হোয়ের হেভ অল দা ফ্লাওয়ারস্ গন ?

মেয়েটির নাম ধরা যাক লিজা। আমার দেখা রমণীদের মধ্যে একজন অনন্য অসাধারন ব্যত্তিত্ব।বয়স ত্রিশের কোঠায়, ছিপছিপে একহারা গঠন।জিন্স- টি শার্টে আরো অল্প বয়সি মনে হয়। জন্ম, বেড়ে উঠা দুটোই প্রাশ্চাত্যে হলেও বাঙালি বাবা মার কল্যানে পুরোপুরি বাঙালি। আমাকে ওর বাবার দিকের একমাত্র জীবিত আত্মীয়, -কাজিন হিসাবে ওর সমাজে, সকলের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে গর্ব বোধ করে।

এই পরিচয় দানের পেছনের ইতিহাসটা বেশ মজার।

ওর আর আমার বাবা আপন খালাতো দুই ভাই।সমবয়সী।জমিদার দাদার একমাত্র শ্যালিকার ছেলে হিসাবে ও আমাদের বাড়ীতেই মানুষ।পাকিস্তানের শুরুর দিকের কথা।দুজনই একসাথে পাঠশালা ,গ্রামের প্রাইমারি, হাই স্কুল শেষে এন্ট্রেন্স পরীক্ষা পাশ দেন।(তখন এস এস সি কে এন্ট্রেন্স বলা হত)।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাবা কোন রকম উৎরে গেলেও, খালাত ভাইএর রেজাল্ট এত ভাল হল যে, তৎকালীন ঢাকা জিলায় একটা হৈ চৈ পড়ে গেল।আগাগোড়া ব্রিলিয়ান্ট ভাই টিকে পড়াশুনার খরচ বা আর অন্য কোন কিছুর জন্যেই পেছনে ফিরে তাকাতে হল না।

নিজের গড়া রাস্তা আর সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উঠে যেতে লাগলেন উপরে।

কেজি টুতে সবে উঠেছি ।চর্ম চক্ষে একদিন অবাক বিস্ময়ে সেই কিংবদন্তীকে দেখার সৌভাগ্য হল।ছোট বেলা থেকে পড়াশুনা ফাঁকির প্রতিটি  উধাহরনে বাবা-মা’র মুখ থেকে শুনতে শুনতে  যার কথা প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডক্টোরেট করার জন্যে ‘ গ্লাসগো’ যাচ্ছেন। গ্লাসগোটা কোথায় জানিনা, তবে বাবার ব্যকুলতা থেকে চন্দ্র গ্রহের কাছাকাছি কোথাও হবে, ধরে নিলাম।

আমাকে অনেক অনেক দোয়া করে গেলেন। ওঁর চেয়েও যেন বড় হই।

এর পর অনেক মিশ্র কাহিনী শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। অর্থাৎ বয়স বেড়েছে,ওঁর ওই অর্থে ‘বড়’ হই নাই।

ডিগ্রির সাথে সাথে তিনি তৎকালিন বাঙালি এক উঠতি কোটি পতির বোনকে বিয়ে করে, ‘শ্বশুর বাড়ীর’ জামাই হিসাবেই নিজের এলাকায় নাম কিনেছেন। কিন্তু  একজন প্রফেশনাল বাঙালি হিসাবে, প্রকৃতই তার আন্তর্জাতিক মেধা ও খ্যাতি ছিল আকাশ চুম্বী।শেষ বয়সে সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করলেও, বিষয় ভিত্তিক লেকচার দেওয়ার জন্যে মাসে-দু মাসে তাকে এম,আই,টি বা আমেরিকার নামকরা শিক্ষা প্রতিস্ঠান আমন্ত্রন করতো।

ষাটের/সত্তরের দশকে বাংলা ছায়াছবির একটা প্রিয় ইমোশনাল সিকোয়েন্স থাকতোঃ সাধা সিধে অশিক্ষিত বাবা ব্যগ ভর্তি জিনিষ পত্র নিয়ে গ্রাম থেকে ছেলের শহরের বাসায় গেলে, বসার ঘড়ে হাই সোসাইটির বন্ধুদের কাছে ‘সারভেন্ট’ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। ইংরেজি না জানা বাবা ” সারভেন্ট” কথাটি খুব সম্মানের ধরে নিয়ে,মনে রেখে গ্রামে ফিরে মাষ্টার মশাই থেকে এর অর্থ শুনে নেন এবং ইমোশনাল একটি মেলো ড্রামার সৃষ্টি করেন।

এঁর ক্ষত্রে ও একই কাহিনী প্রচলিত আছে।

আমি তাঁর ব্যক্তিগত কাহিনী নিয়ে মোটেই আগ্রহি নই। তাঁকে নিয়ে কে কি বলেন,তাতে আমার কোনই আগ্রহ নেই, আমি ভাবছি অন্য কথা।

ওঁদের মত হাই প্রফাইল বঙ্গ সন্তানদের কথা।ফজলুর রহমান খান, যাদের “Father of tubular design for high-rises“, “Einstein of structural engineering” ,”Greatest Structural Engineer of the 20th Century” বলে অক্ষায়িত করা হয়।

ভাবছি ‘You Tube এর মালিক’, ‘Micro Soft এর অন্যতম রূপকার’, ‘এপ্যেচি হেলিকাপ্টার ডিজাইনার’ এবং আরো অসংখ্য বাংলার রত্ন- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রোগ্রামার, প্রফেসরদের মত সোনার সন্তানদের কথা।

আমাদের মত যে সব  অভিবাবকের সন্তানরা জমি জমা বেচা সঞ্চয়ের শেষ কাপর্দকটুকু নিঃশেষ করা লক্ষ ডলার খরচে বিদেশে, দেশের প্রাইভেট বিশ্ব বিদায়লয় গুলিতে পড়াশুনা করেছে, তাদের দ্বায়বোধ কি থাকা উচিৎ, -জানিনা।

কিন্তু  যারা ‘পাঁচ-সাত-দশ-বিশ’ টাকা বেতনে এই গরিব মায়ের ভর্তুকি দেয়া, অনুদানের, ভিক্ষার টাকায় পরিচালিত বিশ্ব বিদ্যালয় গুলি থেকে প্রায় বিনাপয়সায় শিক্ষীত হয়ে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে ধনীদেশে গুলিকে এবং নিজেকে উজ্জল করছেন, তাদের কথাই ভাবছি।

বন্যা-ঘূর্নি ঝড়ে চাঁদা তূলে কিছু টাকা পাঠানো আর আরাম সোফায় গা এলিয়ে, দেশের মন্দ ভাগ্য, জনগণের দুর্দশা নিয়ে চুক চুক করে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কি আর কোনই দ্বায়বোধ নেই সেই সব বিদেশে রয়ে যাওয়া শিক্ষিত বঙ্গ সন্তানদের ?

গ্রামের সহজ সরল গরীব বাবা-মা’কে ” সারভেন্ট” বলার মত মাতৃভূমি গরীব বিধায় ‘নিজের সুখে’ মশহুর হয়ে ডুবে থাকা নির্বোধ কি তারাও নয়? এই মেলোড্রামাটিক উপখ্যান থেকে কি আমরা  কখনই বেড়িয়ে আসবো না?

এ নিয়ে ভাবলে,দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একটা প্রিয় জার্মান গানের কলি শুধু কানে ভেসতে থাকেঃ Sag Mir wo die Blumen sind ? Wo sind sie gewesen??

যার ইংরেজি ভার্শনটাঃ

WHERE HAVE ALL THE FLOWERS GONE  by Pete Seeger
Where have all the flowers gone?
Long time passing
Where have all the flowers gone?
Long time ago
Where have all the flowers gone?
Girls have picked them every one
When will they ever learn?
When will they ever learn?

 

 

 

১,৩৭৩ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “হোয়ের হেভ অল দা ফ্লাওয়ারস্ গন ?”

    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      ওরে কচি, ওরে আমার কাঁচা,
      আধ মড়াদের ঘাঁ মেরে তুই বাঁচা !

      সময় এসেছে ভাবার। সরকারী নিয়মে দুর্বলতা আছে, থাক। বিবেক বলেতো একটা বোধ আছে, আমার, তোমার, শিক্ষিত সকলের।

      আমরা যারা সরকারী টাকায়, পঞ্চাশ লাখ টাকার জায়গায় পঞ্চাশ টাকায় ডাক্তারি- ইঞ্জিনিয়ারিং-বিশ্ব বিদ্যালয়ে লিখা পড়া শেষ করে দেশে- বিদেশে যে খানেই হোক প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। দেশে না এসে কোন ভু স্বর্গেই নাহয় লাল-নীল পাসপোর্টে বেঁচে বর্তে আছি।
      ছেড়ে আসা গরিব দেশের প্রতি দ্বায়বদ্ধতা থেকে আমরা কি, দুই- চার জন গরিব মেধাবি ছাত্র- ছাত্রী কেও পড়াতে পারি না?
      কোন N R B'র নামে কোন স্কলারশিপ বা এড্যুকেশন ফান্ড কি কোথাও আছে আমাদের এদেশে??
      উপরওয়ালার কথা নাই তুললাম, বিবেকের কাছে জবাদিহিতার একটা ব্যাপারোতো আছে!


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।