পি কে পাল স্যার এবং আমার ধরা খাওয়ার কাহিনী

তখন আমি ক্লাস টুয়েলভে। তারিক হাউসের এক নম্বর রুম আমার ঠিকানা (হাউসের একদম প্রথম রুমটাই আমাদের আর কি)।কাধে ছয় দাগই উঠেছে এর বাইরে কিছু যোগ হয়নি, যাইহোক আসল গল্পে আসা যাক। আগেরদিন ছুটি থেকে কলেজে ফিরেছি তো ওইদিন আমাদের প্রেপ ছিল না। আমার মন খুব খুশি কারণ এইবার ছুটিতে যেয়ে একটা মহা কাজ করে ফেলেছি। আমি আর মিরজাপুরের কয়েকজন আমরা ঢাকায় বেইলী রোডের অফিসারস কলোনীতে আড্ডা দিতাম। তো সেই আড্ডা দিতে দিতে এক পারবতী কে দেখে বড়ই মনে ধরেছিল, টুকটাক কথাও হতো ছুটিতে। তো এইবার ছুটি থেকে ফিরার সময় পারবতীর ছবি নিয়ে আসছিলাম সাথে করে। আমি মহা ভাব নিয়ে পোলাপান সবাইরে দেখাইসি তারপর তা ইসহাক নুরুন্নবীর রসায়ন বইয়ের ফাকে লুকিয়ে রেখেছি। কিছুক্ষুন পর পর কারণ ছাড়া ছবি দেখি। লাইটস অফের ঠিক আগে আগে হাউস মাস্টার পি কে পাল স্যার আমাদের রুমে আসল। এসেই কোন কথা বারতা ছাড়াই শুরু করল রুম চেক। আমার বেড ছিল দুই নম্বরে আর সুন্দর করে টেবিলের উপরে রসায়নের বইটা রাখা ছিল, স্যার কি মনে করে সোজা বই খুলে চেক করা শুরু করল। লেহেংগা পরিহিত পারবতীর ছবি যথারীতি তার হস্তগত হলো, স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন ছবির এই বালিকা কে? আমি বল্লাম ‘আমার কাজিন’। স্যার বল্লেন ভালো কথা এইবার প্যারেন্টস ডে তে তোমার বাবা কে জিজ্ঞাসা করব তোমার কাজিনের কথা,আমি দেখলাম অবস্থা বেগতিক, স্যার এর সাথে আমার বাবার বেশ ভালো সম্পরক ছিল,প্যারেন্টস ডে তে আমার বাবা স্যারের সাথে দেখা করবেই সবসময় আর তখন যদি স্যার বলে ছবির কথা আমি পুরা শেষ। তো স্যারকে বললাম যে ‘স্যার বলেন না আমার আব্বাকে, মেয়েটা আমার কাজিন না’। স্যার শুধু ছবিটা সিজ করলেন আর বল্লেন ‘ছবিটা আমার কাছে থাক, পড়ার বইয়ের মাঝে ছবি থাকলে পড়াশুনা হবে না, যেদিন কলেজ থেকে যাবা তার আগে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিও ছবিটা’। এই বলে স্যার আর কাউকে চেক না করে বের হয়ে গেলেন। আমার এক রুমমেট দোতালায় যেয়ে অন্য পোলাপানদের খবর দিল ছবি ধরা খাবার কাহিনী, পোলাপান পুরা রাগে শেষ। লাইটস অফের হুইসেল পড়ল, স্যার হাউসের লাইটস অফ করিয়ে তার সাইকেল নিয়ে বের হলেন। যেই একটু দূর গেছেন অমনি পোলাপান সব দোতালা থেকে স্যার এর টিজনেম ‘পাকু পাকু’ বলে চিল্লানো শুরু করল। যারা জানে না তাদের জন্য স্যার এর সাইকেল চালানো দেখার মতো ব্যাপার ছিল এতো আস্তে কেউ সাইকেল চালাতে শুধু স্যারই পারতেন, যাইহোক সেইদিন সেই চিতকার শুনে স্যার নাকি তার দ্রুততম গতিতে সাইকেল চালিয়ে ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু ততোক্ষণে ঘটনার নায়কেরা হাওয়া(আমি ছিলাম না ওই দলে আমার মন খারাপ ছিল ছবি হারানোর দুখে)। এসে স্যার বেশ কিছুক্ষণ চিল্লাচিল্লি করলেন তারপর চলে গেলেন।

এর দুই তিন দিন পরে হাউসের টি ভি রুমে স্যার এর সাথে কোন এক ছোট ঘটনা নিয়ে আমার প্রচন্ড কথা কাটা কাটি হয়। স্যার খুব দুংখ করে আমাদের হাউস প্রিফেক্ট কে বলেছিলেন ‘ আনিস, সারোয়ার আমার সাথে এমন করল কেন? ও কি ছবিটার জন্য এমন করল, ও তো এমন করার মতো ছেলে না’। পরে আনিসের কাছে এই কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লেগেছিল, ভেবেছিলাম স্যার এর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো, কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি।

একদিন আমাদের যাবার বেলা এসে গেলো তারও আগে এক ছুটিতে পারবতীর সাথে সবকিছুর ইতি হয়ে গেছে, আসার আগে স্যার এর কাছে ছবিটা চাইওনি। স্যার কলেজ থেকে বের হবার দিন বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এরপর যখন গিয়েছিলাম কলেজে তখন শুনেছিলাম স্যার বদলী হয়ে গেছেন। এরপর একদিন পড়লাম পেপারে স্যার আর নেই, প্রচন্ড কষ্ট লেগেছিল সেইদিন, বারবার শুধু মনে পড়ছিল সেইদিনের কথা। এতোদিন পরে সেই ছবি, ছবির মানুষ সব ফিকে হয়ে গেছে মাথা থেকে, কিন্তু পি কে পাল স্যার সবসময় তারার মতো জলজল করে আছেন আমার স্মৃতিতে।

২,০২৯ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “পি কে পাল স্যার এবং আমার ধরা খাওয়ার কাহিনী”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    পি কে পাল স্যারের কথা খুব মনে পড়ে। ক্লাস এইটে আমাদের বোটানি নিতেন। স্যার কে অবশ্য বেশি দিন পাইনি, স্যার বদলি হয়ে যান।

    বড় ভাইদের সংগে অনেক মজার মজার ঘটনা ছিল স্যারকে নিয়ে।

    স্যার আপনি ভাল থাকুন।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. তৌহিদ (৯৫-০১)

    ভাইজান সালাম নিয়েন,
    মনের ভিতরের এককোনায় জমে থাকা দুঃখে নারা দিলেন । আসলে আমরাও স্যার কে অনেক সময় টিজ করা, ব্যাংঙ্গ করা সবই করেছি । তবে আপাত বিরক্তিকর, বেশি নী্তিবান মানুষের ভিতরটা চিনতে একটু সময় লেগেছিল । এখনও আমরা সবাই যে অল্প কিছু স্যার ম্যাডাম এর কথা প্রায় ই বলি তার মধ্যে পি কে পাল স্যার একজন । স্যারের এইরকম বিদায় আমাদের সবার হৃদয়েই এক নিঃশব্দ বেদনা হয়ে আছে ।

    জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    পি কে পাল স্যারকে :salute:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  4. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    আমরা পি কে পাল স্যারকে ভিপি হিসেবে পেয়েছিলাম। এক পিকনিকে ওনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, "আপনার নাম প্রসন্ন কুমার পাল কিন্তু আপনি প্রসন্ন থাকেন না কেন অর্থাৎ হাসেন না কেন?" উত্তরে স্যার বলেছিলেন যে ১৯৭১ এ ওনার পরিবারের সকলকেই(অথবা পাঁচ ভাইকে) ওনার চোখের সামনে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনি। উনি তখন পালটা প্রশ্ন করেন যে এই ঘটনার পর উনি কিভাবে প্রসন্ন থাকবেন? এই ঘটনা শোনার পর হতে আমি ওনাকে আর কোনদিন ওনাকে টিজ করিনি, কেনো যেন ইচ্ছে করে নি টিজ করতে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সায়েদ উল হাসমত (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।