কান্না, বন্ধুর কথা আর আমি

আমার ক্যাডেটের সবচেয়ে ভাল বন্ধুটা নাকি মন ভাল রাখতে কাঁদতো। কাঁদলে নাকি মন ফ্রেশ হয়ে যায়। ও নাকি সবাই দেখবে বলে টয়লেটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতো। এ কথা শুনে অবাকই হয়েছিলাম। কিন্তু ফেলে দেইনি ওর কথাটা। জীবনে তো আর কম কাঁদি নি আর ভবিষ্যতেও যে কান্না অনেক আসবে এটার কথা ভেবে তার কথাটাকে ভালভাবেই নিয়েছিলাম। কান্নার সাইডপ্রডাক্ট হিসেবে যদি মনের রিফ্রেশমেন্ট আসে খারাপ কি!

আমি ছোটবেলায় স্কুলে গিয়ে কাঁদতাম বাসায় আম্মুকে রেখে আসি বলে। স্কুলটা একটু দূরে ছিল। টিফিনের সময় আম্মুর কথা মনে পড়তো। মনে হতো কত দূরে চলে আসছি। চোখের সামনে শুধু বাসা আর বাসার পিছনটা ভেসে উঠতো। অসাধারণ সুন্দর লাগতো বাসার চারপাশটা। যদিও বাস্তবে ততটা সুন্দর ছিল না। তখন খুব যে ছোট ছিলাম তাও না। আমার বয়স তখন আট-নয় তো হবেই। আসলে ওইভাবে ভাবতে খুব ভাল লাগত। এই ভাল লাগাটাই কি বন্ধুকে টয়লেটে পর্যন্ত গিয়ে কাঁদতে সাহায্য করতো? কি জানি ! হতে পারে।

সেই স্কুলে গিয়ে কান্না করা আমি তারপর গেলাম ক্যাডেটে। মনে আছে আমি প্রথম দিন একটুও কাঁদিনি। অনেক নতুন মানুষ দেখে আমি খুশিতেই ছিলাম। মাত্র সাতদিন পর ছুটি ভেবে আরও মজায় ছিলাম। কিন্তু এই মজা আর থাকে নি পরের টার্মে এসে। নভিসেস ড্রিলের রোদে ঝঁলসানো কষ্ট, ক্লাশ এইটের এক্সট্রা শাসন আর বাসার প্রতি অমোঘ টান সব একসাথে হয়ে আমাকে কাঁদতে বাধ্য করল প্রথম প্যারেন্টস ডে তে।

মনে আছে ঐদিন আমার প্যারেন্টস অনেক দেরিতে আসে। আমরা ক্লাশ সেভেনের পোলাপাইন ফুল ড্রেসড আপ হয়ে যার যার রুমে অপেক্ষা করছিলাম কখন হাউস বেয়ারার অমেদ ভাই নাম ধরে ডাক দিবে। এক এক করে সবার নাম ধরেই ডাকল। তারা চলেও গেল যার যার প্যারেন্টসের কাছে। আমার প্যারেন্টস আর আসে না। অবশেষে যখন আসলো, অ্যাকাডেমি ব্লকে তখন আর বসার জায়গা নেই। চলে গেলাম তিন তলার লাইব্রেরীর সামনের লম্বা করিডোরটাতে। আর ওখানেই ঠিক সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান পাশে যে রেলিং টা আছে ওটা ধরে আমি ক্যাডেট জীবনের প্রথম কেঁদেছিলাম। সেই কান্নার মধ্যেও কি কোন ধরনের ভাল লাগা ছিল? হয়তোবা।

এরপরেও অনেক কেঁদেছি কারনে-অকারনে। মনে মনে কেঁদেছিলাম যখন প্রথম জাপানে আসি। মনে পড়ে ঐদিন বাসায় হাটার জায়গা ছিল না। আত্নীয়-স্বজন আর পাড়ার লোকেরা এসেছিল আমাকে বিদায় দিতে। তাদের ধারনা ছিল আমি অনেক দিন দেশে ফিরব না। সবার চোখে পানি। কিন্তু আমি কাঁদিনি। ওরা আরো বেশি ভেঙ্গে পড়বে বলে ইচ্ছে করেই কাঁদিনি ঐদিন। ছোটবোনটার দিকে তাকাতে পারিনি ভালভাবে। কারন ওইখানে আমি নিজেকে চেক দিতে পারছিলাম না। সবার সাথে কথা বলছিলাম অনেকটা হাসিমুখেই। সেই হাসির পিছনে যে কষ্টের নদী বয়ে গেছে তা তারা দেখে নি। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করেছিল ঐদিন। মনটাকে ফ্রেশ করতেই কি ঐদিন আমার কান্নার দরকার ছিল? তাহলে বন্ধু আমার খারাপ বলে নি।

বাসা থেকে আজ আমি অনেক দূরে। বাসা থেকে ক্যাডেটের ১২ কিলোমিটারের দূরত্বটা দখল করে নিয়েছে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটারের বিশাল দূরত্ব। কান্নাও সয়ে গেছে আজ অনেক দিন। তারপরেও সেদিন হঠাত দুচোখ ছলছল করে উঠল। ফোনে কথা বলছিলাম ছোট বোনটার সাথে। তার পড়াশুনার কথার ফাঁকে খুব উৎসুক ভাবেই আম্মুর একটা কথা বলল সে। আম্মু নাকি প্রতিদিন নামাজ শেষে দোয়া করে জাপানের দিকে মুখ করে তিনটা করে ফুঁ দেয় খুব জোরে জোরে। চোখদুইটা ছলছল করে উঠে। মনে হচ্ছিল খুব করে কাঁদি আমার আম্মুর জন্যে। ওই কান্নার মধ্যে কি এক অমোঘ ভাল লাগা ছাড়া অন্য কিছু ছিল? মনে হয় না।

সত্যি বন্ধু তুমি খারাপ বলনি!

৪৬ টি মন্তব্য : “কান্না, বন্ধুর কথা আর আমি”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    আম্মু নাকি প্রতিদিন নামাজ শেষে দোয়া করে জাপানের দিকে মুখ করে তিনটা করে ফুঁ দেয় খুব জোরে জোরে।

    :boss: :boss: :boss:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ছন্নছাড়াকে থিতু হতে দেখে ভাল লাগল... :-B

    আম্মু নাকি প্রতিদিন নামাজ শেষে দোয়া করে জাপানের দিকে মুখ করে তিনটা করে ফুঁ দেয় খুব জোরে জোরে।

    বাপ-মা এত ভস কেন???? :salute:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. অনুরক্ত (৮৩-৮৯)
    আম্মু নাকি প্রতিদিন নামাজ শেষে দোয়া করে জাপানের দিকে মুখ করে তিনটা করে ফুঁ দেয় খুব জোরে জোরে।

    আমাদের দেশের মা'দের এক চিরন্তন রূপ। সব মা'কে শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    শরীফ তোমার লেখার মাঝে একটা সহজ-সরল ভঙ্গি আছে। এইটা অনেক কষ্টে আয়ত্তে আনতে হয় আমার মত লোকদের। আমার ধারনা তুমি লেগে থাকলে অনেক ভাল লিখতে পারবে।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  5. হুমম
    শরিফ.।।...।
    লেখাটা ভাল হয়েছে
    তুই মনে হয় বেশ কিছুদিন ধরেই লিখছিস।
    আমার মত অপোগন্ড কে invite করলি কেন?
    তোর লেখা পড়ে আমার ও লিখতে ইচছা করছে।
    তবে এখন নয়, পরে
    ভাল থাকিস

    জবাব দিন
  6. সামিয়া (৯৯-০৫)

    ছোটবেলায় এত কেন্দে ফেলসি যে এখন কান্না আর আসে না। ক্লাস সেভেন এইটে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কানতাম, টুয়েল্ভে উঠে এমন হলো যে কোন কিছুতেই চোখ দিয়ে পানি বেরোয় না। মনটা তাই ভয়ঙ্কর রকমের কর্দমাক্ত।
    যেকোন জায়গায় অনুভূতি প্রকাশটা আমার ক্ষেত্রে উলটা হয়ে যায়। এর জন্য প্রচুর বিপদে পরেছি এবং এখনো পরে যাচ্ছি। একটা উদাহরণ দেই, আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় এবং ভালবাসার মানুষ আমার নানা। আমি যখন নানার মৃত্যুর কথা শুনি, একটুখানি হেসে দিয়েছিলাম।
    এই ব্যাপারটাকে আসলে ঠিক কিভাবে ডিসক্রাইব করা যায়? আমি জানিনা।
    আম্মু যখন খুব সিরিয়াসলি বকা দিতে থাকে আমি ফ্যাক করে হেসে ফেলি। এটাও কেন হয় আমি জানিনা। এমন না অনুভূতিটা হচ্ছেনা, বরঞ্চ খুব হচ্ছে, কিন্তু কান্নার বদলে হাসি বেরিয়ে যায়। এরকম অদ্ভুত সমস্যা আর কারও হয় কি? এটাও আমি জানিনা আসলে।

    জবাব দিন
  7. সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

    এই লেখাটা অসাধারন হয়েছে সাগর। এইজন্যই মায়ের ভালোবাসার কাছে আমরা এত্তো বেশী ঋনী থাকি।
    অনেক দিন কিছু লেখ না। পড়াশুনাও তো তেমন করতে দেখি না, সারাক্ষন এফবি তেই পরে থাকো। লেখা দাও।


    You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।