ঈদগুলো

২০০২ সালে দেশ ছেড়ে আসার পরে আর ঈদ দেশে করা হলো না। এই সাত বছরে কতবার দেশে গেলাম, কিন্তু ঈদের সময় দেশে যাওয়াটা হয়ে উঠল না। দেশে থাকা বাবা, মা, ভাই বন্ধুদের কে প্রচন্ডভাবে মনে পড়ে সব সময়ই, ঈদের দিনে আরো বেশী করে মনে পড়ে আর মন খারাপ হয়।

ছোটবেলায় ঈদের দিন বাবার সাথে হাত ধরে নামাজ পড়তে যেতাম। আমার চাচারা আমাদের পাড়ার মধ্যেই থাকত, সবাই মিলে একসাথে নামাজ পড়তে যাওয়া একটা নিয়মেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমরা ছোটরা আগে আগে রেডি হয়ে সবাই কে খালি তাঁড়া দিতাম যেন আগে যেয়ে নামাজ ধরতে পারি। তখন একটা ধারণা কাজ করতো নিজের মধ্যে যে আগে আগে নামাজ পড়ে বাসায় ফিরলেই ঈদের দিনটা তাড়াতাড়ি শুরু হয়ে যাবে। আমাদের মসজিদে অনান্য অনেক মসজিদ থেকে পরে ঈদের জামাত হতো, এই নিয়ে আমার বাবার কাছে আমার অনেক অভিযোগ ছিল কেন তাঁদের মসজিদ কমিটি আগে আগে ঈদের জামাতের সময় দেয় না। যাইহোক ঈদের দিন নামাজ পড়তে যেতাম সবাই মিলে। নামাজ শেষে প্রথমেই বাবার সাথে কোলাকোলি, এরপর সব চাচাদের সাথে। আমার বাবাকে যেহেতু এলাকার সবাই চিনে, তাঁর সবার সাথে কথা বলা লাগতো, আর আমি অধৈর্য্য হয়ে যেতাম কখন বাসায় ফিরে মা কে সালাম করব (আর সালাম মানেই সালামী)। শেষে একা একাই রওনা দিতাম বাসার দিকে। অন্য সময়ে যদিও আমার আমাদের পাড়া থেকে বের হওয়া বারণ ছিল কিন্তু এই দিন বাবা কিংবা মা কিছু বলতো না। বাসায় ফিরেই টুপ করে মা কে সালাম করে ফেলতাম। মা জড়িয়ে ধরতো, মার গায়ে নতুন শাড়ির গন্ধ, চুল ভেজা। তারপর অপেক্ষা কখন আমার বাবা আসবে আমরা নাস্তা করতে বসব। বাবা আসার সাথে সাথেই মা বলতো ওকে সালামী দাও(আমি বাবাকে সালাম করার আগেই)। দশ আর দশ বিশ টাকা মানে আমার কাছে অনেক টাকা (বছর ঘুরে বাড়তে বাড়তে শেষ যে বছর ঢাকায় ঈদ করি তখন ঈদের সালামী হয়েছিল ২৫০ আর ২৫০ মোট ৫০০ টাকা)। একদিনের জন্য বড় হয়ে যাওয়া আমি পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে কোক কিনে খেতাম, অথবা বন্ধুদের সাথে ইগলু আইসক্রীম। কিন্তু অনেক বয়স হওয়ার পরও ওইটুকু পর্যন্তই আমার দৌড় ছিল।

আসলে ক্যাডেট কলেজে যাবার পরেই অনেক স্বাধীনতা পাওয়া শুরু হলো। আমার বাচ্চা কালের দোস্ত গেলো এম সিসি তে ওর সূত্র ধরে আরো কয়েকজন এমসিসি র পোলাপানের সাথে পরিচয় হলো। এরপর থেকে ছুটিতে আমরা এ একই স্যারের কাছে কোচিং করতাম। কলেজে থাকার সময়ে ঈদের দিনগুলো ছিল এদেরকে ঘিরেই। আগে থেকে প্ল্যান থাকতো কোথায় কোথায় যাবো, পাঞ্জাবী কিনা, অথবা স্যান্ডেলের শপিং। আমরা ছুটিতে আসলেই আড্ডা মারতাম বেইলী রোডের কলোনীতে। যদিও আমাদের মধ্যে একজন খালি ওই কলোনী থাকতো কিন্তু সবাই জানতো আমরা সবগুলা ক্যাডেট তাই আমাদের বেশ দাম টাম দিতো, আর কলোনীর বাইরের হলেও আমাদের কলোনীর পোলাপান কিছু বলতো না। তো এক ঈদে লাগলো গেঞ্জাম। আমাদের একজন পছন্দ করলো ওই কলোনীর এক মেয়ে কে। ঈদের আগে তাকে গিফট করলো বই আর কার্ড, সেই মেয়েও ওকে গিফট করলো একটা রোমান্টিক গানের ক্যাসেট। আমাদের মধ্যে এ নিয়ে কি উত্তেজনা। কিন্তু ঠিক তখনই এক ভিলেইনের আগমন ঘটলো। কলোনীর এক বড় ভাই আবার ওই মেয়েকে পছন্দ করতো, সে কার কাছ থেকে এইসব জানতে পেরে মাস্তান ঠিক করলো আমাদের কে পিটানোর জন্য। সেই যাত্রা মারামারির হাত থেকে বাঁচছিলাম যখন দেখা গেলো যাদের কে সে ঠিক করেছে তারা আমার এলাকার আর আমাকে খুব ভালো করে চিনে। সেই মাস্তান ভাই কলোনীর বড় ভাইরে উল্টা ঝারি। এরপরে আস্তে আস্তে আমাদের ওইখানে আড্ডা দেওয়া কমে আসে। এখন যে বেইলী রোড এতো জমজমাট থাকে ঈদের সময়, এই বেইলী রোড আমাদের সামনেই জমজমাট হয়ে উঠেছিল। আমরা বেইলী রোডে আড্ডা মারতাম কত বিকাল, আমাদের মধ্যে যারা প্রেম করত তারা আমাদের দাড় করায়ে টুক করে সুইসে ঢুকে ডেট করে আসতো। আর ঈদের দিন ছিল অন্যরকম বেইলী রোড, মেয়েরা নতুন নতুন জামা পড়ে সাজগোজ করে আসতো আর আমরা দেখতাম আর রেটিং করতাম।প্রতি ঈদে বেইলী রোডে আড্ডা দেওয়া একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল, ইউনির্ভাসিটির সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে মনে হয় আমাদের এই রেওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন ভীড়ে দাঁড়ানো যেতো না ওখানে, আর পোলাপান তখন সব স্যাটেলাইট যুগের ঠেলায় হঠাৎ করে দেখি বড় বেশী ফাস্ট হয়ে গেছে। অবশ্য ইউনির্ভাসিটিতে পড়ার সময় আমার ঘনিষ্ট বন্ধুগুলাও বেশ ব্যাস্ত থাকতো ঈদের দিন, তাদের ডেটে যাওয়া লাগতো। আর আমরা যারা ছিলাম একলা তারা আড্ডা মারতে যেতাম অন্য কোন একলার বাসায়, ওইখানে খাওয়া দাওয়া, হইচই ছবি দেখা শেষে রাতের দিকে বাসায় ফিরতাম। ঈদের পরের দিন সবাই সব কাজ ফেলে আমরা ফাকা রাখতাম, ওইদিন ঢাকার বাইরে কোথাও যেতাম আমরা।

তারপর একদিন এম এস সি করতে গেলাম ইংল্যান্ডে। আমি যেই ইউনির্ভাসিটি পড়তে গেলাম সেখানে অনেক বাংগালী পড়ত। কিন্তু আমি মানুষের হিসাবে মিশুক না যারফলে অনেককে চিনলেও কারো সাথে সেইভাবে খাতির হলো না। আমার প্রথম ঈদে গেলাম একা একা নামাজ পড়তে। নামাজ শেষ করে পাশ ফিরে দেখি, আমার পাশে আমার বাবা নাই, বাবার সাথে কোলাকোলি করা হলো না। চোখ কেমন করে জানি ঝাপসা হয়ে আসলো, বাসায় ফেরার পথে সারাটা পথ চোখ মুছতে মুছতে ফিরেছিলাম। সেই শুরু হল, তারপর এই সাত বছরে আর ঈদের দিনে বাবার সাথে নামাজে যাওয়া হলো না। প্রতিটা ঈদে ইচ্ছা করে এর পরের বার যাবোই ঈদে, যাওয়া আর হয়ে উঠে না। হয়তো সামনের বছরের রোজার ঈদ…

বিঃদ্রঃ আমার মতো যারা এবার দেশ থেকে অনেক দূরে ঈদ করছে এই গানটা তাদের জন্য নকীব খান- বৃষ্টির রাত , আর সবার জন্য ঈদ স্পেশাল আরেকটা গান দিলাম তপু- বৃষ্টি । কেন জানি আনন্দের কোন গান খুঁজে পেলাম না।

১,৭০৩ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “ঈদগুলো”

  1. রকিব (০১-০৭)

    ভাইয়া, কাকতালীয় হলেও সত্যি, আপনার পোষ্টটা পড়বার আগেই আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিছি, এসে দেখি আপনিও বেইলী রোডের কথা বলছেন :shy: । দেশের ঈদের গন্ধটাই অন্যরকম, আর এখানে কেমন শুকনো, দায়সারা। :((


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    ঈদ মোবারক সামি ভাই। 🙂
    ছোটবেলায় যত সেলামী পাইতাম সব যাইত পটকার পিছনে। সারাদিন বন্ধুদের সাথে পটকা ফাটাইতাম। খিদা লাগলে কোন এক বাসায় ঢুকে খাওয়া দাওয়া। :dreamy:

    প্রতিটা ঈদে ইচ্ছা করে এর পরের বার যাবোই ঈদে, যাওয়া আর হয়ে উঠে না। হয়তো সামনের বছরের রোজার ঈদ…

    ব্যাপার না বস। আপনার নাম্বারও আসবে B-)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রকিব (০১-০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।