আমরা কোন যুগের মানব সভ্যতা?

একটা লেখা পড়লাম আজ। লেখাটা অনেক বেশি টাচি। তাই ভাবলাম সিসিবি’র সবার সাথে লেখাটা শেয়ার করি-

১.
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমাকে একট গল্প শুনিয়েছেন। গল্প নয়, সত্য ঘটনা। চীনের এক দম্পতি কম্পিউটারে এক নতুন খেলা পেয়েছেন। একটা বাচ্চাকে লালন-পালন করতে হয়। তাঁরা সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকেন। এই বাচ্চাকে খাওয়ান, পরান, গোসল করান। এই বাচ্চার প্রতি তাঁদের যত্নের সীমা নেই। তাঁরা একেবারেই মগ্ন হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁদের নিজেদের একটা বাচ্চা ছিল। খেলায় মগ্ন এই দম্পতি নিজেদের বাচ্চার কথা ভুলে গেলেন। একদিন দেখা গেল, বাচ্চাটা মরে পড়ে রয়েছে।

২.
জ্যাক দেরিদা রুশোর স্বীকারোক্তিমূলক আত্মজীবনী কনফেশনস থেকে উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতীক বা বিকল্প কখনো কখনো নিজেই প্রধান হয়ে ওঠে। রুশো কৈশোরে যে বাড়িতে থাকতেন, সেই গৃহকর্ত্রীকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। সেই ম্যাডাম যে বিছানায় শুতেন, রুশো সেই বিছানাকে চুমু দিতেন, আদর করতেন তাঁর চেয়ারকে, মেঝেকে, পর্দাকে। কারণ, ওসব ছিল তাঁর ম্যাডামের বিকল্প। সামনে ম্যাডাম নেই, কিন্তু এসব বস্তুর মাধ্যমে রুশো তাঁর ম্যাডামের অভাব পূরণ করছেন। কিন্তু একদিন ম্যাডাম তাঁর সামনে, খাচ্ছেন। রুশো বললেন, খাবারে একটা চুল। ম্যাডাম খাবারটা মুখ থেকে বের করতেই রুশো সেই খাবার নিজের মুখে পুরলেন।
এখানে তো ম্যাডাম সামনে আছে, তাহলে কেন রুশো ম্যাডামের মুখের খাবার মুখে পুরলেন।
ম্যাডাম, যাঁকে রুশো বলতেন ম্যামান, তিনি ছিলেন রুশোর মায়ের বিকল্প। তারপর মায়ের চেয়ে ম্যাডামই মুখ্য হয়ে উঠলেন। তারপর ম্যাডামের চেয়ে বিভিন্ন বিকল্পই মুখ্য হয়ে উঠল।
দেরিদা দেখিয়েছেন, এভাবে বিকল্পই প্রধান হয়ে ওঠে।
দেরিদার বক্তব্য হলো, লেখা মুখের কথার বিকল্প নয়, পরিপূরক নয়, লেখাই আসল। টেক্সটই আসল। আমরা কি সেই যুগে প্রবেশ করলাম, যেখানে বাস্তবের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে ভারচুয়াল বাস্তবতা, যেখানে রক্ত-মাংসের বন্ধুর চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে স্ক্রিনে দেখা (ও পড়া) ছায়াবন্ধুটি?
সুমনা শারমীন লিখেছিলেন, মা পাশের ঘরে অসুস্থ পড়ে আছেন দিন সাতেক ধরে, ছেলে একবারও তাঁকে দেখতে যায়নি, কিন্তু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, প্রে ফর মাই মাদার, শি ইজ সিক। মাদার, গেট ওয়েল সুন।

৩.
প্রযুক্তি, যোগাযোগের বিকল্প মাধ্যমগুলো আমাদের কাছে জ্যান্ত মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে কি না?
আমার সামনে আমার বন্ধু বসে আছেন, মা বসে আছেন, বাবা বসে আছেন, ডাক্তার বসে আছেন, এই সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল। আমরা সেটা আগে ধরাটাকেই কর্তব্য বলে মনে করি।
আমার জলজ্যান্ত বন্ধু সামনে বসে আছে, কিন্তু তাকে রেখে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই, আমি এখন বন্ধুর সঙ্গে কফি খাচ্ছি।
পাঁচজন স্কুলবন্ধু, তাঁদের দেখা হলো আজ ২২ বছর পরে, তাঁরা আজ একটা জায়গায় একত্র হচ্ছেন, কী ভীষণ উত্তেজনা তাঁদের মধ্যে। দেখা হওয়ার পরে পাঁচজনই পাঁচটা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, কেউ ফেসবুক করছেন, কেউ বা গেমস খেলছেন, কেউ বা খুদেবার্তা পাঠাচ্ছেন, কেউ বা জরুরি ই-মেইল সেরে নিচ্ছেন, কেউ বা চ্যাট করছেন দূরবর্তী কারও সঙ্গে।
সামনে সমুদ্র, একটু পরে অস্ত যাবে সূর্য, সেদিকে খেয়াল নেই। আমি স্ট্যাটাস দিচ্ছি, আহ্, লাইফ ইজ বিউটিফুল, আই অ্যাম ইন আ প্যারাডাইস।
প্রেমিক দেখা করতে গেছে প্রেমিকার সঙ্গে, কোনো নির্জন জায়গায়। দুজনের হাতে দুটো মোবাইল ফোন, দুজনেই নিজ নিজ ফোন নিয়ে ব্যস্ত, সারাক্ষণ বুড়ো আঙুল চলছে।
আমি মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে একজন পথিককে এসএমএস করতে দেখেছি।
আমি বিয়ের আসরে বসা বরকে এবং বউকে দেখেছি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।

৪.
একটা কৌতুক ছিল। একজন সম্ভাব্য পাত্র ঘটককে বলল, আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চাই, যে কিনা আমাকে আমার ইচ্ছামতো বিনোদন দেবে, আমি চাইলে সে কথা বলা বন্ধ করবে, চাইলেই গান গাইবে, বা নাচবে, বা কথা বলবে, আবার আমি যখন চাইব তখনই সে ঘুমিয়ে পড়বে, আমি চাইলেই সে অন হবে, আমি চাইলেই সে অফ হবে।
ঘটক বললেন, ভাই, আপনি একটা টেলিভিশনকে বিয়ে করুন।
এই কৌতুককে আধুনিকায়ন করে বলা যায়, ভাই, আপনি একটা ইন্টারনেটকে বিয়ে করুন।
কিন্তু তা বলা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, আমি চাইলে ইন্টারনেট অফ হবে বটে, কিন্তু আমার চাইবার শক্তি যে থাকবে না। রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে মনে হবে, যাই না, একটু ফেসবুকটা চেক করি, দেখি না স্ট্যাটাসে কয়টা লাইক পড়ল।

৫.
এই কৌতুক আগেও শুনেছেন। আবার শুনতে পারেন, এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কৌতুক।
গৃহপরিচারিকা কয়েক দিন বিনা নোটিশে অনুপস্থিত থাকল। তারপর কাজে ফিরে এলে গৃহকর্ত্রী তাকে বললেন, তুমি কয়েক দিন কাজে আসোনি, ব্যাপার কী?
‘দেশে গেছিলাম, আপা।’
‘দেশে গেছ। বলে যাবা না?’
‘ক্যান? আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিছিলাম, তিন দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি, আপনে দেখেন নাই?’
‘ওমা! তোমার আবার ফেসবুকও আছে নাকি?’
‘কেন? আপনি জানেন না? আপনার বর তো আমার স্ট্যাটাসে কমেন্ট দিছে: মিস ইউ।’

৬.
তলস্তয়ের থ্রি কোশ্চেনস গল্পে পড়েছিলাম—
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কী?’
‘এখন। এই মুহূর্ত।’
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী?’
‘এখন যা করছি।’
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কে?’
‘যিনি এখন আমার সামনে বসে আছেন।’
প্রিয় পাঠক, আমাদের মনে হয় তলস্তয়ের এই গল্পটা আরেকবার গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। এই সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, এখন যা করছি, এই কাজটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, আর এখন যিনি আমার সামনে আছেন তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আপনার সামনে রক্ত-মাংসের যে মানুষটি আছেন, তাঁর কথাই নিশ্চয়ই তলস্তয় বলেছেন, দূরবর্তী শত শত ছায়াবন্ধুর কথা নিশ্চয়ই তিনি বোঝাতে চাননি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

বিঃ দ্রঃ লেখাটা কপি-পেস্ট করা। শুধুমাত্র লেখাটার গুরুত্ব প্রকাশের জন্যই লেখাটা দিলাম।

১,৭৩৫ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “আমরা কোন যুগের মানব সভ্যতা?”

  1. মোঃ সাদাত কামাল [০১-০৭]

    লেখাটা পড়ে অনেক ভালো লাগলো।
    বাস্তোবতাটা অনেক কঠিন যুগ যুগ ধরেই, আর তারপর এখন আবার যান্ত্রিকতাও চলে আসছে তার মাঝে।
    আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষকে সময় দেয়া, যতোটা পারা যায় বন্ধুদের সাথে সামনাসামনি চোখেচোখ রেখে কথা বলা।
    যন্ত্রকে চেনে যন্ত্র। আর যন্ত্রের ব্যবহার করে যন্ত্র(রোবট)।


    ভালো থাকা অনেক সহজ।

    জবাব দিন
      • নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

        জুলফিকার,
        তুমি ওই পত্রিকার সংগে যুক্ত আছো বলে প্রকাশ পাবার আগেই লেখাটি তোমার দেখার সুযোগ হয়েছে।কিন্তু তা তোমাকে সেই লেখা আগেভাগে প্রকাশ করবার বৈধতা দেয়না। দৈনিকটিতে আসার আগে (বা পরেও) লেখাটি অন্য কোন মাধ্যমে প্রকাশ পাবার জন্য মূল লেখকের অনুমতি নেবার প্রয়োজন। সেটি কি নেয়া হয়েছিলো এক্ষেত্রে?

        সিসিবির নীতিমালা কিন্তু কপিপেস্ট লেখার বিরুদ্ধে।
        মূল লেখকের নামোল্লেখ করা হলেও (এমন কি লেখকের অনুমতি থাকলেও) কোন কপি-পেস্ট লেখা (সম্পূর্ণ বা আংশিক) সিসিবিতে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে।

        জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    পুরো লেখাটা একটানে পড়ে গেলাম। আর প্রতি লাইনের শেষে মনে মনে জুলফিকারকে প্রসংশা করেছি। কিন্তু শেষে এসে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো 'কপি পেষ্ট' দেখে!

    জুলফিকার, লেখার শুরুতেই 'কপি পেষ্ট' বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বলে দিলে ভালো হতো। সব থেকে ভালো হতো, কপি পেষ্ট না করলে।

    আমি সিসিবি'তে কপি পেষ্ট জাতীয় পোষ্টের বিপক্ষে।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
      • মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

        জুলফিকার,

        লেখাটার গুরুত্ব নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই, আমি বেশ পছন্দও করেছি। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, লেখাটা আনিসুল হকের যা' তুমি নিজেই লেখার শেষে জুড়ে দিয়েছো। কিন্তু ব্লগটা এসেছে তোমার নামে।

        আমি তো চাইলেই কপি-পেস্ট বিষয়টি উহ্য করতে পারতাম।

        - সেটা কেমন হতো তা' বিবেচনার ভার তোমাকেই দিলাম।

        আমার কথা হলো, নিজের ব্লগে নিজের লেখা থাকাই ভালো। আর অন্য কারো লেখা ভালো লাগলে সেটার উপর আলোচনা/পর্যালোচনা/সমালোচনা করেও তা' অন্যদের সাথে শেয়ার করা যায়।

        যাই হোক, এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মত।


        There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

        জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    কাল জাফর ইকবালের একটা লেখা পড়লাম। দিই সেটা এখানে কপি পেষ্ট করে!
    প্রয়োজনে মাসখানেক কোন নতুন লেখা না আসুক কিন্তু বন্ধ হোক এই অসুস্থ প্রবণতা।
    লেখা ভালো তাতে কি! কপি পেষ্ট!
    ১ তারা।
    গত কয়েক দিনে ২ টা কপি পেষ্ট পড়লাম। দুঃখজনক।
    :teacup:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।