আমি বাংলায় কথা কই

আমি জানি আজ আমি যে ব্যপারটা নিয়ে লিখব তা অনেক বিতর্কিত একটি বিষয় । তবে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এ ব্যপারটা নিয়ে কথা বলাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব । আমি এর আগে ও এ ব্যপারটা নিয়ে বেশ কিছু কাছের মানুষের সাথে কথা বলেছি । তবে আমি বিশ্বাস করি ব্যপারটি নিয়ে আরো বড় কোন space এ কথা বলা দরকার । আমি জানি আমার এই লেখাটা আপনাদের সময় উপোযোগী মনে নাও হতে পারে । ভাষা নিয়ে আমরা ফেব্রুয়ারিতে কথা বলি । বাকি মাসগুলো কি ভাষার জন্যে ?  যারা এ ব্যপারটি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তাদের কাছে আমার কিছু বলার নাই । তারা আমাদের মাতৃভাষাকে এক মাস ভালবাসেন । বাকি মাসগুলোতে ভাষাকে ভুলে যান ।

যাই হোক । তাদের কথা না হয় বাদ ই দিলাম । আমরা বাংলাদেশের নাগরিক । সুনাগরিক কী না সে ব্যপারে সন্দেহ পোষণ করা যায় । তবে এইটুকু বিশ্বাস করি যে এ দেশের আলো বাতাসে আমরা বেচে আছি । জন্মের পরই আমরা বাংলা ভাষায় মাকে ডেকেছি । আমাদের দুঃখের কথা , বেদনার কথা ,সুখের অনুভূতি , আনন্দের চিৎকার সব বাংলা ভাষাতেই দিয়েছি । কখন ও মনে পরেনা ব্যথা পাবার পর মাকে বলেছি , mom i have got pain . বরং বলেছি মা, ব্যথা করছে । আমাদের হৃদয়ের মাঝে বাংলা ভাষা গেথে আছে । সে এক অপূর্ব বন্ধন ।

ছয়টা বছর আমরা cadet college এ কাটিয়ে আসলাম । একটা বার ও কি আমাদের মাথায় এসেছে যে ক্যাডেট কলেজে আমাদের চোখের সামনে কী পরিমাণে আমাদের মুখের ভাষাকে অপমান করা হয়েছে বা করা হয় ? কী পরিমাণে আমাদের চোখের সামনে আমাদের ভাষাকে হেয় করা হয়েছে ? চোখে পড়েছে হয়তবা । ভাবলেও তা নিয়ে হয়ত মাথা ঘামাইনি । কলেজের প্রিন্সিপাল মাতৃভাষা দিবসে সবাইকে বাংলা ভাষাকে সম্মান  জানাতে বলেন আর সবাইকে alltime ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে বলেন । নিজেও সবার সাথে ইংরেজিতে কথা বলেন। তার সামনে বাংলা ভাষা উচ্চারন করলে যেমনভাবে তাকান মনে হয় বড় একটা পাপ ই বোধ হয় করে ফেলেছি । অনেক সম্মানিত শিক্ষকের কাছে ও এ ব্যপারটা দেখা যায় । একাডেমিক বিল্ডিং এর প্রতি কর্নারে সুন্দর করে লেখা থাকে “speak in english” . চিঠি লেখার সময় মনের ভাব প্রকাশ করতে হয় ইংরেজি ভাষায় । হ্যা, আমি জানি আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করবেন যে এগুলো ক্যাডেটদের ইংলিশ চর্চার জন্যে । তাদের কাছে আমার প্রশ্ন মানুষের মনের ভাব প্রকাশে ভাষা select করে দেবার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে ?  ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার । সে অধিকার একটা মানুষ জন্মানোর সাথে সাথেই পায় । কারো কোন অধিকার নেই সেখানে আঘাত হানার ।

আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে দেশের কিছু দামাল ছেলে (সালাম , রফিক , শফিক , জব্বার প্রমুখ) মাতৃভাষায় কথা বলার জন্যে রাজপথকে রঞ্জিত করেছিল । আমার বিশ্বাস তারা চেয়েছিল যাতে বাংলাদেশের মানুষ  মাকে মা ডাকতে পারে । বাংলা যেন এ দেশের মাতৃভাষা এবং প্রধাণ ভাষা হয় । সে সব আত্মত্যাগী দামাল ছেলেরা যদি আজকে দেখত যে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ইংরেজি ভাষায় মাকে চিঠি লিখতে হচ্ছে তাহলে আমার বিশ্বাস তারা নিজেদের আন্দোলনকে কোনদিন ই সফল বলে দাবি করতেন না । বরং সে আন্দোলন করার জন্যে অপমানিত বোধ করতেন । আমরা তাদের এ ত্যাগকে কতটুকু শ্রদ্ধা জানিয়েছি ? প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারিতে  শহীদ মিনারে ফুল দিলেই কি দায়িত্ব শেষ ?  একবার একটু নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করি । আমাদের চোখের সামনে এবং এখন ও কলেজে আমরা যাচ্ছে তাই ভাবে মাতৃভাষাকে অপমান করছি । আমি জানি এখানে  অনেকে point of order হিসেবে বলবে , দেখ , আসলে আমরা চাই ক্যাডেটরা ইংরেজি ভাষা চর্চা করুক । তাদেরকে আমার একটাই কথা , আমি বলিনি ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় কোন সমস্যা আছে । তবে তার অবস্থান কখোনোই মাতৃভাষাকে ছাড়িয়ে যাবেনা । মাতৃভাষার সম্মান সবসময় ই সব ভাষার উপরে ।

আসলে কী বলব । আমরা বাংলাদেশি মানুষগুলোই বোধ হয় এমন । নিজেদের সংস্কৃতিকে সম্মান দিচ্ছিনা বলে বিতর্ক করে যাচ্ছি । অথচ নিজের ভাষাকেই ভুলে যাচ্ছি । নিজের সংস্কৃতি , নিজের ভাষা , এগুলোকে সম্মান  দেয়াটা কী খুব বেশি অপমানের ? আরেকটা ভাষায় কথা বলাটা কী খুব বেশি অহংকারের ? খুব বেশি pride সেখানে ,তাইনা ? তাহলে কী দরকার ছিল সালাম , রফিকদের জীবন দেয়ার ? কী প্রয়োজন ছিল অকাতরে নিজেদের বিলিয়ে দেয়ার ? যে জাতি তাদের আত্বত্যাগকে সম্মান দিতে পারেনা , “speak in english ” লিখে রাখে,মাতৃভাষায় কথা বললে পাপ মনে করে এবং সে পাপ মোচন করার জন্যে দু একটা থাপ্পর দিতে ও দিধা বোধ করেন – কী দরকার তাদের জন্যে রাজপথকে রাঙানো  ? তাদের পরবর্তি প্রজম্নকে তো ইংরেজি ভাষায় পরিবারের সবাইকে চিঠি লিখতে হচ্ছে । সেদিন আমার বোন যখন আমাকে ইংলিশে চিঠি লিখল কেন জানি মনে হয়েছে বাংলা ভাষাটা বোধ হয় একদিন হারিয়ে যাবে ।  একবার বিবেক দিয়ে ভেবে দেখুন তো ব্যপারটা কী এই আত্বত্যাগি গোষ্ঠিকে অপমান করা নয়? ব্যপারটা কি নিজের ভাষাকে অপমান করা নয় ?

যারা চীনে বা থাইল্যান্ডে বা কোরিয়া গিয়েছেন তারা হয়ত সেখানে কোন দ্রব্যের উপর ইংরেজি ভাষার অস্তিত্ব খুজে পাননি বলে অনেক বিরম্বনার স্বীকার হয়েছেন । স্প্যানিশ , ফ্রেঞ্চদের সামনে তো একটা ইংলিশ শব্দ  উচ্চারন করলেই তারা তার অর্থ বুঝলেও বলবে “no comprendo”. অর্থাৎ আমি আপনার কথা কিছুই বুঝিনাই । নিজেদের ভাষাকে কিন্তু তারা ঠিক ই সম্মান করে যাচ্ছে যতই ইংলিশকে আন্তর্জাতিক ভাষা বলা হোক । তাদের এটুকু সম্মানবোধের  কারনে কিন্তু জাতিসংঘে তাদের ভাষাকে আলাদা ভাবে সম্মান দেয়া হয় । ইংলিশভাষিরা ও কিন্তু সেসব দেশে গেলে ওই ভাষাগুলো সম্পর্কে সম্মক ধারনা নিয়ে যায় । কই তাদের কী
কোন সমস্যা হচ্ছে ? তারা কি অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে  ।  বরং তারা কিন্তু বিশ্বে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে । একটা কথা আছে , আপনি যদি নিজেকে সম্মান দেন তবে আপনাকে ও মানুষ সম্মান দেবে । এটাই নিয়ম । আজ আমরা দেখিত আমাদের ভাষাকে কয়টা মানুষ সম্মান দিচ্ছে । আরে বাবা , আমরা নিজেরাই তো দিচ্ছিনা । বাকি মানুষগুলা দিবে কেন ? ওরা তো আমাদের চাকর না । আমরাই ওদের চাকর । ওদের চাকরামি করছি  নিজেদের অজান্তেই । সেটাকে সম্মান ও মনে করছি । নিজের ভাষাকে সারা বছর অপমান করছি আর ফেব্রুয়ারি মাসে এসে একটু লেখালেখি, ২১ শে ফেব্রুয়ারি বিশেষ আলোচোনা সভা  দিয়ে নিজের মাতৃভাষা প্রেম দেখিয়ে খালাস । “speak in english” লিখে রাখি , ইংলিশে চিঠি লিখতে বাধ্য করি , সবার সাথে ইংলিশে কথা বলতে বলি – আমদের  communication skill বাড়াতে হবেনা । আসলে লেখার সময় বড় আক্ষেপ হয় । কষ্ট হয় ।  ভাষা হারিয়ে ফেলি । আব্দুল হাকিমের মত খুব রাগ করে বলতে ইচ্ছে করে –

”যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী

সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ।”

আসলে আমি চাই আর কোন ক্যাডেট কে “speak in english, dream in english, write in english” যেন  শুনতে হয় । ব্যপারটা যেন অনুসরণ করতে না হয় । আমরা বাংলায় কথা কই । আমরা বাংলায় কথা কই । আমরা আমাদের আবেগে চিরদিন বাংলাকে খুজে পাই । সে বাংলাকে আকড়ে ধরে জীবনে বেচে থাকতে চাই । কেউ আমাদের ভাষাকে অপমান করতে পারবেনা । আমরা তা করতে দিবনা । সালাম , রফিকরা যেভাবে প্রতিবাদ করেছে আমরা সেভাবে প্রতিবাদ করব । কিন্তু বাংলাকে সম্মানহারা করতে দিবনা । নিজের শেষ বিন্দু রক্ত দিয়ে হলেও নিজের ভাষার সম্মান অক্ষুণ্ন রাখব । দেখুন । এ ভাষা আমাদের । এ ভাষার সম্মানহানি আমাদের ও সম্মানহানি । কেন আমরা সেটা হতে দেব ? এতদিন হয়েছে কিন্তু আর হবেনা । আমি বড় ভাইয়াদের অনুরোধ করব আপনারা দয়া করে ব্যবস্থা নিন । সবার কাছে অনুরোধ আমরা সবাই এগিয়ে এসে নিজেদের মাতৃভাষার সম্মান আবার ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করি । তখন আমরা সালাম , রফিকদের সেই আত্বত্যাগের মর্যাদা দিতে পারব ।  তাদের সামনে বলতে পারব যে ভাষার জন্যে আপনারা রক্ত দিয়েছেন তার যথাযোগ্য সম্মান আমরা রাখতে পেরেছি । নতুবা “speak in english, dream in english, write in english”  এর মাঝে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে একদিন নিজেদের অজান্তেই হারিয়ে ফেলব ।

১,০৯২ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “আমি বাংলায় কথা কই”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    তীব্র দ্বিমত পোষণ করছি।
    ক্যাডেট কলেজে বাংলায় কথা বলা কে নিরুৎসাহিত করা হয় না।
    পরে আলোচনা করবো এ বিষয়ে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    অন্য কলেজের কথা জানিনা। আমাদের সময় পর্যন্ত কখনো এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। স্পীক ইন ইংলিশ - একাডেমি ব্লক এ লিখা ছিলো বটে, তবে ফর্মাল অকেশন ছাড়া কখনো সেটার প্রয়োগ দেখিনি।
    সবমিলিয়ে, আমরা কলেজ লাইফে এমন কোন অবস্থার সম্মুখীন হইনি যখন মনে হয়েছে বাংলায় কথা বলাটা নিরুৎসাহিত কিংবা বিদ্বেষের চোখে দেখা হচ্ছে। ব্যাপারগুলো বেশিরভাগ সময়েই মনে হয় তৎকালীন প্রিন্সিপাল তথা এডমিনিস্ট্রেশনের উপর নির্ভরশীল। তোমাদের সময় এমন হয়ে থাকলে ব্যাপারটা সত্যিই দু:খজনক এবং এমন কিছু কখনোই কাম্য নয়।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আমাদের সময়ও এরকম কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় নি ।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • রাশেদ(২০০৫-২০১১)

      জি ভাইয়া আপনাদের সময় হয়ত ছিলনা । কিন্তু বর্তমানে এটা আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে । আজকাল পোলাপাইন ইংলিশে চিঠি লিখতেছে । ব্যপারটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগতেছে । আমি জানি ব্যপারটা অনেকে হয়ত দেখে ও দেখবনা । কিন্তু এটা কোন ভাল লক্ষণ না । আমি সবাইকে অনুরোধ করব ব্যপারটা নিয়ে একটু হলে ও ভাবার জন্যে । দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না ।

      জবাব দিন
  4. আসিফ মাহমুদ

    আমার মনে হয় এটাকে নেগেটিভলি নেয়ার কিছু নাই। ইংরেজী অনেক প্রয়োজনীয়,প্রফেশনাল লাইফ,হায়ার এডুকেশন এ এটার দরকার কি এটা বলে বুঝানোর প্রয়োজন পড়ে না।ক্যাডেট কলেজে বাংলা বানান প্রতিযোগিতাও হয়,তাই না?এমনকি সপ্তাহে একদিন বাংলা পাবলিক স্পিকিং ক্লাস ও হয় এবং অনেক বাংলা ভাষায় মঞ্ছ প্রতিযোগিতা হয়। তাছাড়া একজন ক্যাডেট ইংরেজীতে ভালো হবে এটা অনেকটা চিরন্তন সত্যের মতই। তারপরও চোখ,কান খোলা রেখে দেখ,কত ক্যাডেট এর ইংরেজীর কী বেহাল অবস্থা ! চীন,থাইল্যান্ড এর সাথে আমাদের তুলনা করলে হবে না,ওরা এখন নিজেরাই সব,আর আমাদের এখনও বাইরের সাহায্যের উপর ভরসা করতে হয়।যাই হোক,ভালোবাসার জন্য মন লাগে,অন্তরে সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে মেরে কেটেও তোমাকে কেউ সরাতে পারবে না তোমার অবস্থান থেকে। মুখে অনেক কিছু বললাম,আর ২১শে ফ্রেব্রুয়ারীর দেয়াল পত্রিকা বানানোর সময় ইংরেজী,হিন্দী গান শুনলাম,তাহলে আর সেই ভালোবাসার কি লাভ বল?? কিন্তু ঘটনা তো এরকমই,তাই না??


    ...একদিন সবকিছু মুছে যায় হিমেল হাওয়ায়, স্মৃতিমাত্র লিখে নাম...সেইখানে আমিও ছিলাম...

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।