্যা করে, মুফতে ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করে, তিতাস নদীর উপর বাঁধ দিয়ে তাদের পণ্য ত্রিপুরায় পাঠায়, ফেলানী হত্যার বিচারকে প্রহসনে পরিণত করে, তারপরেও ভারতের কাছে আমরা আমাদের ঋণ নানাভাবেই শুধছি বিগত ৪৩ বছর ধরে ছিটমহল ও অন্যান্য কূটনৈতিক সুবিধা বন্টনের মধ্য দিয়ে। ভারতের ‘সেভেন সিস্টারস’ রাজ্যের সহিংস সমস্যার প্রায় পুরোটাই সমাধান করে দিয়েছে বাংলাদেশ। বন্দী বিনিময় চুক্তি ছাড়াই বাংলাদেশ থেকে দাগী অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে। বিনিময়ে তিস্তার পানি চুক্তি, সীমান্তে হত্যা বন্ধ, ছিটমহল, অমীমাংসিত সীমানা..এসব কোনো কিছুরই কোনো সমাধান করেনি ভারত। বন্ধ করেনি টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প। এমনকি বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান-ভবিষ্যত বিষয়াদিতেও ভারতের উদ্যোগ ও অবস্থান পুরোপুরি বাংলাদেশের ক্রীড়াউন্নয়ন-স্বার্থের বিপক্ষেই।

১৯৭১ সালে চীন ও মার্কিনীরাসহ আরো অনেকেই পাকিস্তানের পক্ষে আমাদের মহান স্বাধীণতা সংগ্রামের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলো। তাই বলে কি আমরা তাদের সবাইকেই বর্জন করেছি বা করবো? লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী অভিবাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে, আয় উপার্জন করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখবার চেষ্টা করে আসছে। আমাদের তৈরী পোশাকের একটা সুবিশাল বাজার রয়েছে সেখানে। লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করছে অ্যামেরিকার একটি আমদানী নীতির ওপর। রানাপ্লাজায় গার্মেন্টস ট্র্যাজেডির কারণে তারা বাংলাদেশের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক বানিজ্য সংশ্লিষ্ট কারিগরী সহযোগিতার (TRTA – Trade Related Technical Assistance) আওতায় “জিএসপি” সুবিধা উঠিয়ে নিয়েছে। আমাদের অধিকাংশ গার্মেন্টস অর্ডারগুলো চলে গেছে ভারত ও অন্যান্য রাষ্ট্রে। সেই সুযোগে শুধু ভারত একাই নাকি মার্কিনীদেরই এত এত অর্ডার সামলাতেই কুল পাচ্ছে না! ভারত ও অ্যামেরিকা- আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের দুই পরাশক্তি। তারা কি নিজেরা তাদের পরস্পরের স্বার্থের ক্ষতি করে একে অপরকে বর্জন করেছে? বাংলাদেশের দশা হয়েছে সেই অসহায় আমের আঁটিটির মতো। আম আঁটি আর দুধের সেই কাহিনীর মতো আম আর দুধ সবসময় এক হয়েই যায়, আর আমরা বেচারা বনের আঁটি বনেই নির্বাসিত হই শুধু ভুল কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত বা সঠিক কূটনৈতিক বোঝাপড়ার অভাবে। ৭১র পাকিস্তান আমাদের শত্রু। ওরা দীর্ঘ ২৪টি বছর ধরে আমাদেরকে শোষণ করেছে, শিক্ষা, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরী-পদোন্নতি সব ক্ষেত্রে ওরা আমাদেরকে দাবিয়ে রেখেছিলো। এই চরম অসমতার (Disparity)বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতেই এবং একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সমস্ত অধিকার ভোগের সহজাত আকাঙ্ক্ষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকারের আন্দোলন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্যভাবেই স্বাধীনতার আন্দোলনে রুপান্তরিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনা দেশের সকল পেশার নারীপুরুষকে ধারণ করে এবং তারা সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী গঠন করে এবং মুক্তিসেনাদের সাথে মিলে একটি সম্মিলিত “মুক্তিফৌজ” গঠিত হয়। ফলশ্রুতিতে রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭১র ১৬ই ডিসেম্বরে।

ভৌগলিকভাবে ১২০০ মাইল দূরবর্তী অবস্থানে থেকে ৭১র পরাজিত শক্তি পাকিস্তান কোনোভাবেই আমাদের জন্য কোনোই হুমকির কারণ নয়। হুমকি তো দুরের কথা, আমাদেরকে রাজনৈতিক বা সংস্কৃতিগত কোনোভাবেই প্রভাবিত কোরবার সে ক্ষমতা বা আকাঙ্ক্ষাও পাকিস্তান ধারণ করতে অপারগ, যেটা ভারত করবার চেষ্টা করছে। ভারতীয় অপ-আকাশ-সংস্কৃতির আগ্রাসন ও অধূনা নির্মিত নিম্নমানের বলিউডি চলচ্চিত্রের ‘গান্ধি গান্ধি বাত’ ও বাতাস এবং ভারতীয় সিরিয়ালের কুৎসিত কাহিনীমালার ভিড়ে ও ভারে আমাদের আবহমানকালের যে রুচিশীল সাংস্কৃতিক ভিত্তি, সেটি কেবল জোড়েসোড়ে অপসৃয়্মাণই নয়, বরং ‘রানাপ্লাজা’র মতই ধ্বংসপ্রাপ্ত। মূদ্রার ঠিক অন্য পিঠে ভারত-পাকিস্তান এই দুই দেশেরই উচ্চমার্গীয় শাস্ত্রসঙ্গীত ও কলা চর্চার যে বিশাল ক্ষেত্র ও মনিমুক্তাসম ভান্ডার রয়েছে, তার খোঁজ বা ঠিকানা অজানাই থেকে যায় আমাদের জন্য, সেসবের ছিটেফোঁটাও আমরা ধারন করতে ব্যর্থ হয়েছি। সাম্প্রতিক কালে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বৈধ-অবৈধ আনাগোনা, কার্যকলাপ ও নিয়ন্ত্রন-স্পৃহা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য-ভারসাম্যকেও একধরনের হুমকির সম্মুখীন করেছে। অন্যদিকে, বিগত দুদশক ধরে পাকিস্তান রাস্ট্রটি নিজেই একটি দূর্নীতিগ্রস্থ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ সামরিক শাসনের অধীনেই পার করেছে অধিকাংশ সময়। নুতন ও পুরাতন প্রজন্মের অনেক পাকিস্তানী নাগরিককেই আক্ষেপের সুরে অসহায়ভাবে বলতে শোনা যায়, সামরিক শাসনের নিষ্পেষণকে তারা নির্বাচিত-দূর্বিত্তায়িত-গণতান্ত্রিক-সরকার-ব্যবস্থার চেয়েও উৎকৃষ্ট বলে মনে করেন! আমাদের শাসকগোষ্ঠীকে বুঝতে হবে, তারা কত ভাগ্যবান যে এখনো এদেশের মানুষ নির্বাচননির্ভর গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে, আস্থা রাখে।

এটাকে তো অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই যে, উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার মুখোশ ও তৎপরতা ভারত ও পাকিস্তান এ দুরাজ্যেই প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিলো এবং এখনো রয়েছে। ধর্মের নামে দাঙ্গা হাঙ্গামার ঐতিহাসিক সংস্কৃতি ভারত ও পাকিস্তানের জন্য তো আজ নতুন কোনো সংযোজিত ‘চ্যাপ্টার’ নয়। বিশ বছরের ব্যবধানে দুটি অভিন্ন ঘটনাকে আমি আজো একই সুতায় বাঁধতে পারি। ৭১এ যুদ্ধকালীন সময়ে আমারই প্রতিবেশী হিন্দু বন্ধু কেশবদাকে যেমন করে কুতুবুদ্দিন নামে পাকসেনাদের হাত থেকে জীবন রক্ষা পেতে হয়েছিলো, ঠিক একই কায়দায় আমার নিজেকেও আই আই টি মাদ্রাজে অধ্যয়ণকালে ১৯৯১এর মে মাসে মাদ্রাজের অদূরে রাজীব গান্ধী হত্যাকান্ডের জের ধরে ভারতময় সংঘঠিত সহিংস দাঙ্গার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট  ভীতির কারণে আমারই হিন্দু বন্ধুদের পরামর্শেই ‘সুব্রত ঘোষ’ নাম ধারন করে প্রাণে বাঁচতে হয়েছিলো মাদ্রাজ-কোলকাতাগামী করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীবহুল একটি কামরায়! ভারত-পাকিস্তানে বিরাজমান ঘৃণ্য ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা আর সংঘর্ষের আঁচ ও প্রভাব বাংলাদেশকেও সময় সময় কলঙ্কিত করেছে সত্যি। তবুও বাংলাদেশের শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য এক শতাংশ মানুষও কি উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার জোসে “সংখ্যালঘু” সম্প্রদায়ের ওপর কোনো ধরনের নির্যাতনকে কোনো সময় সমর্থন দিয়েছে? জনসম্পৃক্ততাহীন, বিচ্ছিন্ন এই আগ্রাসী কর্মকান্ডজনিত যে পাপ তার ভাগীদার ও দায় বাংলাদেশের সাধারণ জনতাকে নিতে হবে কেনো? রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কলঙ্কজনক ইতিহাস তো আমাদের নেই। ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনোত্তর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর ঘৃণ্য কলঙ্কময় নির্যাতনসহ অতীতের বিচ্ছিন্ন যে কয়েকটি সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, সেসবই যতটা না উগ্রধর্মীয় উন্মাদনা দ্বারা তাড়িত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশী এগুলোকে সংগঠিত ও সংঘটিত করা হয়েছে দেশের অসুস্থ রাজনীতির স্বার্থে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিলো এইসব নির্যাতন প্রতিরোধে তাদের ব্যর্থতাও দেশের দলবাজ-রাজনৈতিক অসুস্থতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। বাংলাদেশের রাজনীতিকে এতটা সহজবোধ্য ভাবার কোনোই কারণ নেই। বিগত শত শতাব্দীর ‘নিরব দীর্ঘশ্বাসে’ রচিত ইতিহাস, ‘জীর্ণ ছিন্ন পাতার ধুলোমাখা কালো অক্ষরে জয়-পরাজয় হাসি-কান্নার’ কাহিনীগুলোকে ধরে রাখে যে ইতিহাস- সেই ইতিহাসকে বিকৃত করা সাময়িকভাবে হয়তো যায়, সময়কে নয়। সময়ের সাক্ষ্যদান একদিন ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করবেই। রাতের অন্ধকারে সব নির্যাতকের চেহারাই অভিন্ন। সমগ্র জাতি এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এসেছে বরাবর। আমরা কি আমাদের আত্মাকে দ্বিখন্ডিত বা বহুখন্ডিত করতে পারবো? এখনই সময় এসেছে এক হয়ে লড়বার সকল নির্যাতকের বিরুদ্ধে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এক সাথে, যেমনটা পার্থদা, বুদ্ধিদা, সার্থদা, দোলাদা, বিমানদা, অর্জুনদা, শেখরদা, সীমান্তদা, যাদবদা, মাধবদা, কেশবদা, তাপসদা, উত্তম, মলয়, দিলীপ আর তিলক কে ঘিরে আমার ছেলেবেলা আর এই অপরাহ্নের জীবন আজো কাটে ভালোবাসায় আর সম্প্রীতিতে।

আমাদের সাময়িক ক্ষোভ যেন কেবল উষ্মাতেই আটকে না যায়। আমার আত্মার যে হিন্দু-অংশটুকু সেটাকে কেন আমি “সংখ্যালঘু” সম্প্রদায় নামের একটি “দাঁতহীন”, “নখহীন”, অর্থহীন, কৌশলী, বায়োবীয় আধারে আটকিয়ে নিজেদের আরো দূর্বল ভাববো? ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যাপারে “সংখ্যালঘু” শব্দটির ব্যবহার একধরনের আগাম হেরে যাওয়ারই ইঙ্গিত বহন করে। পরাজিত হতে কেনো ভালবাসবো যখন জয়ের সকল যোগ্যতাই আছে আমাদের? ধর্মকে এই সমীকরণের বাইরে রেখে আসুন গড়ি দেশময় প্রতিরোধ, সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। দেশব্যাপী একটা গণজাগরণকে সঠিকভাবে সংগঠিত করা দরকার নির্দলীয় ব্যানারে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আরেক শ্রেষ্ঠ এই স্বপ্নের যেন আর রাহাজানি না হয় কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের কৌশলের আড়ালে।

বিভক্তি নয়, চাই বিশ্লেষণ, চাই শক্ত প্রতিরোধ। সুমন, মলয়, পলাশ, আবিদ, সবুক্তগীন, লেনিন, কৃষ্ণাদি, মহির চাচা, অনন্যাবৌদি, রোজারিও, সম্ভু কাকা, সাবিনা, বীথি আর মমিনুলকে সাথে একটি অসম্প্রদায়িক শক্ত ঘাঁটি নির্মাণের সময়তো এখনিই! অন্য সকল ধর্মাবলম্বীরা আমাদের থেকে নিজেদের উপড়ে নিলে আমরা যে আরো দূর্বল, আরো অসহায় হয়ে পড়বো!

ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি পর্যালোচনা করে ভালো কিছু দিক যদি খুঁজে পাওয়া যায়, সেটাকে অনুকরণ বা অনুসরণ করবার মধ্যে লজ্জার বা অগৌরবের তো কিছু নেই।  এত এত নৈরাজ্য, রাষ্ট্রীয় দূর্নীতি, দূর্বিত্তায়ণ, নৈতিক মূল্যবোধ আর চরিত্র-মানসের শত স্খলন-বিপর্যয় আর সর্বোপরি ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িকতার নয়া-নগ্ন-উত্থান সত্বেও ভারত রাজ্যের জনসম্পৃক্ত গণতান্ত্রিক চর্চার যে খন্ড খন্ড নমুনা কিংবা পাকিস্তানের জুডিশিয়ারীর দৃঢ়তার যে দৃষ্টান্ত নিকট অতীতে আমরা লক্ষ্য করেছি, তার সাপেক্ষে বা মানদণ্ডে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থার অবস্থান কোথায়? এই প্রশ্ন তো যে কোনো রাজনীতি সচেতন সাধারণ নাগরিকের মনে আসতেই পারে।

আমাদের দেশে গণতন্ত্রের যে বেহাল দশা আজ, তাতে, একটি “আম-আদমী পার্টি”র উত্থান তো দূরের কথা, বরং একজন ‘আম-আদমী’রই সেখানে কোনো ভবিষ্যৎ আছে বলে তো মনে হয় না। পাকিস্তান- আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত, চরম ব্যর্থ, তালেবানী একটি রাষ্ট্র- সেই পাকিস্তানেরও জুডিশিয়ারী যে কতটা শক্তিশালী হতে পারে সেটি নিকট অতীতে দুর্নীতির দায়ে তাদেরই খোদ প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান পিপলস পার্টির ইউসুফ রাজা গিলানীর অপসারণের মধ্য দিয়ে একবারের জন্য হলেও তারা তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলো! আর আমাদের এই দেশে সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গনেই সরকারী পেটোয়াবাহিনী পুলিশ আর আওয়ামী দলীয় ক্যাডাররা মিলে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনেই সুপ্রিমকোর্টের একজন মহিলা আইনজীবীকে মাটিতে ফেলে লাঠিপেটা করে! পত্রিকার পাতায় ছাপা সেই দৃশ্য কারো কারো চোখে “নয়নাভিরাম” ঠেকলেও, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের চোখ ভেসে গেছে জলে। সরকারের হলফনামী মন্ত্রী-মিনিস্টাররা এই আক্রমণ-দূর্বিত্তগিরির কোনো প্রতিকার না করে এগুলোকে একটি দূর্ভাগ্যজনক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে গণমাধ্যমগুলোতে বক্তব্য বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছিলেন। শুধু বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে ঘটনার গুরুত্বকে উপেক্ষা বা এর গরলতাকে তরলীভূত করা হয়তো সম্ভব সাময়িকভাবে, কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সময় কাউকেই ক্ষমা করেনা, সব ঘটনারই নির্মম সাক্ষী হয়ে সময় একদিন ইতিহাস গড়ে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে আচমকা প্রশ্ন করে বসে, “কেন কোনো সরকারই প্রয়াত কিংবদন্তী অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের পাবনার বাড়িটি দখলমুক্ত করতে পারছিলো না এতকাল জামায়াত-শিবিরের কব্জা থেকে? কেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জয়ন্ত রায়ের জমি দখল করে পাবনা শহরেই “সংখ্যালঘু-প্রেমে-অন্ত-প্রাণ” আওয়ামী লীগ নেতারা তাদেরই পার্টি অফিস বানায়? স্বাক্ষরবিহীন হলফনামার ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদকে বনালী লেকের পাশে এবং উত্তরায় যে প্লট বরাদ্ধ দেয়া হয়েছিলো বিএনপি-জামাত সরকারের আমলে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে যখন তাদের বিচার করছে, ফাঁসির আদেশ দিচ্ছে, তখনো কেনো তাদের সেই প্লট বরাদ্ধ বাতিল হয় না?” চিন্তাবিদ আহমদ ছফা যথার্থই বলতেন, বাংলাদেশে “যাহা জনগণের দাবী এবং জনগণের প্রয়োজন তাহাকে পাশ কাটাইয়া একদল কেবল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করিতেছেন। অথচ একটা সুস্থ সমাজ, একটা সন্ত্রাসহীন সমাজ গড়িয়া তোলার প্রতিশ্রুতি, কিংবা জনগণের অধিকার, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের প্রতিশ্রুতি- কোনোটাই কেহ পূরণ করিতে পারেন নাই”। আহমদ ছফার মতে যখন, ক্ষমতাসীন সরকার আর বিরোধীদল সবাই, “সকলে মিলে চরম দক্ষিনপন্থী কোর্টের মধ্যে পলিটিক্সটা ঢুকিয়ে দিয়েছে”, তখন সেই ধরনের কোনো সরকার ব্যবস্থার আওতায় এরকম অসংখ্য প্রশ্নের কোনো সদুত্তর বা প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের ভারতপ্রীতি বা পাকিস্তানের প্রেমে গদগদ হবার কোনোই কারণ বা প্রয়োজনীয়তা নেই। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার বাসনায় এ ধরনের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের সংস্কৃতি ত্যাগ করতে হবে আমাদের ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলোকে। এইসব পাল্টাপাল্টি  অভিযোগ ছেড়ে বরং নিজেদের কোমড় শক্ত কোরবার দিকেই তাদের আসু মনোযোগ দেয়া উচিৎ। দেশের সকল নাগরিকের সাংবিধানিক সকল অধিকার, অন্যায়-নির্যাতন আর অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কোরবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে নিশ্চিত করে দেশের আইন ও বিচার বিভাগসহ প্রজাতন্ত্রের সকল সরকারী, বেসরকারী, সামরিক, বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত, দলবাজিমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ কোরবার সুযোগ সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একদিন অবশ্যই এগিয়ে যাবে উন্নয়নের চরম শিখরে সমস্ত গ্লানি-অপবাদ আর পরাজয়ের কলঙ্ককে পিছনে ফেলে। বাংলাদেশের মানুষ বাঁচে এই আশাতেই।

১,৫১৭ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি – ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারেরই কুফল”

মওন্তব্য করুন : মুশফিকুর

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।