ধোঁকামী, …অতঃপর, সি.এম.এইচ ভ্রমণ

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে আমি ছিলাম দুর্দান্ত ভাল ছাত্র। আমার স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল জাহাঙ্গীর স্যার(বহিষ্কার হওয়া এক্স-ক্যাডেট), আমাকে ‘অ্যাটম বোমা’ উপাধি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, আমি এম্নিতে শান্ত, কিন্তু পরীক্ষার সময় সবাইরে ফাটায়ে ফেলি আর কি! ধারে কাছে কেউ থাকে না। তো এই আমি ক্যাডেট কলেজে আসার পর সম্পূর্ণ বদলে গেলাম। অ্যাটম বোমা থেকে খুব দ্রুত সাধারণ পটকা হয়ে গেলাম। ক্লাস সেভেন লাইফটা ৪ থেকে ১০ এর মধ্যেই পার করেছি। কিন্তু তারপরে ইতিহাস হয়ে গেছি। একসময় আমরা ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’ অর্থাৎ আমি, তৌফিক, নকীব এবং রাফাত এই ৪ জন লাস্ট পজিশন দখলের জন্য রীতিমত জীবন দিয়ে দিতাম।

কলেজে তখন SSC-র প্রস্তুতি স্বরূপ প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে। মাত্র ২ সপ্তাহ বাকি। চিন্তা করলাম, ক্যামনে পরীক্ষা ফাঁকি দেই? কোন উপায় না পেয়ে, হসপিটালে মেডিক্যাল অফিসার ‘মেজর রশীদ’ এর কাছে গেলাম। বললাম, “স্যার আমার ভয়াবহ অসুখ হইছে। মাথার ভিতরে চিনচিন করে। ঘুমাইতে পারি না। কাশির সাথে রক্তও বাইর হইতাছে। আমি মনে হয় আর বাচুম না।” বলেই মুখটা একটু কাঁদো কাঁদো করার চেষ্টা করলাম। খুব বেশি চেষ্টা করতে হল না, কারণ আমার চেহারাটা এম্নিতেই কাঁদো কাঁদো। কাজেই মেডিক্যাল অফিসারের মনটা খুব দ্রুত গলে গেল। আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, “কোন চিন্তা করো না। আমি এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমি থাকতে তোমার কোন ভয় নাই।”

দেরী না করে মেডিক্যাল অফিসার তখনই আমাকে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলেন। (যা ছিল ক্যাডেটদের সর্বরোগের মহাঔষধ)। আধাঘন্টা পর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মাথায় কি এখনও চিনচিন করছে?” আমি বললাম, “জী স্যার। কাম হইতাছে না। মনে হয় প্যারাসিটামল আরো কয়ডা খাওন লাগবো।” মেডিক্যাল অফিসার তখন চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমাকে হসপিটালে ভর্তি করে নিলেন। নিজ উদ্যোগেই আমাকে পরদিন তার পরিচিত ডাঃ কামাল এর কাছে নিয়ে গেলেন। ডাঃ কামাল আমার স্কুল-বন্ধু সাদিকের বড় ভাই। কাজেই আমাকে দেখামাত্র তিনি চিনে ফেললেন। সবকিছু শুনে এবং টেস্ট করে বললেন, “অবস্থা খুবই খারাপ। তাড়াতাড়ি ঢাকায় বড় ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।” আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম। ঢাকায় তো চাইলেই নিয়ে যাওয়া যায় না, ক্যাডেট কলেজের সব কিছুই সিস্টেমের ভিতর দিয়ে করা লাগে। তাই ২ দিন পর মেডিক্যাল অফিসার নিজেই আমাকে নিয়ে যশোর সি.এম.এইচ গেলেন। ওখানে ডাক্তারকে বিস্তারিত বলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসলেন। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আমাকে বিভিন্ন টেস্ট করা হল। মাথার কোথায় চিনচিন করে দেখালাম। আক্কেল মাড়ির পাশের দাঁত দিয়ে চুষে রক্ত বের করতে পারতাম। (অবশ্য তখনো আক্কেল মাড়ি গজায় নি)। তাই কাশির সাথে রক্ত বের হচ্ছে এইটা দেখাতেও খুব একটা সমস্যা হয় নি। বিভিন্ন টেস্ট শেষে প্রমাণিত হল, ‘রোগীর অবস্থা আশংকাজনক। তাকে দ্রুত ঢাকা সি.এম.এইচ –এ রেফার করতে হবে’। আমার পরিবারের সদস্যদের ডাকা হল। এরপর আমার বাবার সাথে গিয়ে ঢাকা সি.এম.এইচ –এ ভর্তি হলাম। ওখানে ভর্তি হয়ে স্বপ্নের মত দিন পার করতে লাগলাম। অফিসার্স ওয়ার্ডে আমার সাথে আরো ছিল পাবনা ক্যাডেট কলেজের মাসুদ ভাই, মির্জাপুরের মারুফ ভাই, ক্যাপ্টেন আহসান এবং আরো অনেকগুলো আড্ডাবাজ আর্মি অফিসার। আমি মোটেও আড্ডাবাজ ছিলাম না, কিন্তু খুবই মনোযোগী শ্রোতা ছিলাম। তাই আড্ডায় আমার ভূমিকা থাকত অনেক। আমরা প্রায়ই সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে ফার্মগেট গিয়ে শিক কাবাব আর নান রুটি নিয়ে আসতাম। খাওয়ার সময় মাসুদ ভাইকে বলতাম, “ভাই, আমি তো বেশিদিন বাচুম না, আমার একটু বেশি খাওন দরকার না?” তখন মাসুদ ভাই সান্ত্বনা সহকারে বলত, “আরে কিচ্ছু হইবনা, চিন্তা কইরো না। এই নাও কাবাব খাও, বলে নিজের ভাগ থেকে আমাকে একটু কাবাবের টুকরা তুলে দিত। মুখটা পাংশু করে তার দেখাদেখি অন্যরাও দিতে বাধ্য হত। ‘আরে কি দরকার ছিল’- এই রকম ভাব দেখিয়ে আমি সব সাবাড় করতাম।

আমাদের ব্রেকফাস্ট, ট্রলিতে করে রুমে দিয়ে যেত। ঘুম নষ্ট করে খাইতে মন চাইত না। প্রায়ই খাবার পড়ে থাকত। ওয়ার্ডের ইন-চার্জ এ ছিলেন কর্ণেল মজীদ। মাঝে মাঝে রুমে এসে গর্জন করে বলতেন, “খাবার নষ্ট করা হয় কেন? রুমের এসি-ও দেখি বন্ধ হয় না। সরকারী মাল দরিয়া মে ঢাল !! হুম?”

সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে টিভি রুমে আমরা ফিল্ম দেখতাম। সমস্যা বাঁধাত এক স্টারপ্লাস ভক্ত লেঃ কর্ণেল। সেখানে এক মেজরও ছিল আমাদের সাথে। একদিন, আমাদের মত মেজর সাহেবও রেগে আছেন, বুঝতে পারতেছি। হঠাৎ, তিনি নরম সুরে কর্ণেলকে বললেন, “স্যার মনে হয় ভাবীকে খুব মিস করতেছেন, না?” কর্ণেল হাসতে হাসতে বললেন, “তা তো অবশ্যই”। মেজর বললেন, “আমরা অবশ্য সিনেমা মিস করতেছি স্যার। সিরিয়াল দেখা বাদ দিয়ে যদি একটু কষ্ট করে HBO তে দিতেন…”। আমরা পেছনে বসে নাক টিপে ফোঁসফোঁস করে হাসতে লাগলাম।

এইরকম আরো অনেক মজার ভিতর দিয়ে ঢাকা সি.এম.এইচে দেখতে দেখতে দেড় মাস পার হয়ে গেল। এর মধ্যে, মেডিনোভা থেকে আমার সিটিস্ক্যান করা হল। সি.এম.এইচ –এও অনেকগুলো টেস্ট করানো হল। ডাক্তার আমাকে চিকিৎসা করতে গিয়ে মোটামুটি খেই হারিয়ে ফেললেন। অবশেষে, দিশেহারা হয়ে এক প্রকার অনিশ্চিতের মতই আমাকে রিলিজ করে দিলেন।

এসে পড়লাম ক্যাডেট কলেজে। আমাকে দেখে মেডিক্যাল অফিসার বেশ চওড়া হাসি দিলেন। বললেন, “আরে রাজীব, তুমি তো দেখি মোটা হয়ে গেছো!”

আমি বললাম, “মোটা হই নাই স্যার। খাওয়া-দাওয়া করতে পারি না। শরীরটা এম্নিতেই ফুলে যাচ্ছে। ওষুধের সাইড-এফেক্ট সম্ভবত!” মেজর রশীদের হাসিটা ম্লান হয়ে গেল। তাকে আবার কিছুটা চিন্তিত মনে হল।

আমি অবশ্য আমার মিশনে সাকসেসফুল হলাম। প্রি-টেস্ট পরীক্ষা তো দেওয়া লাগে নাই ! 😀
সি.এম.এইচ -এ থাকা অবস্থায় আমি অবশ্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, আমাকে হয়ত বাঁচানোর জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হবে। কিন্তু তা আর হল না ! আফসোস !! 😛

“Looking back at my life’s voyage, I can only say that it has been a golden trip.”

১,৪৭৭ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “ধোঁকামী, …অতঃপর, সি.এম.এইচ ভ্রমণ”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    হা হা হা, মজা পেলাম পড়ে। ব্লগে স্বাগতম রাজীব।

    একটা কথা, ক্যাডেট কলেজ ব্লগে আমরা ছদ্মনাম ব্যবহার করি না, নামটা পরিবর্তন করে নামের সাথে কলেজে অবস্থান জুড়ে দিতে অনুরোধ করছি।

    হ্যাপি ব্লগিং 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)

    অসম্ভব সুন্দর লাগলো বুদ্ধিটা, :boss:
    প্রথমে ভাবছি রাজীব ভাই(৯০-৯৬) লিখছেন এইটা। পরে দেখলাম অন্য ভাই। 😛
    ব্লগে সাগতম ভাই। আরো লেখা চাই।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  3. সিরাজ(১৯৯১-১৯৯৭)

    মজা পেলাম আর পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। আসলে এই ব্লগে আসার অন্যতম প্রধান কারণ পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া। আমাদের ক্যাডেট লাইফেই সবারই কম বেশী এরকম কিছুর অভিজ্ঞতা আছে।
    ধন্যবাদ।


    যুক্তি,সঠিক তথ্য,কমন সেন্স এবং প্রমাণের উপর বিশ্বাস রাখি

    জবাব দিন
  4. ভালো লাগলো আপনার সেই নস্টালজিক ভ্রমণ। আমিও খায়বার হাউসের ছিলাম। আমার প্লুরাল ইফিউশন হওয়াতে আমাকে যশোহর সি এম এইচে কয়েকমাস থাকতে হয়েছিল। আর এরপর দু'বছরের জন্য রেস্ট। তাই আর ক্যাডেট কলেজে কন্টিনিউ করা হল না।
    আপনার লিখাটি অনেক ভালো লাগল। শুভকামনা রইলো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।