বিজয়ের দিনে আজ কিছু কথা

বেশ কিছুদিন আগে কাদের মোল্লার ফাসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে দেশে প্রথম যুদ্ধ অপরাধীর বিচার সমাপ্ত হল । এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন । এবং সেই সাথে নিন্দাও জ্ঞাপন করতে চাই এই কারনে এই বিচার শুরু হতে দীর্ঘ ৪২ বছর লাগার কারনে । যাই হোক আমি সে বিষয়ের দিকে যাচ্ছিনা। শুধু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই । একজনের শহীদের মর্যাদা আমাদের সবার কল্পনার বাইরে । তাই কাউকে শহীদ বলার আগে একশবার হলেও ভাবা উচিত । কারন আপনি যদি একজন ভুল মানুষকে শহীদ বলে ঘোষণা দেন তাহলে তা আমি মনে করি ইসলামের দৃষ্টিতে অনেক বড় গুনাহর সামিল হবেন । আরো একটা ব্যপার নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই। একজন মানুষ যত বড় পাপী বা যত বড় অপরাধীই হোক না কেন সে যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয় তখন তার পরিস্থিতি ভিন্ন হয়ে যায় । মৃত্যুর সে অনুভুতি বোঝার সাধ্য কারো নেই । একবার মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফিরে এসেছি বলে ব্যপারটা উপলব্ধি করতে পারি । আমরা যেখানে মানবাধিকার বিরোধী অপরাধীকে শাস্তি দিচ্ছি সেখানে আমাদের নিজেদের  মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলাটা কাম্য নয় । হ্যা , সে মানবতাবিরোধী কাজ করেছে সে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে । এবং তা কার্যকর ও হয়েছে । কিন্তু সেই মানুষটির মৃত্যু নিয়ে আনন্দ উল্লাস করা উচিত বলে আমি মনে করিনা।

 

আমি সরকারকে আরো একটি বিষয়ে ধন্যবাদ জানাতে চাই অসাধারন এক গনতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজন করার জন্যে যেখানে দেশের প্রায় ৫০ ভাগ লোককে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবেনা । কারন প্রার্থী আগেই নির্বাচিত হয়ে আছে । আসলেই সরকার দেশের মানুষের কষ্ট নিয়ে ভাবে । স্বীকার না করে উপায় নেই ।

 

যাই হোক । আমার জন্ম ১৯৯২ সালে । আমি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখতে  পারি নাই । এমন কী স্বৈরাচার এরশাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার সেই সময়টাও আমার দেখা হয়নি । ক্ষুদ্র ২১ বছরের জীবনে আমি যতটুকু দেশটাকে দেখেছি , যতটুকু জ্ঞানলাভ করেছি ঠিক ততটুকু নিয়েই আমি আজ একটা প্রশ্ন করতে চাই । তা হল , সত্যিই কি আমরা স্বাধীন ?  এই যে আজ আমরা যে বিজয় দিবস পালন করব সত্যিই কি সেই বিজয় অর্জিত হয়েছে ? আমরা কি নিজেদের স্বাধীন জাতি হিসেবে ঘোষণা করতে পারি ?

 

একটি স্বাধীন দেশের মানুষ রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে নিশ্চিন্তে চলাফেরা করবে- এমনটাই নিয়ম হওয়ার কথা । আসুন তো আমরা হিসাব করি আমরা কে কয়দিন গৃহবন্দি হয়ে পড়ে আছি । কেন গৃহবন্দি? – কারন রাস্তায় বের হলে যদি আমার মাথায় ককটেল পড়ে বা ইটের টুকরা পড়ে । যারা পেটের দায়ে বের হচ্ছে তারাও আল্লাহ্‌র নাম জপতে থাকে যাতে মাথায় ককটেল না পড়ে বা গাড়ি না পোড়ায় । আর যাদের মাথায় ককটেল পড়ছে তারা হয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে কাতরাতে কাতরাতে হয়  কোনমতে বেচে আছে না হয় মারা যাচ্ছে । আর যারা বেচে যাচ্ছে তারাও ভাবছে কীভাবে তার চিকিৎসার খরচ চালাবে – এর চেয়ে যেন মরে যাওয়াই ভাল ছিল । আর কারা এই পরিস্থিতির মধ্যে আছে – আপনার আমার মত সাধারন মানুষ যারা রাজনীতির ধারের কাছেও যাইনি । যারা শুধু শান্তিতে দুমুঠো ভাত খেতে চাই । আর বেচে থাকতে চাই ।

 

আজ ব্যবসায়িরা ব্যবসা বাদ দিয়ে আরো কিছু সহকর্মী মিলে ক্যারাম খেলে । ক্যারামের গুটি যদি হারিয়ে যায় সেটা কেনারও টাকা তাদের কাছে ঠিকমত নেই । টাকা আসবে কোথা থেকে ব্যবসাই তো নেই । হরতালে গাড়ি চলেনা , মালামাল আসেনা । আজ আমাদের বাসার কাছের দোকানে গিয়ে বলা যায় গড়ের মাঠই দেখলাম । আমার দিকে তাকিয়ে দোকানদার হাসি মুখে বলল ভাই গাড়ি আসেনা তাই মালামাল ও নেই । টানা অবরোধ চলছে । সপ্তাহে ৭দিনের ৬দিন অবরোধ । শুক্রবারটা আপাতত মনে হয় বাদ যাচ্ছে । কয়েকদিন পর বোধ হয় শুক্রবারকেও ছাড় দেয়া হবেনা । এই তো গতকাল ব্যবসায়িরা সাদা পতাকা মিছিল করল । টিভিতে ছবি দেখলাম কাগজ দিয়ে পতাকা বানিয়ে তা নিয়ে দাড়িয়ে ছিল । হয়ত সাদা কাপড় কেনার পয়সা খরচ করার মত অবস্থা তাদের নেই ।

 

বর্তমানের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমি আজ অনেক বড় একটা উপন্যাস লিখতে পারব । তাই এখানেই ক্ষান্ত হলাম । আমার প্রশ্ন একটাই এটা কী একটা স্বাধীন দেশের চিত্র । যুক্তরাস্ট্র যখন ইরাকে হামলা চালিয়েছিল তখন ইরাকে তো মনে হয় এরকম অবস্থা হয়নাই আজ যা আমাদের দেশে হচ্ছে । কয়েকদিন পর জাতিসংঘ আমাদের দেশ থেকে শান্তিরক্ষাকর্মী না নিয়ে উলটো আমাদের দেশে শান্তিরক্ষাকর্মী নিয়োগ দিবে । কিছুদিন আগে জাতিসংঘের দুত অস্কার সাহেব এদেশে এসে আমি আশা করি ভালোই বুঝে গেছেন – এদেশের রাজনীতিবিদরা কী চিস !

 

কিছুদিন আগে একটা লেখায় আমি আমাদের প্রধান দুই দলের রাজনীতিবিদদের নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিলাম । আজ দেখছি তখনকার অবস্থা এখনকার থেকে ভালো ছিল । তখন আমাদের রাজনীতিবিদদের ওপর অনেক দোষ চাপিয়ে ছিলাম । কিন্তু ভেবে দেখলাম আমাদের আমজনতার ও কিন্তু দোষের অভাব নেই । কারন আমরা এই বিখ্যাত দুই দলকেই বারবার ক্ষমতায় আনছি । এখন হয়ত প্রশ্ন আসবে তাহলে ক্ষমতায় বসবে কে ? আমরা সব জনগন মিলে কী পারিনা নির্বাচন বয়কট করতে । যারা দেশের কথা চিন্তা করেনা , ক্ষমতায় বসে ক্ষমতার অপব্যবহার করে , আর বিরোধিদলে গেলে হরতাল অবরোধ দিয়ে দেশকে পঙ্গু করে দেয় – আমরা পারিনা সোচ্চার হয়ে বলতে যে আমরা তোমাদের হাতে দেশের ক্ষমতা দেবনা । আমি স্বাধীনতা দেখিনি কিন্তু আমি মনে করি এটাই তো ছিল স্বাধীনতার চেতনা যা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবেনা । অপশাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবে । শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করবে । কোথায় সেই চেতনা ? এই রাজনীতিবিদরা তো আমাদেরই ভোটে নির্বাচিত হয় । আমরা কী পারিনা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে ?

 

আজ ১৬ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালে এই দিনে আমরা তৎকালিন পাকিস্তানী শাসকদের হাত থেকে এ দেশকে মুক্ত করেছিলাম । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আজ ৪২ বছর হয়ে গেল আমরা সেই স্বাধীনতার পরিপূর্ণ মর্যাদা আজ ও প্রতিষ্ঠা করতে পারিনাই । এমনকি স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাসও আজ আমরা হাতে পাইনি । যে ইতিহাস আছে তা সরকার বদলের সাথে সাথে বদল হয়। ইতিহাস পরিবর্তন হয় আর কী । হ্যা, আজ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে মার্চপাস্ট হবে । আজ গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ডে রেকর্ড করার জন্যে সবচেয়ে বড় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে । আজ সবার মাঝে যেন স্বাধীনতার চেতনা উম্মোচিত হবে । আমার প্রশ্ন একটাই । আমরা কী সত্যিই সেই স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি ? ১৯৭১ এ যারা শহিদ হয়েছেন সুন্দর একটি দেশ উপহার দেবার জন্যে ,আমরা কি পেরেছি তাদের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে ? আজো যারা জীবিত মুক্তিযোদ্ধা আছেন তারা কাদেন । কারন তারা এমন দেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করেননি যে দেশের মানুষ তাদের জীবন রাজনৈতিক নেতাদের হাতে জিম্মি করে দিয়েছে । তার এমন দেশের জন্য যুদ্ধ করেননি যে দেশে মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে ভয় পাবে । তারা একটা সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন । দু চারটা যুদ্ধাপরাধীকে ফাসিতে ঝুলালেই তাদের ঋণ শোধ হয়ে গেল , আমরা স্বাধীনতার নতুন স্বাধ পেলাম – এমনটা ভাবা বোকামি । আমাদের ব্যপারটা এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে – আমার স্ত্রী অসুস্থ , আমি তার চিকিৎসা না করে আমাদের ম্যারেজ ডে পালন করছি , তার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করেছিল তাকে শাস্তি দিচ্ছি । আমাদের স্বাধীনতা আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমাদের কর্মকাণ্ডে । আমাদের উচিত তার চিকিৎসা করা । নতুবা সেই মানুষেরা আমাদের কখনোই ক্ষমা করবেননা যারা এই স্বাধীনতার জন্যে রক্ত দিয়ে গেছেন । সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ।

 

১,০৯২ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “বিজয়ের দিনে আজ কিছু কথা”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    সামনের এক বছরে অনেক কিছু সাইজ হবে।
    আরো কিছু প্রাণ যাবে এই যা।

    উপরে কাদেরের শহীদ হওয়া নিয়া কিছু বললা।
    এইটা বলোতো যেইসব অমুসলিমেরা ৭১ এ প্রাণ দিছে তারা শহীদ কিনা? (সম্পাদিত)


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • রাশেদ(২০০৫-২০১১)

      এরকম একটি প্রশ্ন আমি আশা করছিলাম । ধন্যবাদ ভাইয়া । আমার জ্ঞান কম ভাইয়া । আমি ব্যপারটা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে বলেছি । যেহেতু আমরা মুসলিম দেশ তাই আমি মনে করি যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের মধ্যে মুসলমান বেশি । আর নিঃসন্দেহে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বলে শহীদ ।

      জবাব দিন
      • সৌরভ(০৬-১২)

        সেই মানুষটির মৃত্যু নিয়ে আনন্দ উল্লাস করা উচিত বলে আমি মনে করিনা।
        .
        ৭১ এ যেসব হানাদাররা মরছিল তাদের মৃত্যুতেও কি উল্লাস করা ভুল ছিল???


        মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...

        জবাব দিন
        • রাশেদ(২০০৫-২০১১)

          দেখ ভাইয়া , সেইসময় আমাদের উল্লাসের প্রধান বিষয় কিন্তু ছিল আমাদের স্বাধীনতা অর্জন । তাছাড়া আমি যে কথাটা বলেছি তা আমি নিজের চিন্তাধারা থেকে বলেছি । আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি এটা । ওই লোকটি অন্যায় করেছে এবং তার সঠিক শাস্তি সে পেয়েছে । আমরা তো খারাপ নই । তাহলে আমরা এমন কোন কাজ বেছে নেব কেন যা মানবতার বিরুদ্ধে কথা বলে ।

          জবাব দিন
  2. তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

    আমার স্ত্রী অসুস্থ , আমি তার চিকিৎসা না করে আমাদের ম্যারেজ ডে পালন করছি , তার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করেছিল তাকে শাস্তি দিচ্ছি । আমাদের স্বাধীনতা আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে আমাদের কর্মকাণ্ডে । আমাদের উচিত তার চিকিৎসা করা ।
    (সম্পাদিত)


    আমি চোখ মেললুম আকাশে
    জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সৌরভ(০৬-১২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।