ফিরে আসা-৩।

নাই, কোথাও নেই। একদম ছোট বেলায়, যখন আঙ্গুল ধরে হাঁটতে শিখেছিলাম, নরম শাড়ির আঁচল, বোরখার জর্জেট কাপড় কূট কূট করে কাটতে শিখলাম, তখন থেকে আজ অব্দি সব সময়ের জন্যে সাথেই তো ছিল। সুখের সময় , দুঃখের সময় , বিপদের সময় , সাফল্যের সময় – কখন ছিলনা সাথে ? সুদূর জার্মানিতে হলুদ বাতির নিচে, যখন ভার্সিটি শেষে কাজ, কাজের শেষে একাকী ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরতাম।তখনো আমার একমাত্র সঙ্গিনী মা। সর্ব সাকুল্যে একটাই বাংলা ক্যাসেট পাঠিয়েছিলেন  এক পার্শে পাপিয়ার ‘ নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম… বন্ধুর কাছে মনের কথা কেমনে বুঝাইতাম’। বন্ধু বলতেতো মা’ ই ছিলেন।

কত অসাধ্য কাজ ওঁ পাশে আছে যেনে হাসি মুখে অবলীলায় করে ফেলাছি। এইত সেদিন ক্রমাগত বার-তের দিন মহা দুর্যোগের মধ্যে গৃহ বন্ধি। মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা। বন্ধু মিলন কে ফোন করলাম ঃ দোস্ত ভাত-ডাল খাওয়া হয়না অনেক দিন। চল্ আপার ওখান থেকে খেয়ে আসি। মিলনের আপা থাকেন ‘ Osnabruck ‘। আমাদের Paderborn থেকে প্রায় আশী কিলোমিটার এর মত দূর।দূরত্বটা কোন ব্যাপার নয়, শ্যৈত প্রবাহ, তুষার ঝড়ে গাড়ী চালানোই সমস্যা । মিলন আমার পাগলামি জানতো। এও জানতো, ও না গেলে আমি একাই রওনা দিব।

দশ মিনিটে রেডি হয়ে মিলনকে তুলে নিলাম। পথে বেড়িয়ে সত্যিই ভুল করেছি বুঝতে পারলাম। রাস্তায় হাঁটু অব্দি তুষার, ঝড় আর বড় বড় তুলোর বলের মত তুষার ঢেকে দিচ্ছে  Wind Shield এ বেচারা Wiper দ্বয় অসহায়ের মত এদিক সেদিক করছে। একাগ্র চিত্তে ধিরে ধিরে গাড়ী চালাচ্ছি। আড় চোখে পার্শে বসা হাল্কা বাদামি রঙের জামদানী পরা মাকে দেখছি। মিলন নেই, মাই পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে গাড়ী চালাতে সাহায্য করছেন। ওঁর জামদানীর সবুজ ‘মোটিফ গুলি’ নিখুঁত ভাবে দেখতে পারছি।

আরেকদিন একিই অবস্তায়, না এর চেয়ে অনেক খারাপ অবস্তায় গাড়ীতে মা বসে থেকে আমাকে উদ্ধারে সাহায্য করতে দেখেছি।জানিনা এর মাঝে সবাই আমাকে পাগল ভাবতে শুরু করেছে কিনা।

31 সে December,  New Years Eve এর পার্টি শেষে ফিরছি  Untersberg এর সুউচ্চ শৃঙ্গ  Berchtesgadener Hochthron থাকে। ৬,৪৭০ ফিট উঁচু শৃঙ্গ।Austrian Alps, Salzburg এর প্রশিদ্ধ  Hitler এর সেই Eagle’s Nest।একবার ভাবলাম, ক্যাবল কারে Salzburg এসে রাত কাটিয়ে, পরের দিন আবার এসে গাড়ী নিয়ে রওনা দিলেই হবে! কিন্তু নানা মুনির নানান মত। একবারেই রওনা হয়ে সকালে জার্মান বর্ডারে পৌছার সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে জীবন সংশয়ের কারন হয়ে যাবে, কেও ভাবিনি।

পর্বতের কোলে খাঁজ কাটা রাস্তা তার উপর ২৪/২৫ সেন্টি মিটার তুষারে ঢাকা ।রাস্তা শেষ আর পাহাড়ের খাঁদ শুরু তুষারের চাদরের জন্যে বুঝার উপায় নেই। ধিরে ধিরে গাড়ী নীচে নামছে।শহর থেকে সম্ভবত শেষ বাসটা  Berchtesgaden এর দিকে যাচ্ছে।ড্রাইভার দ্বয় আসলে কেও কাউকেই এই সময় আশা করেনি! হঠাৎ U turn এ সামনে এত বড় বাস দেখে হয়ত  reflex action  এ আমাদের গাড়ী ডানে বেশি সরে যায়, ফলশ্রুতিতে ডানের সামনে পেছনের দুটি চাকাই তুষারে উঁচু হয়ে থাকা রাস্তার চেয়ে দেড়/ দুই ফিট বর্ধিত অংশে পরে off balanced হয়ে পরে।এবং আমরা  slide করে বেশ কয়েক গজ নেমে যাই।

দোয়া-দরুদ পড়ার কথা মনে হতে হতেই, পাশের সিটে মাকে দেখি বসে হাত ধরে আছেন। Slide এর গতি বাড়ার আগেই, দুই/তিনটা সম্ভবত উইলো গাছের সাথে আটকে গাড়ী দাড়িয়ে পরে।কিন্তু সামান্য নড়া চড়ায়ও মড়মড় করে আর্তনাধ করে উঠতে থাকে। আমাদের নিস্থব্ধ, নিথর বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই। গাছের এই ঠুনকো অবলম্বন হারালে হয়ত হাজার ফিট নিচে গিয়ে পরবো গাড়ী সহ।

বাস থেকে রেডিও করাতে মিনিট কয়েকের ভিতর পুলিশ কার এসে প্রথমেই হুক, উইন্স দিয়ে গাড়ী সিকিউর করে আমাদের আক্ষরিক অর্থেই ‘one piece’ এ বের করে আনা হয়।

আর এই সারা সময়টা মা পার্শে ছিলেন। এর কি ব্যখ্যা হতে পারে, পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম, কারন আমার আসলেই জানা নেই!

 

৭৩৮ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “ফিরে আসা-৩।”

মওন্তব্য করুন : আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।