একটা পাখি তিনটা পাখি চারটা পাখি

[নামটা বেশ হাস্যকর মনে হতে পারে । হওয়াটাই স্বাভাবিক । আসলে নামকরনের পেছনে ছোট্ট একটা কাহিনী আছে । আসলে আমি এই লেখাটার বা গল্পটার জন্যে কোন নাম খুজে পেলাম না । তখন হুমায়ুন আহমেদ স্যারের বইয়ে একটা ছোট্ট ধাধা পেলাম । এবং সেটাকে একটু পরিবর্তন করে সেই নামটাই ব্যবহার করলাম।]

 

রফিক সাহেব পত্রিকার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন । আজকাল পত্রিকায় ভালো কোন সংবাদ পাওয়া যায়না – এ জন্য তিনি বিরক্ত নন । এই মুহূর্তে তার বিরক্তির মূল কারন তার টেবিলের সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটা । ছেলেটা দীর্ঘ ১০ মিনিট যাবত দাড়িয়ে আছে । আর দশটা ছেলে হলে এতক্ষণে হয়ত কথা বলে ফেলত । হয়ত কিছু বলে এতক্ষণেই বিদায় দিয়ে দেয়া যেত । কিন্তু চুপচাপ থাকায় ছেলেটাকে তিনি কিছু বলতে পারছেনা । তিনি ভাবছেন ছেলেটা হয়ত তাকে কথা বলতে না দেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদায় নিয়ে নেবে । কিন্তু ছেলেটা তা করছেনা । উলটো ঠায় দাড়িয়ে আছে ।

 

ছেলেটার চেহারা তিনি এখন ও দেখেননি । তবে পত্রিকার ফাক দিয়ে পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে সে গ্রাম থেকেই এসেছে । এবং তিনি অনেকটা নিশ্চিত ছেলেটা তার গ্রাম বা আশেপাশের এলাকা থেকে তার কাছে এসেছে । মকবুলকে কে বিদায় দিয়ে রোকনকে নিয়োগ দেয়াটা ভুল হয়ে গেছে । মকবুল শুকনা ছিল আর বদ অভ্যাসের মধ্যে ছিল বিড়ি খাওয়া । এই ব্যপারটা তার পছন্দ ছিলনা । আর ও বড় যে বাজে স্বভাব ছিল তা হল দিনের বেলা টুলে বসে নাক ডেকে ঘুমানো । কিন্তু এত সহজে ওকে পার হয়ে কেউ তার কাছে আসতে পারতনা ।  রোকনের স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভাল । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রোকন মনে করে রফিক সাহেব তার এলাকার মানুষকে প্রান দিয়ে ভালবাসেন এবং তাদের জন্যে কাজ করতে সদা প্রস্তুত । কিন্তু তিনি যে ব্যপারটাতে বিরক্ত হন তা বোধ হয় তার জানা নেই । যদিও তিনি অনেকবার এটা নিয়ে কথা বলেছেন । তবে কাজ হয়নি বোধ হয় । গত তিনমাসে তার কাছে প্রায়ই মামলা মোকদ্দমা নিয়ে তার গ্রাম বা পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ আসছে । এমনকি খুন করেছে এমন ও কেউ কেউ আসছে । এদের উপদ্রব দিনকে দিন বাড়ছে । রোকনের বিরুদ্ধে কঠোর কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় চলে এসেছে ।

 

রফিক সাহেব এই মুহূর্তে ছেলেটার সাথে ধৈর্য্যের খেলা খেলছেন । রফিক সাহেবের ধৈর্য্য ভালো তবে তিনি আবিষ্কার করলেন তিনি বলে ফেলেছেন , কী চাই? এটা কেন তিনি করলেন । নিজের এ কাজটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি । তার উচিত ছিল আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা।

 

স্যার আপনার পেপার পড়া শেষ হোক হেরপর বলি, ছেলেটা যতটা সম্ভব ভদ্রতা রেখে বলল । রফিক সাহেব  চোখের সামনে থেকে পত্রিকা সরিয়ে বললেন , পেপার পড়া শেষ বল । হঠাৎ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তিনি একটু অবাক হয়ে গেলেন । ছেলেটার মাঝে কেমন যেন পরিচিত পরিচিত একটা ছাপ আছে । ছেলেটার চেহারায় কিছু একটা আছে । কিছু একটা যা তিনি ধরতে পারছেননা । কেমন যেন একটা ব্যপার । তিনি sure তিনি ছেলেটাকে কোথাও দেখেননি তবে ছেলেটার মধ্যে কী যেন আছে । রফিক সাহেব তা কোনভাবেই ধরতে পারছেননা । কী হল তার ? ছেলেটা কী তার পরিচিত কেউ ? পরিচিত কাউকে তো তার চেনা উচিত । এমন তো খারাপ অবস্থা তার হয়নি । তিনি কিছু একটা ছেলেটার মাঝে দেখতে পেয়েছেন যা তার খুব চেনা কিন্তু তিনি ধরতে পারছেননা । কী হয়েছে তার ?

তিনি ছেলেটার প্রতি কিছুটা নরম হয়ে বললেন , বসো । ছেলেটা একটু অবাক হল । এরপর সে চেয়ারে বসল । রফিক সাহেব বেশ নরম গলায় বললেন , আমি আসলে খেয়াল করিনি যে তুমি দাড়িয়ে ছিলে । জবাবে ছেলেটা গ্রাম্য একটা হাসি দিল যার অর্থ এমন যে এটা কোন ব্যপার না । আপনি যে আমার দিকে তাকিয়েছেন তাতেই আমি খুশি ।

 

রফিক সাহেব রোকনকে ডাক দিয়ে চা দিতে বললেন । রফিক সাহেব বুঝতে পারছেননা কেন তিনি এই ছেলেটার প্রতি এত নরম হচ্ছেন বা এটা ঠিক হচ্ছে কিনা । তার শুধু মনে হচ্ছে তিনি কেমন যেন একটা  illusion মধ্যে আছেন । চা আসার পর তিনি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেন , কী নাম তোমার ? মজনু । তোমাকে কী আমি চিনি? , রফিক সাহেব বেশ শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন । না স্যার , আমার মায়ে আমারে আপনার কাছে পাঠাইছে । রফিক সাহেব একটু নড়ে বসলেন । ছেলেটা তার দিকে একটা রুমাল এগিয়ে দিল । রফিক সাহেব অবাক হয়ে গেলেন ।

ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন রফিক সাহেব মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন । কলেজে ভর্তি হবেন । তার ঢাকায় থাকা এক চাচা তাকে প্রায়ই ঢাকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন । ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র । মেট্রিকে সব সাব্জেক্টে স্টার মার্ক পাবে , ওকে গ্রামে রাখার কী দরকার ? শহরে ভালো একটা কলেজে পড়বে , পড়া শেষে একটা ভালো চাকরি করবে । রফিক সাহেবের তাতে খুব একটা আগ্রহ নেই । গ্রামেই তার সব বন্ধুবান্ধব । এখানেই সবকিছু । এসব ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার আগ্রহ তার নেই । তো বলা যায় তার জন্যে একরকমের ছুটি চলছে ।

 

তার ঘরটা ছিল দোতালায় । এক পাশে ছোট্ট একটা জানালা ছিল । একটা বড়ই গাছ ছিল । জানালা দিয়ে চাইলেই বড়ই পেড়ে খাওয়া যেত । কিন্তু রফিক সাহেবের পছন্দের ফলের মধ্যে বড়ই এর স্থান ছিলনা । টিনশেড ছিল তাই কেউ বড়ই পাড়লেই টিনে বিরক্তিকর একটা শব্দ হত ।

একদিনের কথা । তিনি দুপুরে ঘুমাচ্ছেন । সারা সকাল ফুটবল খেলে তিনি ক্লান্ত । দুপুরে খেয়েই তাই ঘুমিয়ে পড়েছেন । হঠাৎ টিনের চালে সেই বিরক্তিকর শব্দ । তার ঘুম ভেঙ্গে গেল । তিনি ভাবলেন তার ছোট বোনটা হয়ত এখন বড়ই পাড়ছে । খুব রাগ উঠে গেল । নিচে নেমে ধমক দিতে গেলেন । গিয়ে দেখেন । খুব দূরে একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে । মেয়েটা দাড়িয়ে দাড়িয়ে বড়ই খাচ্ছে । রফিক সাহেব আবিষ্কার করলেন মেয়েটাকে দেখে তার কেন যেন রাগ উধাও হয়ে গেছে ।  উলটো তার মধ্যে মেয়েটার জন্যে কেমন একটা অনুভুতি তৈরি হয়েছে । তিনি বুঝতে পারছেন না সে অনুভুতি কী । তিনি দূরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মেয়েটাকে দেখলেন । এক সময় মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হল । মেয়েটা চলে গেল।

এরপর রফিক সাহেব এক বিচিত্র জগতে হারিয়ে গেলেন । তিনি প্রায়ই দূর থেকে মেয়েটাকে দেখতেন । মেয়েটার সাথে প্রায়ই তার চোখাচোখি হত । মেয়েটা কিছু বলতোনা । চলে যেত । মেয়েটাকে না দেখে তিনি থাকতে পারতেনা । কিন্তু মেয়েটার সামনে যাওয়ার সাহস ও পেতেননা। মেয়েটাকে নিয়ে অদ্ভুত এক জগত  তৈরি করেছিলেন তিনি । সে জগতে তিনি মেয়েটাকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরতে যেতেন । অনেক কথা বলতেন । কিন্তু সামনা সামনি কোন কথা তখন ও হয়নি ।

এভাবে এক মাস কেটে গেল । রফিক সাহেবের রেজাল্ট দিয়ে দিল । পাচ সাব্জেক্টে স্টার মার্ক সহ তিনি ফার্স্ট ডিভিসন পেলেন । ঢাকা পাঠানোর জন্য জোড়াজুড়ি বেড়ে গেল । কিন্তু তার মাথায় যে ঢাকা নেই । তার মাথায় সেই নাম না জানা মেয়েটা যাকে তিনি শুধু দেখেই যাচ্ছেন । কিন্তু কথা হয়নি এমনকি নাম জানার ও চেষ্টা করেন নি । যদিও তিনি মেয়েটিকে একটি নাম দিয়েছেন – “স্বপ্না ” । তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েটার সামনে গিয়ে একদিন দাড়িয়ে তার মনের কথা খুলে বলবেন । ছোট একটা রুমালের মধ্যে তার গাছের কিছু বড়ই আর একটা চিঠি । খুব ছোট চিঠি :

“ স্বপ্না , আমি জানি এটা তোমার নাম না । এ নাম আমি ই তোমাকে দিয়েছি । অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে কিন্তু কিছুই গুছিয়ে লিখতে পারছিনা । শুধু একটা কথাই মাথায় আসছে । তা হল আমি তোমাকে ভালবাসি ।”

 

মেয়েটা তখন পুকুর ঘাটে বসে আনমনে পা দোলাচ্ছিল । তিনি পেছন থেকে হাল্কা গলা খাকারি দিতেই মেয়েটা সামনে তাকাল । তিনি মেয়েটার হাতে সে রুমালটা ধরিয়ে দিলেন । কিন্তু কেন যেন আর দাড়িয়ে থাকতে পারলেন না । দৌড়ে চলে গেলেন সে স্থান থেকে । এরপর পাচ ছয়দিন মেয়েটাকে তিনি খুজে পাননি । খুব অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গেলেন । কিছুই ভালো লাগছেনা । মেয়েটাকে খোজা শুরু করলেন । ছোট্ট গ্রাম । পেয়েও গেলেন মেয়েটার বাড়ি । বিয়ের সাজে সাজানো বাড়ি ।বাড়ির খুব কাছে গিয়ে জানতে পারলেন এই বাড়ির এক মেয়ের বিয়ে । মনটা কেমন যেন করে উঠল । একসময় জানতে পারলেন ওই মেয়েটারই বিয়ে । মেয়েটা লাল রঙের একটি শাড়ি পরেছে । খুব সুন্দর লাগছিল । রফিক সাহেব আর সেখানে থাকতে পারলেননা ।

এরপর রফিক সাহেব জীবনের প্রতি অভিমান নিয়ে ঢাকা চলে এলেন । কলেজে ভর্তি হলেন । ইন্টারমিডিয়েটে ভালো করলেন । ল’তে ভর্তি হলেন । কিন্তু কোনভাবেই মেয়েটার কথা ভুলতে পারেননি । ভার্সিটিতে থাকতে অনেক মেয়ের সাথেই প্রেম করার চেষ্টা করেছেন । কিন্তু কেন যেন তার ওই মেয়েটার কথা মনে পড়ে যেত । আর এগুতেন না । এমনকি আর কখন ও গ্রামেও ফিরে যাননি । আত্মীয় স্বজনের অনেক চেষ্টা করেছিল তাকে বিয়ে দেবার জন্যে । কিন্তু বিয়ে ও করতে পারেননি । একা একাই সারাটা জীবন পার করে দিয়েছেন । আজ প্রায় রিটায়ার্ডমেন্টে যাবার সময় হয়েছে । এতটা জীবন মেয়েটাকে যে মনে খুব মনে পড়েছে তা না – কিন্তু মেয়েটার স্থানে যেন কাউকেই বসাতে পারেননি ।

 

রফিক সাহেব কাপা কাপা কণ্ঠে বললেন , মজনু তোমার মা কেমন আছেন ? স্যার মা কিছুদিন আগে ইন্তেকাল করছেন । মারা যাবার আগে আমারে এইডা দিয়া বলছেন যেন আমি আপনাকে এটা পৌছাইয়া দেই । রফিক সাহেব খুব যত্ন সহকারে সেই রুমালের গিটটা খুললেন । ভেতরে একটা চিঠি আর কিছু বড়ই এর বিচি । তিনি দেখলেন তার সেই চিঠিটাই সেখানে আছে । পেছনে লেখা :

“খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি তুমি যেই সময়ে আইলা সেই সময়ে আমি তোমারে গ্রহন করতে পারলাম না । কেন তুমি আর কয়ডা দিন আগে আইলানা ? আমি ও তো তোমারে ভালবাসছিলাম মনে মনে । কিন্তু …”

 

মজনু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রফিক সাহেবের দিকে । চা নিয়ে রোকন ও চলে এসেছে । সে ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে । বড়সাহেবের মতন এমন মানুষ এভাবে কাদতে পারে তা সে জীবনেও কল্পনা করেনাই  । সে হা হয়ে তাকিয়ে আছে রফিক সাহেবের দিকে । জগতটা আসলেই অনেক অদ্ভুত  !

১,৭৫৮ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “একটা পাখি তিনটা পাখি চারটা পাখি”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন একটা হুমায়ূন আহমেদ- হুমায়ূন আহমেদ গন্ধ। তোমার নিজের একটা স্টাইল তৈরী করলে ভাল হয়। 😀

    লেখা চালিয়ে যাও।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. নাফিস (২০০৪-১০)

    হুমায়নীয় প্রভাব ছিল লেখাটা তে... আমি এটাকে ইতিবাচক ভাবেই দেখছি। তুমি হুমায়ুন আহমেদের লেখার স্টাইল বেশ ভালো ভাবেই ফলো করতে পেরেছ, তার মানে তোমার লেখার এবিলিটি অনেক ভালো। হাত খুলে লিখতে থাকো, দেখবে ধীরে ধীরে তোমার নিজের একটা স্টাইল হয়ে যাবে।
    শেষের ক্লিশে টা বাদ দিলে গল্প টা বেশ সুখপাঠ্য ছিল.. :clap: তোমার আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন
    • রাশেদ(২০০৫-২০১১)

      ধন্যবাদ ভাইয়া । আসলে শেষের অংশটুকুতে একটা জিনিস এক্সপেরিমেন্ট চালাতে চেয়েছিলাম।খুব ভালমতন হয়নি।আসলে আমি হুমায়ুন আহমেদ স্যারের বই অনেক পড়ি এজন্যে আমার লেখায় তার একটা প্রভাব চলে আসে মনে হয় । ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে চেষ্টা করব যাতে নিজের লেখার দক্ষতাকে আরো সম্বৃদ্ধ করার । দোয়া করবেন । 🙂

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নাফিস (২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।