ফিরে আসা-২

সময়টা ছিল ২০০০ সাল। আমার জিবনের জন্যে একটি ‘Turning Point’. । জাগতিক দুনিয়াদারির স্কেলে আমি তখন প্রায় শীর্ষের কাছাকাছি অবস্তান করছি।মান সম্মান প্রতিপত্তি প্রায় সবই আমার করায়ত্তে।কি না করছি তখন,স্টক এক্সচেঞ্জ সদস্য হিসাবে ‘সাউথ এশিয়া স্টক এক্সচেঞ্জ ফেডারেশন’ (SAFE) করছি, নতুন স্টক এক্সচেঞ্জ বলে Screen Based Trading শিখার জন্যে Training এর দাওয়াত  লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টরন্টো স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে সাড়া পাচ্ছি।CSE Team Leader হিসাবে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

মা’র কথা আমি রেখেছি, মা ‘র মনভরা দোয়াও আমার সাথে।জার্মানিতে পড়াশুনা করতে যাবার আগে মা হাত ধরে কেঁদে ওয়াদা করিয়েছিলেন, পড়াশুনা শেষে দেশে ফিরে আসিস বাবা। আমি ফিরে এসেছি, একছেলে হিসাবে কর্তব্য পালন করছি। বাবার ব্যবসার হাল ধরেছি।

বোম্বাই, মাধুরাই শেষ করে কোলকাতা থেকে পাটনা হয়ে নেপালের ‘বীরাট নগর’ যাওয়ার জন্যে দম দম বিমান বন্দর যাচ্ছি দল বল নিয়ে।গুটি কয়েক ফ্যাক্টরি ভিজিট করব।পথে স্ত্রীর ফোন, মার শরীরটা বেশী ভাল ঠেকছেনা, পারলে চলে আস। এয়ারপোর্ট দেখি পাটনা ফ্লাইটের কাছা কাছি সময়ে বিমানের ঢাকা ফ্লাইট। সিট ও হবে দেখে বন্ধুদের বলায়, ওরা খুশি মনে রাজি। পাটনা / নেপাল না গিয়ে ঢাকা হয়ে চাটগাঁ ফিরে এলাম।

আমাকে হঠাৎ করে বাসায় দেখে ফোকলা দাঁতে বুড়ির কি হাসি। আমিও রহস্য করে বলি ঃ আরে তুমিতো দেখি একদম ভাল, কে বলে তুমি অসুস্থ ? মিষ্টি হেসে বলে, কই অসুস্থ, মাথাটা ঘুরে উঠাতে বাথরুমে পড়ে আছার খেয়েছি এইতো, আর তুই না বিদেশে ছিলি? এত তারাতারি চলে এলি?? আমি ব্যাগ থেকে বড় সাইজের দুই তিন বোতল ‘জবা কুসুম তেল’ বের করাতে আবার হেসে উঠে বলে, এত তেলে কি হবে? আমার কি আর এত হায়াত হবে? আমি কিত্রিম রাগ দেখিয়ে বলি, দেশে সব নকল বলে, নিজ হাতে ওদের দোকান থেকে কিনে এনেছি।সব তোমায় শেষ করতেই হবে।

মা’র শরীর বেশ ভালই দেখে, ফ্যাক্টরি ভিজিটটা আমার মিস হল বলে একটু দুঃখিত হলেও, এদিকে ভাটিয়ারী গলফ ক্লাবে ভারতীয় সংগীত শিল্পী ‘ অভিজিৎ’ এর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারব বলে মহা খুশি।বৌ যাচ্ছে না বলে আরো খুশি!

ভাটিয়ারী গলফ ক্লাবের তখনো ‘ বার ‘ ছিলোনা । এমন ধরনের বড় সর অনুষ্ঠান হলে বার ও রসদ সামগ্রী ‘ চিটাগাং ক্লাব ‘ থেকে ধারে আনা হতো।আমরা যারা দুইটা ক্লাবেরই সদস্য তাদের পোয়া বার।শুধু ভাউচারে সই করলেই হতো।অন্যদের  খেতে হতো নগদ টাকায়।

ঐদিন মওসুম এত সুন্দর ছিল, গলফ গ্রিনের দিগন্ত বিস্তৃতিতে গানের আসর, সাথে সুরের জাদুকর ‘ অভিজিৎ’ এর মন কেড়ে নেয়া সুর ! সুরাতো সহযোগী আছেই !!

রাত কয়টা বাজে খেয়াল নেই, মেইন ক্লাব হাউস থেকে পরিচিত বেয়ারা এসে জরুরি বাসায় ফোনে আলাপ করতে বলল। তখন গলফে সেল ফোনের নেট ওয়ার্ক ছিলনা। বউএর ফোন। মা কেমন জানি করছেন। সাথে সাথে রওনা হয়ে পাগলের মত গাড়ী চালিয়ে বাসায় ফিরলাম। ছোট ছেলে আলভী গেটে দাড়িয়ে আমার অপেক্ষায়, মাথায় টুপি।কাওকে কিছু বলে দিতে হলোনা, সব শেষ।

গলফে যাবার আগেও খুনসুটি করছিলাম ‘ কি লাগবে বল ? ‘, চারটা বাংলা কলা আনিস, রাতে দুধ-ভাতের সাথে খাবো।’চার’ টার বেশি আনলে রাগ করতেন, নষ্ট হয় যে ! কলা বাসায় রেখেই গিয়েছিলাম অভিজিতের গান শুনতে! উনি খাবার সময় পাননি।

সবচেয়ে প্রিয় জনকে নাকি শেষ মুহূর্তে আল্লাহ তালা সব সময় দূরে রাখেন।হয়ত পার্থিব মায়ার বাঁধন হাল্কা করার জন্যেই! জানিনা কি ভেদ লুকিয়ে আছে!!

পুনশ্চঃ এই এগার বছরে আর ‘ বাংলা কলা ‘ শত চেষ্টা করেও মুখে তুলতে পারিনি।মূল ” ধুম পান ত্যগের গল্পটা” এবারো  শুরু করতে পারলাম না বলে ,পাঠক ক্ষমা করবেন। আগামিতে ইনশাল্লাহ শেষ করবো ।

১,১৫৪ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “ফিরে আসা-২”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আজিজ ভাই,
    দিলেন তো আত্মার ভেতরটা ধরে হ্যাঁচকা টান। কি রোমাঞ্চকর সিরিজ যে শুরু করলেন!
    আরো লিখুন আপনার জীবনের কথা। আমাদের শোনানোর জন্য আপনার ঝুলিতে অগুণতি গল্প জমে আছে যে!

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    পড়তে পড়তে আপনার লেখায় আঁকা মায়ের ছবিটা ভেসে উঠছে। ভালো করে দেখি চেহারাটা অনেকটা আমার নানির মতো। গত ফেব্রুয়ারিতে উনাকে হারিয়েছি। আমার জন্মেরও আগে বিধবা হয়েছিলেন তিনি। আপনার মায়ের জন্য শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      লাবলু, কে বলে আমরা দু্র্ভাগা ? এদেশে জন্মে আমাদের 'মা', আমাদের নানিরা, বোনরা যে স্নেহ-মায়ায় আমাদের লালন পালন করেছেন। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান । এটা হলফ করে বলতে পারি ,আমাদের সব মা ,সব নানিদের চেহারায় উনিশবিশ হতে পারে, তবে স্নেহ মায়া মমতায় ওঁরা সব এক!


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন
  3. রেজা

    আজিজ ভাই,অনেকদিন পর ব্লগে ঢুকলাম।আল্লাহ আপনার মাতার বেহেশত নসীব করুক।


    বিবেক হলো অ্যানালগ ঘড়ি, খালি টিক টিক করে। জীবন হলো পেন্ডুলাম, খালি দুলতেই থাকে, সময় হলে থেমে যায়।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।