সুনীলের মৃত্যু এবং আমার ক্যাডেট-অহংবোধ

আমি ক্যাডেট ও না-ক্যাডেট মানুষের মধ্যে পার্থক্য/ ভাগাভাগি নিয়ে সাধারণত কথা বলি না। টপিকটা আমার কাছে কিছূটা বৈষম্যমূলক মনে হয়। ফলে কিছুটা অপছন্দের এবং কিছুটা দম্ভ/ অহংকার প্রকাশ গোছের ঠেকে।যাই হোক, আজ সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের প্রয়ান দিনে ক’টা কথা বলতে মন চাইছে।

 

ঘটনাটা ২০০৮-এর… ভার্সিটিতে কোর্স এ্যাডভাইজিং চলছে। লোকজন খুব ব্যস্ত কি কোর্স নেবে, কোন স্যারের সাথে নিবে এই আলোচনায়। আমি পড়াশোনা নিয়ে কখনোই খুব চিন্তিত না। এককোণে বসে সুনীলের ‘সেই সময়’ খুলে বসেছি। পড়তে পড়তে অপেক্ষা করছি আমার এ্যাডভাইজিং-র সময়ের।

 

মানুষ বৈচিত্রে সহজে আকৃষ্ট হয়। ছুটোছুটি লোকজনের মাঝখানে একজন চুপচাপ বই পড়ছে। স্বভাবতই, সেখানে পরিচিতরা একে একে আসছেন আর বই ও লেখকের নাম এবং কোর্সের ব্যাপারে টুকটাক জিজ্ঞেস করছেন। তাদের অধিকাংশের কথায় বোঝা যাচ্ছে এই বই তারা পড়েননি। অনেকে হয়ত নামও শুনেননি। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই দোষের না। (আজ সকালে অফিসে এসে সুনীলের প্রয়াণ নিয়ে কথা বলছিলাম। দুজন সহকর্মী বলেই বসলেন সুনীলটা কে? প্রথমে ভাবলাম মজা করছেন। পরে বুঝলাম, তারা আসলেই তাদের গোটা জীবনে এই অসাধারণ কবির নামটি পর্যন্ত খেয়াল করে দেখেননি। ব্যাপারটায় আমি কোন দোষ দেখিনা। শুধু একটা ফ্যাক্ট দেখি, একদল শিক্ষিত বাঙালি রয়েছেন যাদের মন-রাডারে সুনীল ধরা পড়েননি। উল্লেখ্য, যার সঙ্গে আলোচনা করছিলাম তিনি ক্যাডেট নন।)

 

যাই হোক, ডিরেইল্ড হয়ে যাচ্ছি। তো সেদিন তিনজন এক্স-ক্যাডেট আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনজনই আমার বন্ধু। একই ব্যাচের। আমাকে ‘সেই সময়’ পড়তে দেখে তাদের মন্তব্য। “এতোদিন পর?”, “সেই কবে পড়ছি”, “ধুর ব্যাডা বুড়া বয়সে এইসব পড়তেছোস” … একটু দেরীতেই পড়েছি বটে!!!

 

গতরাতে আমাদের সময়ের ‘প্রথম আলো’ মারা গেছেন। খবরটা ভোরে এক না-ক্যাডেট লেখক বন্ধুর পাঠানো এসএমএস-এ পাই। এরপর ফেসবুক খুলে যখন হোমপেজের দিকে তাকাই তখন দেখি শুধু দুই শ্রেণীর মানুষ এ ব্যাপারে বদার্ড। একদল হলো আমার লেখক-সাংবাদিক বন্ধু। অন্যদল ক্যাডেটস।

 

আমার অফিসে আসার পথে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল পড়ে। তাঁর সীমানা-দেয়ালে ঢাউস ঢাউস ফন্টে অনেক বাণী লেখা। তার একটি হলো, যার ঘরে একটি লাইব্রেরী আছে, মানসিক ঐশ্বর্যের দিক থেকে সে অনেক ধনী। কথকের নাম ভুলে গেছি। তবে কথাটা সত্যি হয়ে থাকলে, অধিকাংশ ক্যাডেটই মানসিক ঐশ্বর্যে বিল গেটস না হলেও টাটা বা আম্বানির সমতুল্য। কারণ , তারা ঘরে না, মনে এক একটা লাইব্রেরী নিয়ে ঘুরেন। যারা ক্যাডেট নন, তাদের সঙ্গে এই দিক থেকে বোধহয় ক্যাডেটদের একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। পাঠক হিসেবে ক্যাডেটরা অনেক এগিয়ে (শতাংশের অংক কষলে)। এই ঐশ্বর্যবান গোত্রের আমি একজন, এই অহংবোধতো একজন মানুষের থাকতেই পারে। আর কারো কথা জানি না, আমার আছে।

 

জয়তু ক্যাডেট-বৃত্ত।

 

প্রিয় লেখক সুনীলের প্রতি রইল ভালোবাসা।

 

এবিসি রেডিও-র অফিসে তোলা ছবি। ছবিতে না থাকলেও ছবির আশেপাশে আমি ছিলাম। এই একবার-ই তাকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়েছিল। কথা বলার সাহস হয়নি। মনে হয়েছিল, কি বলব! শুনেছি, মস্ত পবর্তের মুখোমুখি হলে নাকি মানুষ ভাষা হারিয়ে ফেলে।

 

২,০৭৯ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “সুনীলের মৃত্যু এবং আমার ক্যাডেট-অহংবোধ”

  1. দিবস (২০০২-২০০৮)
    অধিকাংশ ক্যাডেটই মানসিক ঐশ্বর্যে বিল গেটস না হলেও টাটা বা আম্বানির সমতুল্য। কারণ , তারা ঘরে না, মনে এক একটা লাইব্রেরী নিয়ে ঘুরেন

    সকালে খবরটা পাওয়ার পর থেকেই মনটা খুব খারাপ ছিল।লেখা চমৎকার হইছে।


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  2. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)
    অধিকাংশ ক্যাডেটই মানসিক ঐশ্বর্যে বিল গেটস না হলেও টাটা বা আম্বানির সমতুল্য। কারণ , তারা ঘরে না, মনে এক একটা লাইব্রেরী নিয়ে ঘুরেন।

    :boss:


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন
  3. তন্ময় (২০০৬-২০১২)
    পাঠক হিসেবে ক্যাডেটরা অনেক এগিয়ে (শতাংশের অংক কষলে)। এই ঐশ্বর্যবান গোত্রের আমি একজন, এই অহংবোধতো একজন মানুষের থাকতেই পারে। আর কারো কথা জানি না, আমার আছে।

    ::salute::


    চলো বহুদুর.........

    জবাব দিন
  4. সামিয়া (৯৯-০৫)

    তোমার স্যাম্পল গ্যাদারিং টা বোধহয় ঠিক না। এটা ঠিক যে ক্যাডেট কলেজের একটা বড় অংশ বই পড়ে বড় হয়, তবে এটাও ঠিক যে বাইরেও মোটামুটি একই রেশিও বিদ্যমান। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর চাপে পড়ে কত ছেলেমেয়ে যে বই পড়া শিখেছে তার ইয়ত্তা নেই। মানসিক ঐশ্বর্য পরিস্ফুটনের ব্যাপারে আমার মতে পরিবেশ আর পরিবার খুব বড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই দুটোই আমরা পেয়েছি কলেজ থেকে, এটা একটা বাড়তি সুবিধা। এই সুবিধা পেয়েও কলেজেরই অনেককে দেখবা জীবনে সত্যজিৎ ছুঁয়েও দেখেনি, দস্তয়ভস্কির নাম শোনেনি। এটা একেকজনের পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট। তাই সুনীলের নাম না শোনা পাবলিক কলেজের বাইরে যেমন পাবা, ভিতরেও তেমন পাবা।

    বাইরে কত মানুষ, এর মধ্যে দুজনকে পেয়েছ যারা নাম শোনেনি, আর কতজনকে পেয়েছ যারা শুনেছে? এই জন্যই বলছিলাম, স্যাম্পলিং এ একটু ভুল আছে।

    লেখা চমৎকার।

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    একই কথা মানুষ কত ভাবেই না দ্যাখে

    অধিকাংশ ক্যাডেটই মানসিক ঐশ্বর্যে বিল গেটস না হলেও টাটা বা আম্বানির সমতুল্য।

    লাইনটি ভালো লাগলো অনেকেরই; আর আমার কিনা ভালো লাগলো না।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  6. মান্নান (১৯৯৩-১৯৯৯)

    তোমার কথাটা আমার বেলায়ও সত্য। আমার অধিকাংশ কলিগই সুনীল সম্পর্কে ভাসাভাসা জ্ঞান রাখে। অথচ সুনীল যখন মারা যায় ( সেদিন রাত ১:৩০ এও ) আমি সুনীলের পায়ের তলায় সর্ষে-১ বইটা পড়ছিলাম।

    জবাব দিন
  7. সামিউল(২০০৪-১০)

    হোমপেজের দিকে তাকাই তখন দেখি শুধু দুই শ্রেণীর মানুষ এ ব্যাপারে বদার্ড। একদল হলো আমার লেখক-সাংবাদিক বন্ধু। অন্যদল ক্যাডেটস।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।