রকিব হাসান থেকে সৈয়দ আবুল মকসুদ


তিন গোয়েন্দা যখন পড়া শুরু করলাম তখন আমি হয়ত ফোরে পড়ি।সারাদিন মাথা গুঁজে রহস্যের সমাধান পড়তাম আর কিশোর পাশাকে হিরো বানিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভাসতাম।তিন গোয়েন্দা পড়ার আগে আমি তেমন একটা গল্পের বই পড়তাম না।ছোটবেলায় আমার সমসাময়িক সবাই যখন সারাদিন কার্টুন দেখে কিংবা কমিক পড়ে ফিক ফিক করে হাসে,আমি সেই সময়ে ব্যস্ত খেলাধুলা নিয়ে।অনেক ছোট থেকেই আমার ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা মারাত্মক।আমি আর আমার চেয়ে ৪ বছরের বড় চাচাতো ভাইটি বাড়ির উঠানকে মাঠ বানিয়ে প্রতিদিন সবাইকে যন্ত্রনা দিতাম।আরেকটু বড় হলে আমরা উঠানের পাশাপাশি বড় মাঠেও খেলা শুরু করলাম।আমার খেলার সাথী ছিল আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুরা,আমি আমার বয়সী বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলা শুরু যখন আমার ভাইয়ের বন্ধুরা ক্রিকেট ছেড়ে ফুচকা খাওয়া কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়ার মাঝেই বেশি মজা খুজে পেল।আসলে আমার বয়সি ছেলেরা তখন বরফ-পানি বিংবা ছোয়াছোয়ি খেলা থেকে অবসর নিয়ে মাত্র ক্রিকেট ময়দানে নাম লিখিয়েছে।অবশ্য তাদের সাথে বেশিদিন খেলার সৌভাগ্য আমার হয়নি।ক্লাস ফোরে থাকতে আমি ঢাকায় চলে আসি আর বিদায় জানিয়ে আসি বাল্যবন্ধুদের।

ঢাকায় আসার পর আমি একটা নূতন জীবনের আঁচ পেলাম।প্রতিদিন সকালে পড়তে বসা,১১ টায় স্কুলে যাওয়া,৫ টায় বাসায় ফেরা,সন্ধ্যায় আবার পড়তে বসা,৯ টায় টিভি দেখেতে দেখেতে দেখতে আম্মুর খাইয়ে দেয়া আর ১১ টার দিকে ঘুমিয়ে যাওয়া-এই হল আমার ঢাকাজীবন। হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমার মা আমাকে কখনো নিচে খেলতে দেননি,তবে সত্য বলতে কি আমারো কখনও ইচ্ছা হয়নি নিচে নেমে খেলতে সেটা বললে ভুল হবে।আমার চেয়ে সামান্য বড় কয়েকটা ছেলে নিচে ক্রিকেট খেলত,তাদের দেখে আমার প্রায়ই মনে হত ওদের বোধহয় পড়াশোনা নেই!

তিন গোয়েন্দার পাশাপাশি আমি আমি একপর্যায়ে হুমায়ুন আহমেদ পড়া শুরু করলাম। আমার বন্ধুদের অনেকেরই তখন কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রতি অনুরাগ জন্মে গেছে। আমি কোনভাবে একটা ‘মাসুদ রানা’ জোগার করে পড়লাম কিন্তু কোন আকর্ষণ বোধ করলাম না।আমার অনেক বন্ধুই তখন মাসুদ রানার ‘চুম্বক’ অংশের প্রবল ভক্ত।হুমায়ুন আহমেদ তখন প্রায় শেষ করে ফেলেছি,নতুন আরেকজন লেখক এলেন বালক মনের উপজীব্য হয়ে।মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাসগুলোই আমার কাছে তখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হত।তার প্রায় সবগুলা সায়েন্স ফিকশানই আমি পড়েছি, কিন্তু কিশোর উপন্যাস পড়ে সেই তিন গোয়েন্দার মত থ্রিল অনুভব করতাম।

একসময় ফিল করলাম প্রেম ভালবাসার গল্প আমার ভীষণ ভাল লাগে,তার মাঝে কিছুটা সাসপেন্স আর উইট যোগ করে দিলে তো কথাই নেই!ফাইভ সিক্সে থাকতে হুমায়ুন আহমেদ পড়ে মজা পেতাম তার সহজ বলার ভাষা আর চটুল কিছু রসিকতার জন্য।কিন্তু সেভেন এইটের দিকে তাঁর বই পড়লে পেটের মাঝে কেমন যেন মোচড় দিত।নায়িকার জন্য মায়া হত কিংবা এমন একজন নায়িকা পেতে ইচ্ছে করত!

হুমায়ুন আহমেদ পড়তে পড়তে একসময় ওপার বাংলার লেখকদের বইয়ে মনোনিবেশ করলাম।আমি কখনো ভক্ত হই অনিমেষের,কখনোবা ভরতের আবার কখনো দীপাবলী।তবে আমার পড়া শ্রেষ্ঠ চরিত্র হচ্ছে মাধবীলতা।এমন করে সুনীল,সমরেশ,শীর্ষেন্দু বহুবার বহুভাবে মনে আঁচড় কেটে যায়।শরৎ,রবীন্দ্র,নিমাই সবাই আস্তে আস্তে আসতে থাকেন আমার তালিকায় আর আমাকে মুগ্ধ করে রেখে যান!

এভাবে উপন্যাসের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে,এমনকি দখল করে নেয় আমার টেস্ট পরীক্ষার আগের দিনটিও।কিন্তু কিভাবে যেন আমি একসময় উপন্যালস থেকে প্রবন্ধের দিকে ঝুঁকে পড়ি।খুব ভাবগম্ভীর প্রবন্ধ ভাললাগে না,তবে রাজনীতি কিংবা ইতিহাস নিয়ে যেকোন রচনা মনযোগ দিয়ে পড়া শুরু করি।টেকি কিংবা কর্পোরেট কোন নিবন্ধ প্রচণ্ড আগ্রহ সহকারে পড়ি।

আমার আসল বিবর্তন আসে যখন থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করি।সামহোয়্যার,সচলায়তন,সিসিবি,টেকটিউনস,প্রজন্ম ফোরাম-পত্রিকা বাদ দিলে আমার বর্তমান পাঠাভ্যাস শুধুই ব্লগ!কিন্তু তবে আমার প্রিয় প্রাবন্ধিক পত্রিকারই একজন-সৈয়দ আবুল মকসুদ যিনি ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় ‘সহজিয়া কড়চা’ নামক কলামের জন্য।

আমার ছোট মামাতো ভাইয়ের জন্য এখন ‘ভূতের গল্প’ পেরিয়ে তিন গোয়েন্দা কিনব ভাবছি।দেখা যাক, আরেকটা পঠনচক্র কোন দিক দিয়ে কোথায় গিয়ে ঠেকে!

মেহেদী
১৪ নভেম্বর,২০১০

১,৫৬৬ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “রকিব হাসান থেকে সৈয়দ আবুল মকসুদ”

  1. রেশাদ (১৯৯৩ -৯৯)

    আহারে !!! কিশোর দিনের রেমি দিপাবলী আর ভুমিসুতারা------,শাহারিয়ার কবির এর বই এর পাতায় পাতায় হারিয়ে যাওয়ার ডাক ----বুকের ভেতর কেমন একটা শুন্যতার মোচড় --

    জবাব দিন
  2. বই পড়া নিয়ে কলেজের একটা কাহিনী মনে পড়ে গেল।
    ক্লাস এইটে থাকার সময়। আমার রুমমেট আসিফ ভাই, রেখা প্রকাশনীর নতুন একটা হরর অনুবাদ এনেছেন। রকিব হাসানের অনুবাদ করা “ড্রাকুলা”। ১নাম্বারে বুকিং পেলাম। ভাইজান পড়া শেষ করে আমাকে দিলেন। তখন দুপুরের প্রেপ-এ যাবো। সাথে করে বইটা নিয়ে গেলাম। মনের আগ্রহটা আর দমন করতে পারছিলাম না। প্রেপেই শুরু করলাম পড়া। অদ্ভুত একটা জগতে ডুকে গেলাম। ড্রাকুলার ভয় আমাকে জাপটে ধরল। মনে হল আমি কাহিনী নায়ক জোনাথন। হয়ত যে কোন মূহুর্তে ড্রকুলার খপ্পরে পরতে পারি। কিন্তু বেশ কিছু দূর পড়ার পরই যেতে হল গেমসে। তারপর টি ব্রেক, নামাজ, প্রেপ। রাতের প্রেপে আবার শুরু করলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। আস্তে আস্তে যেন ভয় বাড়তেই থাকল। প্রেপ শেষে রুমে পৌছে পৌনে ১১টা অবধি পড়লাম। মনে হল ড্রাকুলা এখন আমার চারদিকে ওকে না আটকানো পর্যন্ত আমার চোখ বন্ধ হবে না। ঘুমালেই এসে রক্ত চুষে খাবে। এইদিকে লাইট অফ করে দিতে হবে। এখন উপায় কি? যেইভাবা সেইকাজ, বই নিয়ে চলে গেলাম টয়লেট। দরজা বন্ধ করে পড়া শুরু। রাত কত হল খেয়াল নেই। কউ একজন টয়লেট করতে এসেছিল। পানির কল ছাড়তেই আমি আঁতকে উঠলাম। বই আর বেশি বাকি নেই, সকলের কিংবা ড্রাকুলার কি পরিনতি হয় দেখার অপেক্ষায় টানা পড়ে যেতে থাকলাম। অতঃপর একসময় ড্রাকুলার করুন পরিনতি ঘটল। জোনাথন, চিরতরের জন্য ড্রাকুলার অভিশাপ থেকে সকলকে মুক্ত করলেন। আমার মনে হল, এখন আর কোন ভয় নেই। এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো। রাত ২:৩০ এ ঘুমাতে গেলাম।
    এইরকম আরো কত স্মৃতি ভেসে উঠল মনের ভিতর। ধন্যবাদ আমিনুল। লেখা ভালো লেগেছে।

    জবাব দিন
  3. সুমন্ত (১৯৯৩-১৯৯৯)

    আহা, ছোটবেলায় গল্পের বই পড়ার জন্য কি না করেছি। থাকতাম মফঃস্বলে। ফলে খুব বেশি বই হাতে পেতাম না। কিন্তু যা ছিল, কিছু বাদ রাখি নি। বন্ধু বান্ধবের সংগ্রহ, পাবলিক লাইব্রেরী, এমনকি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরীও শেষ করে ফেলেছিলাম ফাইভে ওঠার আগেই। মাঝে মাঝে দেখা যেত আমার মা আমাকে খুজতে খুজতে অস্থির, পরে পাওয়া যেত পাবলিক লাইব্রেরীতে, বসে বসে জাপানিজ কমিক পড়তেছি, ওইযে যেগুলাতে বাদর টাদররা স্বর্গে বসে বসে পীচ ফল খায়। প্রতি পৃষ্ঠায় এক লাইন আর বিরাট একটা ছবি। তিন গোয়েন্দা শুরু করার পর তো ওদের মত করে ভিজিটিং কার্ড পর্যন্ত বানিয়েছিলাম, আমি আর আমার আরেক বইয়ের পোকা বন্ধু মিলে, এক টাইপিং শেখার জায়গায়, একজনকে অনুরোধ করে। যা পেতাম তাই পড়ে ফেলতাম, দস্যু বনহুর, দস্যু তুফান, অনুবাদ, কমিক, পশ্চিমবংগ, বিজ্ঞান, করে দেখ, ভুত পেত্নি, রামায়ন, মহাভারত, মরনের পরে, নবীদের কাহিনী, সাইমুম সিরিজ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ইংরেজী কিছুই বাদ যায়নি, এখনো বাদ যায় না।

    তবে ইদানিং একটু বেশি বেশি টিভি সিরিজ, সিনেমা এগুলো দেখছি, পড়ছি কম। নিজের উপর নিজেই বিরক্ত।

    জবাব দিন
  4. ভাই রে!আপনি আমার ভাই ,চক্ষে ত পুরা মেঘনা যমুনা নামায় দিলেন ...আপনার বিবর্তনের সাথে আমার বিবর্তন পুরাই মিল্লা গেছে বলা যায়......।ফিকশন থেকে নন ফিকশন,মুভি.........।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিনুল(২০০০-২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।