আবোল তাবোল ২

আগের পর্বের লেখাটা বেশ বিরক্তিকর হয়েছিল এটা আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি । তাই ভেবেছিলাম ক্যাডেট কলেজ ব্লগ আমার উপর রাগ করেছে । কারন আমি অনেক চেষ্টা করেও লেখা সাবমিট করতে পারছিলামনা । বেশ চিন্তিত হয়ে গেলাম । কী হল ? পরে দেখলাম ক্যাডেট কলেজ ব্লগ নয় , দোষ আমার নিজের । আমি যে ছোট একটা ভুল করছিলাম সেটা আমি খেয়াল করিনি । এজন্য একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম । ক্যাডেট কলেজ ব্লগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিনা কারনে সন্দেহ করার জন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছি ।

 

লেখাটা যখন শুরু করব তখন হঠাৎ করে বাইরে বেশ হৈচৈ শুনতে পেলাম । “হাতি , হাতি ”- এই চিৎকার শুনে একটু অবাক হয়ে গেলাম । ভাবলাম কেউ মনে হয় হাতি নিয়ে এসেছে । ঢাকা শহরে চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও হাতি দেখা যায় বলে আমার মনে হয়না । তাই ভাবলাম হাতি দেখার অবর্ণনীয় সুযোগ হাতছাড়া করা যাবেনা । লেখা পরেও লেখা যাবে , কিন্তু হাতি পরে দেখা যাবেনা । এই ভেবে অনেকটা দৌড়ে বারান্দায় গেলাম । কিন্তু তাকিয়ে দেখলাম একটা মিছিল যাচ্ছে । কিন্তু কোথাও কোন হাতি নেই । তখনই মনে পড়ল আমাদের এলাকা থেকে একজন নির্বাচনে দাড়িয়েছেন । এবং তার মার্কা হল হাতি ।

 

হ্যা এখন নির্বাচনী মৌসুম বলা যায় । যদিও নির্বাচনের রেজাল্ট অনেক আগেই আমাদের হাতে চলে এসেছে । সরকার দল নির্বাচনের আগেই ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন । গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষ এখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রতিদিন দেখা করার চেষ্টা করছেন এমন একটা রেকর্ডের জন্য । কিন্তু প্রধানমন্ত্রী টাইম দিতে পারছেননা । কারন এখন তিনি অনেক ব্যস্ত । তারপরও তারা হাল ছাড়েনি । তবে যারা এমন রেজাল্টে আশাহত হয়েছেন তাদেরকেও সুসংবাদ দেয়ার চেষ্টা করি । প্রথম আলোর বিলিভ ইট অর নটে সেদিন দেখলাম এক লোক নাকি প্রায় ৫১ ভাগ ভোট পেয়েও হেরেছেন । কীভাবে হেরেছেন তা ওখানে লেখা ছিলনা । কেবল আল্লাহ্‌ই ভাল বলতে পারবেন । এহেন রেকর্ড যেহেতু আছে আপনারা এখনও আশা দেখে যেতে পারেন । আমরা আবার রেকর্ড ব্রেক করতে পছন্দ করি তো । বলাও যায়না এ রেকর্ডও কীনা ব্রেক হয়ে যায় ।

 

যাই হোক । এবারের লেখাটা চেষ্টা করব সম্পুর্ন নির্বাচন নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি । যখন নির্বাচন নিয়ে কথা আসে তখন একটা ছোট একটা গল্পের কথা মাথায় আসে । এক লোক নির্বাচনের দাড়িয়েছে । তো নির্বাচনী প্রচারনাও চালিয়েছিল । কিন্তু ফলাফল দিতে গিয়ে দেখা গেল বেচারা মাত্র তিনটা ভোট পেয়েছেন । তখন তার স্ত্রী ক্ষেপে গিয়ে বলল , তুমি আর কোন জায়গায় বিয়ে করছ যে সেই বৌ তোমাকে ভোট দিয়েছে ।

লোকটির জন্য কিছুটা হলেও মায়া হচ্ছে । কারন এত কষ্ট করে নির্বাচনে দাড়িয়ে বেচারা মাত্র তিনটা ভোট পেলেন । এ দুঃখ রাখার জায়গা খুজতে না খুজতেই তার বৌ কিনা তাকে সন্দেহ করে বসল । ঘটনাটা কোন দেশের প্রেক্ষাপটে বানানো জানিনা । তবে এতটুকু বলতে পারি , যদি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বানানো হয় , তাহলে বেচারাকে নেহায়েত গোবেচারা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবেনা । মনে হতে পারে সে হয়ত খারাপ বলে লোকে তাকে ভোট দেয়নি । তবে আমি বলব বেচারা হয়ত ভালো দেখেই কারো কাছ থেকে ঠিকমত ভোট আদায় করে নিতে পারেননি । কারন আমাদের দেশের ভোটারদের কাছ থেকে ভোট আদায় করে নিতে হয় । আপনি যতই ভালোমানুষ হননা কেন আপনি যদি দুটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কার কোনোটিরই মালিক না হন অথবা ঠিকমত প্রচার না করতে পারেন –তাহলে ভাই আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন ওই দু’টা তিনটা ভোটের বেশি কোনভাবেই পাবেননা ।

 

আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় যে প্রচার হয় অতি সুপ্রাচিনকাল থেকেই তার মাঝে এক আলাদা শিল্প আছে ।  আমার বাবার মুখ থেকে শোনা একটা গল্প না বলে পারছিনা । আমার বাবার চাচা , মানে আমার দাদা “কুড়েঘর” নামক এক মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতেন (আমি আসলে কাউকে হ্যারেস করতে চাচ্ছিনা । গল্পের খাতিরে নাম ব্যবহার করা হয়েছে ) । তো নির্বাচনের সময়ে গ্রামে যেতেন । আমার বাবাও গিয়েছিলেন । তো সবাই নৌকায় করে শ্লোগান দিচ্ছে । আমার বাবাও দিচ্ছিলেন – “তোমার ভাই আমার ভাই , অমুক ভাই অমুক ভাই ”। (নাম উল্লেখ করবনা । তবে তিনি অনেক আগে ইন্তেকাল করেছেন । আল্লাহ্‌ তাকে বেহেশতবাসি করুন) দাদু বেশ বিব্রত হয়ে গেলেন তার ভাতিজার এ শ্লোগান শুনে । পরে বাবাকে অনেক কষ্টে থামানো হয় । পাশের নৌকা থেকেও এই মার্কাটিকে পচিয়ে শ্লোগান দেয়া হচ্ছিল – “কুড়েঘরে থাকে কারা / বাইত্তা ইন্দুর ত্যালাচোরা (তেলাপোকা)” । অসাধারন কাব্য ।

 

বর্তমান সময়েও অনেক সুন্দর সুন্দর কাব্যিক ছন্দে ভরা শ্লোগান ব্যবহৃত হয় । “যেমন তোমার ভাই আমার ভাই , অমুক ভাই অমুক ভাই”, “অমুক ভাইয়ের চরিত্র , ফুলের মতন পবিত্র”, “অমুক মার্কায় দেব ভোট , শান্তি পাবে দেশের লোক” ইত্যাদি ইত্যাদি । যাকে নিয়ে এসকল শ্লোগান দেয়া হয় তিনি আসলেই সবার ভাই কিনা , তার চরিত্র আসলেই ফুল বা ফলের মতন পবিত্র কিনা , অথবা তাকে ভোট দিলে আসলেই দেশে শান্তি আসবে কিনা – এটা খুব একটা বিবেচনার বিষয় নয় । বিশেষ করে যারা গলা ফাটিয়ে এহেন শ্লোগান দেন , তারাও এ ব্যপার নিয়ে মাথা ঘামাননা । কারন নেতা তাদের এই গলা ফাটিয়ে একথাগুলো বলার জন্য ভাল বকসিস দেন । তবে সেটার চেয়ে সবচেয়ে বড় বিবেচনার যে কথা , তা হল এই শ্লোগানের মতন এমন বিশেষ শিল্পকর্মকে আজো আমরা সাহিত্যে স্থান দেয়নি । বড়ই দুঃখজনক । এ বিষয় নিয়ে প্রেসক্লাবে একটা মানব-বন্ধন আয়োজন করা যেতে । মানব-বন্ধন নিয়েও একটা গল্প মাথায় চলে এল । কিন্তু এটা এখন বলবনা । পরে কোন একসময়ে বলব ।

 

সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা এখানে বলা জরুরী তা হল , নির্বাচনকে কিন্তু আমরা রাজনৈতিক নেতা ও জনগনের সেতুবন্ধন হিসেবে দেখতে পারি । কারন নেতারা সুদীর্ঘ পাচ বছর তাদের নির্বাচনী এলাকার খোজ নেন আর নাই বা নেন । এসময়টাতে তিনি অবশ্যই অবশ্যই এলাকায় যান । তিনি হাটেন আর তার পাশে তার কিছু সহযোগী (খাটি বাংলায় চ্যালা) থাকেন । সহযোগীদের মুখে একটা সুন্দর তেলমাখা হাসি থাকে । আর নেতার মুখে থাকে এক নিষ্পাপ হাসি । তার মনটাও নরম থাকেন । ধনী গরীব যেই হোকনা কেন আস্তে করে তাকে বুকে টেনে নেন । পাশের সহযোগীর কণ্ঠে তখন সমবেদনার সুর , আহা নেতা কত ভালো দেখেছেন । সবাইকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসেন । যার সাথে মোলাকাত করেন সে মানুষটাও মুগ্ধ হয় । আসলেই কত ভালো মানুষ । সে যদি হাজার কোটি টাকা চুরিও করে থাকে অতীতে তা আর মাথায় থাকেনা । নেতার প্রস্থানের সময় পাশের সহযোগীরা বলে উঠে , ভোটটা পারলে নেতাকেই দিয়েন । তখন নেতা হয়ত কপট ধমক দিয়ে সহযোগীকে বলেন , চুপ থাক । ভোট উনি কাকে দিবেন তা দিয়া তুই কী করবি ? উনার যাকে ভাল লাগে উনি তাকেই ভোট দিবেন । নির্বাচন শেষ হবার পর তাদের জনগনের মাঝে পাওয়া যাক আর নাই যাক অন্তত নির্বাচনের এই সময়টাতে তারা হঠাৎ করেই পাশে চলে আসেন ।

 

আর নির্বাচনের সময় সবচেয়ে বড় যে ব্যপারটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠে তা হল প্রধান দুই দলের তৈরি করা নির্বাচনী ইসতেহার । অর্থাৎ তাদের অঙ্গিকারনামা । তারা পরবর্তীতে দেশের তরে কী কী করতে চান । অনেকটা বইয়ের মতন করে এ বস্তুটা বের করা হয় । এ বস্তুটার ঠিকানা নির্বাচনের পরে কোথায় হয় তা নিয়ে অনেকের মাঝে মৃদু চিন্তা থাকলেও নির্বাচনের সময়ে এর কার্যকারিতা অন্যরকম । এবং টেলিভিশন চ্যানেলের টক-শো বক্তারা থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের সকলেই এই বস্তুটাকে নানা ভাবে বিশ্লেষণ করতে থাকেন । তবে আমার ধারনা তারা খুব ভালো করেই হয়ত জানেন , নির্বাচন শেষে এ বস্তুটাকে ডাস্টবিনে ফেলা হয় । আর চায়ের কাপ থেকে শুরু করে বাসের মধ্যে শুরু হয় আলোচনার ঝড় । সেখানে নানা শ্রেনী ও পেশার মানুষ নানান ভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে থাকেন এবং তর্ক-বিতর্ক প্রতিযোগিতার শুরু হয়ে যায় । আমরা বোধহয় জন্মগতভাবেই তার্কিক ।

 

তবে সব কথার শেষ কথা একটাই আমরা যারা mangopeople  অর্থাৎ আমজনতা তারা খুব আশা নিয়ে ভোট দেই যে দেশে খুব শান্তি ফিরে আসবে এই ভেবে ।  আমাদের সে আশা কতটুকু পূর্ণ হয় তা বলবনা । তবে আমরা স্বপ্ন দেখতে খুব ভালবাসি ।

৭৮৭ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “আবোল তাবোল ২”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    কুড়েঘরের সাপোর্ট আমরাও করেছিলাম সেই ছোটবেলায়।
    পরে বড় হয়ে জানতে পারি হাফেজ্জী হুজুর পাকি দালাল ছিলেন।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।