ভালবাসার মানুষ

এখন কত দিবস হয়েছে।ভালবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস। এসব আমাদের দিনগুলিতে ছিলনা। খুবই সাদা মাটা ছিল আমাদের দিনগুলি। প্রকৃতি হয়তো কিছু ‘সোনার মানুষ’ সৃষ্ট করে আমাদের সেই অভাব ঘুচিয়েছিল ।

ভদ্রলোকের সাথে প্রথম পরিচয় হয় ‘ চৈত্র সংক্রান্তির ‘ দিনে।আমার স্পষ্ট মনে আছে ।মনে থাকার কারনও আছে,বলছি।

১৯৮৮~৮৯ সালের দিকের কথা। অফিসে মন খারাপ করে বসে আছি। এই আধুনিক কালে চৈত্র মাস নিয়ে ব্যবসা জগতের এই ব্যাপারগুলি আর সহ্য হয়? চৈত্র মাসে নূতন করে কেও বিনিয়োগ করবেনা।পহেলা বৈশাখের ‘হাল খাতা’ খোলার জন্যে সব ব্যবসায়ী বসে আছে। ইউরোপে শিক্ষিত মানুষ আমি, এই মোঘল আমলীয় কায় কারবারে প্রচণ্ড বিরক্ত।

আর বিরক্ত হবোই না কেন? মোটেও টাকা নেই হাতে। আজই রাঙ্গামাটি টেক্সটাইল মিলের এলটম্যান্টের টাকা জমা  দেয়ার শেষ দিন।এতগুলি টাকা এই পোড়া মাসে জোগাড় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। হাল ছেড়ে বসে আছি। স্টাফদের উপর খামাখাই হম্বি তম্বি করছি। আসলে নিজের উপরই রেগে আছি। আমিই ছাই কি করে জানবো, এই মাসে নগদ টাকার এত অভাব হয়?

এক নাগাড়ে টেলিফোন বেজে চলছে। তোলার ইচ্ছা না থাকলেও অফিসতো, রিসিভ করতেই হয়। ওপার থেকে কলকাতার শুদ্ধ বাংলায় ” কিরে পাগলা কি করছিস”? -তোর গুষ্ঠির পিণ্ডি দিচ্ছি! নিকুচি করছি তোদের ‘ চৈত্র সংক্রান্তির ‘! শালা এই সব বানায়ে তোর ঠাকুর ‘দা রা মার্ডার করছে ব্যবসা-বাণিজ্যের।টাকা নাই, টাকার অভাবে বইসা বইসা আঙ্গুল চুষতেছি !

কত টাকার অভাব?

– কেন তুই দিবি?  অনেক টাকার,পনের/ষোল লাখ! বুঝলো মেজাজ আমার তিরিক্ষ হয়ে আছে। কথা না বাড়িয়ে বললো।ঘণ্টা খানেক পরে ফোন করবো, চলে আসিস আমার বড় বোনের বাসায়।তোর অফিস থেকে হাটা পথ।

একদম ছোট বেলার বন্ধু।ডাক নাম ধরা যাক লাট্টু বাবু। পঁচাত্তরের শেখ সাহেবের পট পরিবর্তনের পর, স্বাভাবিক ভাবেই সব গুটিয়ে পড়াশুনার জন্যে কোলকাতায় চলে যায়। ফিরেআসে আশির দশকের শেষ দিকে। পুরোপুরি শুদ্ধ ভাষার ‘আকাশবাণীর বেতার’ হয়ে।

আফিসের ঝামেলায় যখন ভুলেই বসে আছি,তখন আবার ফোন ” দাদা আর আমি ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছি, শিগগির চোলে আয়”।

সেবারই প্রথম ওর ভগ্নি পতির সাথে পরিচয় হল। একদম ‘আন ইম্প্রেসিভ’ ছোট খাট মানুষ, খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ঠাঁসা গাল। সম্ভবত এক পা ছোট। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে।আমাদের চেয়ে বয়স বড় জোর পাঁচ-ছয় বছরের বড় । কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে যেটা সব চেয়ে ভাল লাগলো, সে হল ওঁর অন্তরঙ্গ হাসি দিয়ে সম্ভাষণঃ আয়, ভিতরে আয়, চল্ খেয়ে নিই! প্রথম পরিচয়ে একেবারে ‘তুই’ করে শুনতে অভ্যস্ত নই বলে ব্যপারটা অন্য রকম লাগল।

খাবার শেষে আয়েস করে সিগারেট ধরিয়েছি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিস্ময় অপেক্ষা করছিল বুঝি সেই ক্ষনে। ভদ্রলোক  খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটা চটের বস্তা এনে আমার হাতে দিয়ে বলেঃ নে এখানে ষোল আছে, চলবে? না বেশি লাগবে??

আমি বুঝতে না পেরে অবাক বিস্ময়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করলামঃ কি আছে দাদা? উনি বললেন, কেন লাট্টু না বললো তোর খুব টাকার প্রয়োজন? যা নিইয়ে যা, কাজ সার।

আমি আক্ষরিক অর্থেই হা করে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।নিজের আপন ভগ্নিপতি হলেওতো প্রশ্ন করতেন, এতগুলি টাকা কি কাজে লাগবে বা কখন ফেরত দিবে? ভদ্রলোক একটা প্রশ্ন না করে এতগুলি টাকা দিয়ে দিলেন, যাকে আগে কখনো দেখেনোনি ? এমন আশ্চর্য মানুষও আছে পৃথিবীতে?

সেই শুরু। ওঁর স্নেহের বাঁধনে বাঁধা পরে গেলাম চির জীবনের জন্যে। এর পর কত দিন, কত সময় একসাথে কাটিয়েছি।

চুপচাপ মানুষ।কথা বলার চেয়ে শুনতেই বেশি পছন্দ করতেন। সকাল থেকে রাত অব্দি অল্প অল্প মদ্য পান করে যেতেন।তবে দিনের বেলা নেশা হতে দেখিনি। নেশা বাড়তে থাকত রাত যত গভির হত তত।

নেশা বাড়লে অনেক কথা বলতেন, যেটা হয়তো কখনই স্বাভাবিক সময়ে বলতে সমর্থ হতেন না।এম বি বি এস এর শেষ বর্ষের শেষ প্রফেশনাল পরিক্ষাটা বাকি ছিল।পাশ করলেই ডাক্তার।কিন্তু সরকার ‘রাস টিকিট’ করায় আর ডাক্তার হওয়া হয়ে উঠেনি।

সেটা ছিল স্বাধীনতার ঠিক পরের মাতাল দিন গুলির একটা। কলেজ প্রশাসনের সাথে কি একটা ঝামেলায়, অধ্যক্ষের শোবার ঘরের লক্ষ্য করে ছুড়ে মারা গ্রেনেড ভুল কক্ষে পরলে, তার ঘুমন্ত মেয়ে দুইটি মারা যায়। এর অনেক বছর পরে ওঁর নিজের যখন ফুটফুটে দুইটি মেয়ে জন্মে, পুনর্জন্ম বিশ্বাসী দাদা ভাবতে শুরু করেন এ দুটি সেই দুই মেয়ে!

গ্রেনেড চার্জের সাথে নিজের সম্পৃক্ততার কথা যদিও কখনো স্বীকার করেননি, কিন্তু সাত-আট বছর বয়সী কন্যা শিশু দুটির দিকে তার ভীত দৃষ্টিই অনেক না বলা প্রশ্নের উত্তর দিতো ।

একানব্বই এর এক গভীর রাত। লাট্টু আর আমি বিছানার দুই পার্শে বসে আছি মূর্তির মত। দাদা শুয়ে আছেন।হার্ট বিট, পালস তখনো চলছে। লিভের সিরোসিস এ প্রস্তুতী নিচ্ছেন অন্তিম যাত্রার।

বছর তিন-চারেক এর মাত্র পরিচয়, মনে পরে যাচ্ছিলো ওঁর সাথের প্রতিটি ঘটনাবাহুল দিন। “সোনার মানুষ দিবস” কেও এখনো সৃষ্টি করেনি।কিন্তু ক্ষণজন্মা ‘সোনার মানুষ’ সৃষ্টি করে জগতের রুপ-লাবন্য বৃদ্ধির দায়িত্ব নিশ্চিতভাবে প্রকৃতি নিজের হাতে সংরক্ষণ করেন! আর তাদের স্নেহধন্যরা ভ্যালেন্টাইন দিবসে খুজে ফিরে তাদের “ভালবাসার মানুষ”!

 

 

 

১,৪২৩ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “ভালবাসার মানুষ”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    সম্ভবত এটা প্রফেসর জোহার কাহিনী, সোনার ছেলেদের ছুঁড়ে মারা গ্রেনেডে তাঁর ফুটফুটে দুই মেয়ে মারা যান। আমার খুব জানতে ইচ্ছা হত কে এই কাজ করল, সেই মানুষটি আসলে কেমন??

    এই মানুষগুলা বেঁচে থাকে, অন্যের ভালবাসা পায়, এই মানুষগুলারও ফুটফুটে মেয়ে হয়। এই মানুষ গুলা আনন্দ করে মদ খায়। অন্যের শ্রদ্ধা পায়। কেন?? কেন? আমি ঘৃণা করি মিথ্যে ভরা আমার জীবনকে। ছোটকাল থেকে শিখে আসা, 'সত্যের জয় হবে, অপরাধীরা বিচার পাবে'...এসব মিথ্যে কেন আমাদের শেখানো হয়?

    আজিজ ভাই, আমি হয়ত আপনার পছন্দের মানুষকে নিয়ে বেশিই কটু কথা বলে ফেললাম, দুঃখ প্রকাশ করছি না। এই মানুষগুলো শ্রদ্ধা ভালবাসা পাবার যোগ্য না।

    জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      সামিয়া,
      ভদ্রলোক নিজে সম্পৃক্ত ছিল, কখনই বলেননি। আর তার সাথে আমার পরিচয় ৮৮/৮৯ এ । যদি সে ৭২-৭৩ এর ঐ দুঃখজনক ঘটনার সাথে সরাসরি জরিতই থাকতেন, নিশ্চয়ই আইন তাকে ছেড়ে দিতো না। তবে যেহেতু সে হিন্দু ধর্ম মত বিশ্বাস করতেন, পুনর্জন্মের ধারনা মনে পোষন করতে পারেন ।
      অবশ্য সন্দেহের ভাবনা অমূলক নয়, আসতেই পারে। তবে আমি তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ হিসাবে পেয়েছি।তাই আমি যতটুকু দেখেছি, তার নিরিখেই মূল্যায়ন করেছি।


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন
      • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

        @ সামিয়া,

        এটাও নিশ্চয় পড়েছো, "পাপ কে ঘৃনা কর, পাপীকে নয়" ।

        মানুষের অনেক ভুল করে, গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে, সে অনুতপ্ত কিনা? ভুলের পুনারাবৃত্তি হচ্ছে কিনা? প্রাপ্য শাস্তি পাচ্ছে কিনা?

        জীবন অনেক জটিল।


        পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

        জবাব দিন
        • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

          ওর যদি ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা থেকেও থাকে, আমার ধারনা "Life has taken the Toll out of him"...... মদ্যপান, সিরোসিসে জীবনাবসান, সর্বোপরি কন্যা সন্তান ও পুনর্জন্ম বিশ্বাস তাকে নিশ্চয় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে।

          বিবেকের দংশন নিশ্চয়ই তাকে তার শেষ বছর গুলিকে "অন্য মানুষে" রূপান্তরিত করেছিল। যে সময় কালে আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল।
          আর প্রায়শ্চিত্তের প্রশ্নই যদি আসে তাহলে সে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিশ্চয়ই প্রায়শ্চিত্ত করে গেছেন। তাই শেষ বছরগুলিতে তাকে পেয়েছি আগুনে পোড়া এক শত ভাগ খাটি সোনায়। (সম্পাদিত)


          Smile n live, help let others do!

          জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    sundসুন্দর লেখা আজিজ ভাই।
    কীণ্টূ কথা কি ইয়াহিয়াও তার সন্তান্দের আদর করে। গো আজম দেশবিরোধী হলেও তার ইমামতিতে লোকজন নামায পড়ে। দুনিয়াটা বিচিত্র বটে।
    সত্তি জানিনা তাই সামিয়ার মত মন্তব্য করবোনা।
    তবে যারা ডাক্তারি পড়ে বা ডাক্তার হয় তাদের রাজনীতি করাটা আমার চোখে নীতিবিরুদ্ধ।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামিয়া (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।