যাচ্ছে জীবন – ৪

গত দশ পনের বছরে ঢাকা অনেক বদলিয়ে গিয়েছে। চারদিকে এত্তো এত্তো সব হাইরাইজ বিল্ডিং। কোন এক কালে সিদ্ধেশ্বরীতে আমাদের বাসার ছাদে উঠলে জাতীয় স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটের আলো দেখা যেতো। সম্ভবতঃ ৯৪ এর সাফ গেমসের সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে যে অসাধারণ আতশবাজীর প্রদশর্ণী হয়েছিল তা আমাদের বাসার ছাদ থেকেই দেখেছিলাম।

আমাদের বাসার সামনে বেশ বড় জায়গা আছে। আশেপাশের সব বাসা থেকে আমাদের ওই জায়গাতেই খেলতে আসত। ছেলে মেয়ে দল বেধে খেলা হতো, টিলো স্প্রেস, গোল্লাছুট, কুমির তোর জলে নেমেছি, সাতচাড়া। ক্রিকেট, ফুটবল আরো পরে খেলা শুরু করেছিলাম, যখন দেখলাম আমরা বড় হয়ে গেছি একটু। মেয়েরাও আমাদের সাথে তখন আর খেলত না। তারা তখন পাড়ার এক মাথা থেকে গল্প করে বেড়াত, আর হা হা হি হি করত। তখন আমাদের চোখে বসন্তের রং লাগতে শুরু করেছে তাদের ইম্প্রেসড করার জন্য আমরা তাদের দেখায়ে ক্রিকেটের কোন শট খেলি, অথবা একাই ম্যারাডোনা হয়ে গোল দিতে ছুটি। আর যদি কোন ভাবে একটা বল যেয়ে তাদের গায়ে লাগত তো সেই দিন কুরুক্ষেত্র হয়ে যেতো, ঝগড়ার চোটে।

তখন আমাদের পাড়ার কাছে একটা পুকুর ছিল। পুকুরের পাশে বেশ কয়েকটা আম গাছ ছিল, সেই আম গাছের কাচা আম বেশ মিষ্টি ছিল। আমাদের অত্যাচারে সেই আম আর পাঁকার সু্যোগ পেত না। এর পাশেই একটু জংলা জায়গায় একটা বড়ই গাছ ছিল। কেউ কোন এক কালে সেই গাছে একটা বোতল বেধে রেখেছিল। কে যেন বলেছিল ওই গাছে কোন এক পীর বোতলের মধ্যে একটা জ্বীন কে বন্দী করে রেখেছিল। কোন ভর দুপুর বেলায় যদি কেউ ওই গাছের কাছে যায় তো তার কোন দুর্ঘটনা ঘটতে বাধ্য। আমাদের বিশ্বাস আরো পোক্ত হয়েছিল যখন আমাদের দুই জন ভর দুপুরে আম পাড়তে গিয়েছিল। তারা যখন আম গাছে উঠেছে তখন নাকি দেখে পাশে একটা কাটা হাত তাদের কাছে আম চাইছে। এ দেখে ভয়ে পালাতে যেয়ে একজনের হাত কাটছিল, আর অন্যজন নাকি পালাতে যেয়ে সাপের তাড়া খেয়ে পুকুরে পড়েছিল। সেই থেকে আমাদের ওই আম গাছগুলো থেকে আম পাড়তে যাওয়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন মনে হয় ওই দুই জন হয়তো যাদের আম গাছ তাদের তাড়াই খেয়েছিল কিন্তু আমাদের বলে নাই। তবে পুকুরে ঢোরা সাপ ছিল, ঢাকা শহরের পোলাপান আমরা তাকেই বিষাক্ত কোন সাপ ভাবতাম।

আমি ক্যাডেট কলেজে যাবার পর, ছুটিতে এসে দেখতাম আমাদের পাড়াতেও বদল আসছে। আমার পুরানো বন্ধুরা সব বাসা বদলায়ে অন্য কোথাও চলে গেছে বা যাবে। আমিও মনে হয় ক্লাস এইটের পর থেকে ছুটিতে আসলে মির্জাপুরের পোলাপানের সাথে বেইলী রোডে আড্ডা মারা শুরু করলাম। পাড়ায় শুধু মাঝে মাঝে একজনের আকর্ষণে এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেটে বেড়াতাম। সে কখনো জানালায় এসে দাড়াত, কখনো একটু হেসে কথা বলত। তাঁর সাথে বাচ্চা কালে কত খেলে বেড়ালাম, ঝগড়া করে বেড়ালাম আর তারপর যে কি হলো তাঁর সাথে যেয়ে কথা আর বলতে পারতাম না। মাঝে মাঝে গল্পের বই আনার অজুহাতে যেতাম, কতো বার ভাবলাম যে বইয়ের পাতার মাঝে চিঠি দিব কিন্তু তাও দেওয়া হলো না। অসাধারণ কবিতা আবৃত্তি করত সে। আমি যখন ক্লাস টেনে তখন একদিন কলেজে মার চিঠি থেকে জানতে পারলাম ওরা নাকি আমেরিকা চলে গেছে। কেন জানি বুকটা খুব খালি খালি লেগেছিল সেদিন।

যা বলছিলাম ঢাকা শহর বদলিয়ে যাচ্ছে। সেই পুকুরটার কবেই কবর হয়ে গেছে, আম গাছগুলো ও কাটা পরেছে। জানি না বড়ই গাছটা কাটার সময় যে কেটেছিল সে কোন দুর্ঘটনায় পড়েছিল কিনা। কিন্তু এখন ওইখানে অনেকগুলো বিল্ডিং আছে,আমাদের টিলোস্প্রেস খেলতে যেয়ে লুকানোর জায়গা গুলো নিজেরাই লুকিয়ে গেছে কোথাও। শেষবার যখন ঢাকা গেলাম আমাদের বাসার ছাদ থেকে আর কিছুই দেখা যায় না। চারপাশের উচু উচু দালান আমাদের বাসার উপরের চৌকো আকাশটুকু ছাড়া আর সব টুকু আকাশ দখল করে নিয়েছে।

অবশ্য ব্যাপার না, আমাদের ওইখানেও এখন বিল্ডিং উঠবে। আমরাও পাড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি, দশ তলা বাড়ি গুলো উঠলে আকাশটা হয়তো আরেকটু বড় দেখাবে। কিন্তু স্টেডিয়ামের সেই ফ্লাডলাইট আর দেখা যাবে না।

হারানো মানুষ কে মাঝে মাঝে যখন খুঁজে পাওয়া যায় তখন মনে হয়, দুনিয়া আসলেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। ওই যে যার কথা বলেছিলাম আমেরিকায় চলে গিয়েছিল, ফেসবুকে বহুত খোজাখুজি করেও তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেইদিন গুগলিং করতে করতে ইউটিউবে তার কবিতা আবৃত্তির ক্লিপিং পেলাম। এখনো সেই রকমই আছে, এখনো বুক হু হু করা কবিতা আবৃত্তি করে। শুধু মাঝে অনেকগুলো বছর চলে গেল, ঢাকা শহরটাও অনেক বদলে গেল।

ব্লগ লেখা শেষ করে গান দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু কোন গান দিব মাথায় আসছিল না। যাইহোক ‘ আজ রাতে কোন রুপকথা নেই’

১,৩৭৩ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “যাচ্ছে জীবন – ৪”

  1. রকিব (০১-০৭)

    নস্টালজিয়া 🙁
    স্মৃতির শহর ঢাকা। সিদ্দেশ্বরী এলাকার কাছেই বাসা ছিল; ঘোরাঘুরি হতো ওদিকেই। একটু বড় হলে বেইলী রোডেও আড্ডা মারা হতো; মামার সুবাদে মাঝেমধ্যে মঞ্চনাটক দেখতে যেতাম নাটকপাড়ায়।

    এখনো সেই রকমই আছে, এখনো বুক হু হু করা কবিতা আবৃত্তি করে। শুধু মাঝে অনেকগুলো বছর চলে গেল, ঢাকা শহরটাও অনেক বদলে গেল।

    আমারো এট্টু হু হু করতেছে 🙁


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • সামি হক (৯০-৯৬)

      মিয়া তুমি সিদ্ধেশ্বরীতে আসতা তো ট্যাক্স তো কখনো দাও নাই। আচ্ছা পরে কখনো দেখা হলে দিয়ে দিও। বেইলী রোড এ আগে মানুষ নাটক দেখতে যেতো, তারপর সুইস হওয়ার পর চোখের সামনে বেইলী রোড জমে গেল। কতো আড্ডা আমাদের ওইখানে।

      আর বুক হুহু করলে কি আর করবা গুগলিং কর, নিরাময় হয়ে যেতে পারে 😀

      জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    পুরাই নস্টালমুজিব লেখা 🙁 দারুন লাগল, খেরোখাতা চালু থাকুক :thumbup:

    হারানো মানুষকে খুঁজে পেতে আপনার অধ্যাবসায় যুগে যুগে অনুসরনীয় হয়ে থাকবে 😛


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. Siddheswarite mone hoi amader r 10 din thaka hobe. 30 yrs of our life going away in next 4 months. likhata khubi bhalo hoise, jehetu i grew up along with u, i am familiar with all the myths and characters in this piece. So many of us grew up together r ekhon je jer moto chorie achi..mone hoitese ami amar ekta portion kete baad die chole jachchi..may be there is still be good thing happening here. age ekhane 20 ta poriber thakto ekhon ekhane 72 ta flat e 72 ta family asbe bu ami pretty sure era sei sada botoler bhut ta ke dekhte parbena..tilo sprace khelbe garage e r cricket tv tei dekhbe..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।