৬ বছর বা ২২০৩ দিন – ১৪তম পর্ব

প্রথমে গুড়িগুড়ি, পরে ঝিরিঝিরি, তারও কিছুক্ষণ পর মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। বেশি দূরের নয়, গতকাল রাতের কথা বলছি। এই বৃষ্টি ছিল ক্যাডেটদের বহু আকাংখিত বিষয়ের অন্যতম একটি। কিন্ত আমরা সবাই জানি অতিবৃষ্টির কারণে বন্যাও হয়ে থাকে আমাদের দেশে বা ক্যাডেট কলেজগুলোতে। না না ভুল বলছি না আমাদের কলেজে ২০০২ সালে বেশ একটা বন্যা হয়েছিল ঘাঘট নদী উপচে পড়ে। সেই বন্যার স্মৃতিতেই আমার আজকের এই পর্ব।

জুন মাসের ১৫ তারিখ,২০০২ সাল রাত। আমাদেরকে বিশ্বকাপ ফুটবলের জার্মানি আর প্যারাগুয়ে এবং ইংল্যান্ড আর ডেনমার্কের খেলা দেখতে দেয়া হল না প্রেপের কারণে। তো হঠাৎ করেই নাইট প্রেপের দিকে বজ্রপাত হতে লাগল, দেখতে দেখতে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পিটিতে যেতে হবে ভেবে বেড থেকে উঠে দেখি তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। মনটা ভরে গেল, আজ পিটি করতে হবে না। কিন্তু এ্যাডজুট্যান্টের কল্যাণে আমাদেরকে একাডেমী ব্লকে পিটির নামে ডজ মারার সুযোগ করে দেয়া হল। আজকেও সারাটা দিন-রাত বৃষ্টি হল।

পরদিনও সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। কিন্তু সেদিকে কারও খেয়াল নেই। সবার মাথায় বিশ্বকাপ নিয়ে চিন্তা কারণ আজকে ব্রাজিলের খেলা এবং খেলাটা দেখতে হবেই। তাইতো বড় ভাইয়েরা সকাল থেকেই অনুমতি নেয়ার কাজে লেগে পড়লেন। পুরো ক্লাস টাইম, রেস্ট টাইম, গেমস টাইম, প্রেপ টাইম(অবশ্য ঐদিন আমরা খেলা দেখেছি) ধরে বৃষ্টি হল। ফুটবল গ্রাউন্ড, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড আর কলেজের রাস্তা ডুবে গেছে। কিন্তু বিশ্বকাপের নেশায় সবাই তা খেয়ালই করল না ঠিক মত।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না, কলেজের যেদিকে তাকাই সেদিকেই পানি। আমাদের কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঘাঘট নদী অতিবৃষ্টির কারণে উপচে পড়ে বন্যার সৃষ্টি করেছে যার আওতায় আমাদের কলেজও পড়ে গেছে। একহাটু পানি হয়ে গেছে। একাডেমী ব্লকে বা ডাইনিং হলে যাওয়ার জন্য বেঞ্চ দিয়ে সাকো তৈরি করা হয়েছে।আমরা ভয়ে আছি কবে নিচের ফর্মগুলোতে পানি ঢুকে যাবে, কিন্তু অপেক্ষাকৃ্ত উচু অবস্থানের কারণে পানি আর ঢুকেনি। অথচ জাহাঙ্গীর হাউসে পানি ঢুকে গেছে।

এর পরদিন পানির অবস্থা একই, কমছে না। এদিন কোন খেলাও ছিলনা। সবাই বসে বসে অলস সময় কাটালো। আমাদেরকে উৎফুল্ল করে তোলার জন্য বোধহয় একটা সিনেমা দেখানো হয়েছিল বা ডিশের লাইন লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও সবাই প্রকৃ্তির মত কেমন যেন মনমরা হয়ে ছিল।

পরদিন ছিল বৃহস্পতিবার, তারমানে বরাবরের মত শেষের দুই পিরিয়ডে কালচারাল প্রোগ্রাম আছে। আমরা সবাই ৫ম পিরিয়ড শেষ করে অডিটরিয়ামে গেলাম। কালচারাল কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেল। ঝিমুনির মাঝে হঠাৎ করে ছোটখাটো একটা কাপুনি অনুভব করলাম এবং খানিক পরে নিজেকে আর সবার সাথে অডিটরিয়ামের বাইরে আবিষ্কার করলাম। ভূমিকম্প!!! পরে জানতে পেরেছিলাম রিকটার স্কেলে আর স্থায়িত্বকাল ছিল ৪.৮৯ সেকেন্ড। সেবারই প্রথম আমি ভূমিকম্প অনুভব করেছিলাম। পরে আর কোন ঝাকুনি ছাড়াই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল।

আর গত দুদিনের মত কলেজে বন্যার পানি তো আটকে ছিলোই। তো ঐদিন বিকালবেলা আমাদেরকে অপশনাল গেমস দেয়া হল(এর অনেকগুলো কারণ হতে পারে ভূমিকম্প বা আমরা বেশ কিছুদিন ধরে গেমস খেলতে পারছি না কিংবা ক্যাডেটরা যাতে হাউসে গোলমাল না করে তাই তাদের চিত্তবিনোদন উপলক্ষে এই ব্যবস্থা)। মোটামুটি সবাই গিয়েছিল এ্যাথলেটিকস গ্রাউন্ডে।
আমাদেরকে ১০-১২ টা ফুটবল দেয়া হল। আমরা প্রথমে পোলো খেলার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পরে বল যার কাছে আছে তাকে চোবাও নামের খেলাটা শুরু করে দিলাম। অনেক মজা হয়েছিল সেদিন। আর রাতে ছিল সিনেমা আর স্পেশিয়াল ডিনার। সব মিলিয়ে ঐদিন আমার জীবনের অন্যতম ঘটনাবহুল একটা দিন ছিল।

পরদিন থেকে পানি কমা শুরু করল, বৃষ্টি থেমে গেছে, পানি থেকে কেমন যেন পচা একটা গন্ধ আসছিল। সেই বন্যার পানি কমে কলাজের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে আরো ৩-৪ দিন সময় লেগেছিল। আর এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ফুটবল বিশ্বকাপ। ঘটনায় পরিপূর্ণ এই দুটি সপ্তাহের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না……………………( চলতে থাকবে )

১,৬৫৪ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “৬ বছর বা ২২০৩ দিন – ১৪তম পর্ব”

  1. মশিউর (২০০২-২০০৮)

    মনে পড়তেসে । ক্লাস সেভেনে ছিলাম । ভূমিকম্প দেখে মজা লাগসে । বন্যার কারণে আরো মজা পাইছিলাম । খুব চাইছিলাম যে পুরা কলেজ দশ হাত পানির নিচে ডুবুক । :grr:

    জবাব দিন
  2. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)
    আমাদের কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঘাঘট নদী

    এইখানে মনে হয় শ্যামাসুন্দরী খাল হবে।
    খালটা ঘাঘট নদীতে যেয়ে শেষ হইছে।

    ব্যাপক মজা পাইলাম।


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন
  3. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    চমৎকার লেগেছে পড়তে।
    ভূমিক্পের অভিজ্ঞতা কখনৈ হয় নাই।
    বন্যার গল্প শুইনা আমাদের বুয়েটের ২০০৪ সালের কথা মনে পড়ল। "দেশ ভাসে বন্যায় বসে থাকা অন্যায় " স্লোগানে পরীক্ষা পেছালো। তারপরে শুরু হলো রুটি বানানোর পালা। সেটা মজার অভিজ্ঞতা। সমস্যা হইছিলো, সবাই বালাইলে রুটি গোল হয় আর আমি বানাইলে হয় মানচিত্র। আমার ত্রাহি অবস্থা দেখে পরে অবশ্য বানানো বাদ দিয়া কামলার কাজ দেয়া হলো। ঢাকায় বাসা থাকায় বেশিদিন হলে থাকা হয় নাই। তারপরেও হাঁটু পানিতে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতা বেশ মজার ছিল।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।