সৃষ্টিকর্তার কোন অবদানকে তোমরা অস্বীকার করবে?

আজ  ৯ই জিলহজ্জ ।পবিত্র ‘অকুফে আরাফাত’ বা আরাফাতের অবস্থানের দিন।সৌদি আরবের আরাফাতের প্রান্তরে আজ যারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে যে কোন সময় অবস্থান করবেন, তাদের আল্লাহ চাহেত পবিত্র হজ্জ পালন করা হয়ে যাবে।

আজকে দিনটাকে বেশি করে মনে পড়ছে এই জন্যে যে, আমার বাবার জিব্দশায় বহুবার হজ্জ পালন করেছিলেন এবং দিনটাকে অসামান্য গুরুত্ব দিয়ে সারা সময় টেলিভিশনে সামনে বসে থেকে হলেও ‘আরাফাতে’ সামিল হতেন।ওঁর হিসেব অনুযায়ী (চাঁদের হিসাবে) এবার হজ্জ  ‘শুক্র বার’ হওয়ার সম্ভবনা বেশি। প্রচলিত ধারনা, শুক্রবারের হজ্জকে ‘ হজ্জে আকবরী ‘ বলা হয়, এবং এই দিনের মহাত্বে, সত্তর গুন বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়।

‘এই হিসেব’ ওঁর জীবনে বেশ কয়েকবারই ফলেছে এবং বেশ কয়েকবার ‘হজ্জে আকবরী’ পেয়েছেন।আমাদের সকলকে বলে গিয়েছিলেন, যদি হজ্জের নিয়ত থাকে, যেন এবার চেষ্টা করি।অল্পের জন্যে ওঁর এবারের কেল্কুলেশন স্লিপ করে ‘শনিবার’ পড়ল হজ্জের দিন। আর আমারও সেই ১৯৯৫ এ ফরজ হজ্জ পালনের পর, আর যাওয়ার সময় ও সুযোগ হলনা।

আসলে ‘হজ্জ’ এর সাথে অন্য যে কোন বিদেশ ভ্রমনের অনেক প্রকৃতিগত পার্থক্য আছে।’আল্লাহের ঘরের’ মেহমান হওয়ার জন্যে নাকি একমাত্র তাঁরই দাওয়াতের প্রয়োজন হয়।ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর ঘড় তৈয়ারির নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহকে জিজ্ঞাশ করলেন, এই বিরান মরুতে কে আসবে তোমার ঘড় জিয়ারত করতে? আল্লাহতালা ইব্রাহিম (আঃ)কে আযান দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। যে সকল আত্মা এই আজানের ধ্বনি শুনেছেন, জীবনে একবার তাদের নাকি ছুটে আসতেই হবে ওই মরু প্রন্তরে ।

ব্যাপারটার সত্য-মিথ্যা প্রমান করার মত ধর্মীয় জ্ঞান বা আমল (কর্ম) কোনটাই আমার নেই। শুধু আমার চোখের সামনে বা আমার/বাবার জিবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার কোন “লজিক্যাল এক্সপ্লানেশন” অনেক চেষ্টায়ও আমি খুজে পাই নাই, তাই নিচে পাঠকদের বিবেচনার জন্যে উল্লেখ করছি।

১।বাবাদের প্রথম দিককার ১৯৬৭/৬৮ সনে হজ্জে যাওয়ার মাধ্যম ছিল চাট গাঁ থেকে জাহাজে করাচী হয়ে জেদ্দাহ। ” সফিনা এ আরব ” জাহাজ এক নম্বর জেটি থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ধু ধু মনে পরে।যাইহোক, সেই বার বাবাদের সাথে ‘করাচী চেম্বার অব কমার্স’ এর সভাপতি, ততকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিশাল এক কেউকেটা, ওঁদের সাথে হজ্জের উদ্দেশ্যে একই জাহাজে সামিল হয়েছেন।জেদ্দা পোঁছেই দেখলেন ওর নামে জরুরি Telex অপেক্ষা করছে, অত্যন্ত জরুরি ব্যবসায়িক কাজে অবিলম্বে করাচী ফিরে যেতে হবে। হজ্জের আরো মাস দেড়েক সময় ছিল, তিনি সকলের কাছে বিদায় নিয়ে  Flight এ return ticket  করে করাচী যাত্রা করলেন, এবং প্লেনেই হার্ট এটাক করে মৃত্যু বরন করেন।

২।আমরা যাচ্ছিলাম বাংলাদেশ বিমানের একটা  Flightএ। আশ্চর্যের ব্যাপার Flight একদম অন টাইম। আমরা বেজায় খুশী।অতি উৎসাহীরা ক্ষণে ক্ষণে  “লাব্বায়েক” ধ্বনি দিচ্ছি। কিন্ত প্লেনে আরোহণের ৩০/৪০ মিনিটের পরেও প্লেনের দরোজা বন্ধও করছে না, উড়ার ও কোন লক্ষণ নেই। ক্রমে সকলে বিরক্ত হয়ে আসল ঘটনা কি জানার চেষ্টা করছে।আমরাও পরে  Delay র প্রকৃত কারন নিজের চোখেই দেখলাম। একজন বৃদ্ধ, সম্ভবত গ্রাম থেকে আসা সহজ সরল কৃষক শ্রেণীর মানুষ হবেন। ওঁকে কিছুতেই প্লেনে উঠানো যাচ্ছে না। প্লেনের সিঁড়ি দিয়ে চারজন চ্যাঙ দোলা করে অর্ধেক উঠালে আবার ছেঁচরিয়ে ট্যাঁরমাকে নেমে যায়। এই টানা হিঁচড়া চললো আধা ঘণ্টা খানেক। বৃদ্ধ সম্ভবত প্রচণ্ড ভয় পেয়েছেন, অফিসিয়ালি সে তার ‘পুত’কে না দেখে সে কিছুতেই যাবেনা। শেষ ওই বৃদ্ধকে  off load করেই আমাদের যাত্রা শুরু হল।

৩। আমি যখন অনেক ছোট, বিশেষ করে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়  নানা বাড়ি অনেক দিন ছিলাম। নানাকে আনেক কাছে থেক দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।ওঁর পাশে শুয়ে প্রতি ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যেতো ওর আকুল কান্নায়।”ইয়া মাবুদ, তুঁই আমাকে এত সম্পদ শালী করিস নি যে তোঁর ঘড় জিয়ারতে যেতে পারি, কিন্তু আমার আর্জি, আমাকে হজ্জ না করিয়ে তুঁই জান কবজ করিস না।”

প্রতিদিন শুনতাম নানা ভাইএর এই কান্না, আর দৃঢ় সংকল্প করতাম, যদি আমার বড় হওয়া পর্যন্ত ওঁকে আল্লাহ হায়াত দেন, তাহলে ইনশাল্লাহ আমি ওঁর হজ্জে যাওয়ার পথ খরচের বেবস্থা করবো। একটি একটি করে বছর কেটে যায়। পড়াশুনা শেষ করে রুজি রোজগারের রাস্তায় ঢুকি। নানাও ক্রমে বুড়ো হতে থাকে।প্রতি হজ্জের মওসুমেই মনের গহীনে ছোট্ট বেলার লালিত সেই সাধ কাঁটা দিয়ে উঠে। হয়ত এসাধ উপরওয়ালা অপূর্ণই রেখে দিবেন। কখন আর যথেষ্ট টাকা উপা্র্জন করবো যে নানাকে হজ্জে পাঠাতে পারবো?

১৯৮৮ সাল। খবর পেলাম নানার শরীর বেশ ভেঙ্গে পড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগের বার টাকা বেতনের ‘হার ম্যজিস্টি রয়াল পোস্টাল সার্ভিসে’ চাকুরী ঢুকা সেই টকবকে যুবকের এখন ভগ্ন দশা।দাড়াতেও বেশ কষ্ট হয়।শুনে উপরওয়ালার কাছে আমার নিরব কান্না। কেন আমাকে কিছু বাড়তি টাকার বেবস্তা করে দেন না, যাতে এই বৃদ্ধর আজিবন লালায়িত সাধ আমি পূর্ণ করতে পারি?

রোজার ইদের পর  উপরওয়ালা এক উসিলায় লাখ পাঁচেক টাকা অপ্রত্যাশিত ভাবে বেশি লাভ দেয়ায় সিদ্ধান্ত নিলাম, এই টাকাটা মা, বাবা ও নানা ভাইর হজ্জের জন্যে ব্যবহার করব। তখন এক লাখ টাকায় ভাল ভাবে হজ্জ উজ্জাপন করা সম্ভব হতো।

খবরটা ওঁর কাছে মৃত সঞ্জীবনীর মত কাজ হল। বিছানায় শায়িত বৃদ্ধ যেন নব জীবন পেলেন। মহা উৎসাহে অতি জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট তৈয়ার হল,সব ফরমালিটিজ ও সম্পাদিত হোল। ঢাকা বিমানবন্দরে আমিতো ওঁকে দেখে অবাক! হাড় সর্বস্ব পাতলা খট খটে এক যুবক দৃঢ় পায়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধড়লেন।

আল্লাহর অসীম কৃপায়  সুস্থ সবল অবস্থায় ওঁ হজ্জ শেষে দেশেও ফিরলেন। ঐটাই আমার সাথে ওঁর শেষ দেখা। দুই মাস পরেই পরিতৃপ্ত,শান্তিতে ওঁ দেহ রাখলেন।

সৃষ্টিকর্তার কোন অবদানকে তোমরা অস্বীকার করবে? (সুরা আর রহমান)

আমারও জিবন থেকে নেয়া ও সকল সময়ের এক বড় প্রশ্ন।

 

২,৮৩৬ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “সৃষ্টিকর্তার কোন অবদানকে তোমরা অস্বীকার করবে?”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লাগল ভাইয়া আপনার স্মৃতিচারন :boss:

    ইবরাহিম (আ) এর ঘটনা শুনে একটা প্রশ্ন এসেছে, আমার হজ্জ করার সৌভাগ্য হবে কিনা সেটা কি আগে থেকেই নির্ধারিত? আমার আত্মা ঐ আজান শুনেছিল কিনা কে জানে!!!


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      ভাই, তুমি জান না, নিজের অজান্তে একটা বিশাল প্রশ্নের জন্ম দিয়েছ।শুধু হজ্জ নয়, "আমাদের সবই কি আগে থেকেই নির্ধারিত?"
      ব্যাপারটা নিয়ে যুগ যুগ ধরে ব্যপক বিতর্ক চলে আসছে। সে সবের মধ্যে না গিয়ে, আমার ধারনা টা শুধু তোমাকে লিখতে পারি: (Please dont quote):
      আমার ধারনা , আমরা যেমন ঘুড়ী উড়াই, লাটাই আমাদের হাতে থাকে, সূতা ছেড়ে ঘুড়ীকে যত টুকু ইচ্ছা উপরে উঠতে দেই। ডানে-বামে চলার, গুত্তা খাওয়ার স্বাধীনতা ঘুড়ীর নিজেরই থাকে, ঠিক সেই ভাবে আল্লহ তাআলা/ সৃষ্টি কর্তা আমাদের ছেড়ে দেন।লাটাই এর কন্ট্রোল নিজের কাছে রেখে। ডানে যাব না বায়ে, ভাল না খারাপ জীবন যাপন বেছে নিবো এসবের স্বাধীনতা আমাদের হাতে ছেড়ে দেন। না হলে আমাদের "বিবেক" জিনিসটার সৃষ্টির আদৌ প্রয়োজনই হতোনা ওঁর !
      আর হজ্জের ব্যাপারটা ভিন্ন। তোমার বাড়িতে তুমি কাকে দাওয়াতের জন্যে মনোনীত করবে, এটা তো শুধু তুমিই নির্ধারণ করবে তাইনা? - আল্লাহ তোমাকে সৎ কাজের এবং নিয়তের সহযোগিতা করুন, এই কামনা করি।


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন
      • আন্দালিব (৯৬-০২)

        ভাই, আপনার উদাহরণে একটা ভুল আছে। ঘুড়ির নিজের আদৌ কোন ক্ষমতা নেই। ঘুড়ির ওড়ার পথ নির্ধারিত হয় বায়ুপ্রবাহের কারণে। বায়ুপ্রবাহ ঘটে পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে। আর পৃথিবীর আহ্নিক গতি এসেছে মাধ্যাকর্ষণ থেকে। আর মানুষের মতো চিন্তা করার ক্ষমতা অন্য কোন প্রাণীরই নেই - ঘুড়ি তো কোন ছার!

        ফ্রি উইল নিয়ে সবচেয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারে বিজ্ঞান। একটা সময় পর্যন্ত নিউটনের গতিসূত্রকে ধ্রুব মানা হতো, যা বলতো যে প্রতিটি ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া নির্দিষ্ট, সমান, বিপরীত। এই ধারণা বাতিল হয়ে গেছে কোয়ান্টাম তত্ত্বের আবিষ্কারের পর। এখন একটি কণার অবস্থানও নির্দিষ্ট নয়, যে জায়গাকে আমরা শূন্য বলে মনে করতাম, সেখানেও ভরহীন কণার উপস্থিতি জানা গেছে। এমনকি আমরা আয়নায় যে চেহারা দেখি, তা পুরোপুরি আমার বর্তমান ছবি না, তা মূলত আমার অতীতের ছবি। আর একারণেই বলা যায় যে মানুষের সকল ক্রিয়া অনির্দিষ্ট। তা নির্ভর করে তার নিজের ইচ্ছার উপর, যে ইচ্ছা সম্পূর্ণই তার।

        জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।