আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ।(বার)

দিনগুলি রোদ্রজ্জল ঝক ঝকে।আর রাত গুলিতে বেশ শীত পরতে শুরু করেছে। তখন ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ এর যুগও ছিলনা, নভেম্বর ডিসেম্বর জানুয়ারি আসলেই শীতকাল ছিল।হাড় কাঁপানো শীত। তবে এ নিয়ে আমাদের এত আক্ষেপ ও ছিলনা। বরং আমরা খুশিই ছিলাম। আমার ছোট্ট একটা বুদ্ধি বেশ ভালই কাজ দিচ্ছল।

আমাদের ব্যাচেলর দের থাকার রুম ছিল বারান্দার একদম শেষ মাথায়। বাথরুম এর পার্শে। ফজরের নামাজ শীতের কারনে একসাথে  না পড়ে নিজ নিজ ঘরে পরার পারমিশন পেয়ে গেলাম আব্দুল করিম মিয়া সাহেবের কাছ থেকে। বাকি কু-বুদ্ধিটুকুর জন্যে কাজিনরা আমার উপর বেজায় খুশী।

ঘুম থেকে চাচা ডেকে দিলে, একজনের শুধু উঠতে এবং দরজা খুলে বাথরুমে যেতে হতো ।বাথ রুমের পানি ছেড়ে মিছা মিছি অজু করার ভান করে এসে সোজা আবার গরম লাপের নিচে। ঠাণ্ডা ঢুকবে বলে দরজা বন্ধ করতে ভুল হত না। এর পর ‘একামত’, কেরাত করে নতুন মুখস্ত করা সমস্ত ‘সুরা, রুকু- সেজিদা’ সব সুন্দর করে অনেক জোরে জোরে পোরতে হত। চাচাও আমাদের কামিলিয়াতে অনেক খুশি, আমরাও অনেক খুশি, কারন এই সব কিছুই সম্পন্ন হতো লেপের নিচে শুয়ে সুয়েই !

আরেকটা আনন্দের ব্যপার চলছিল প্রতিদিন বাজার করা। আমার বুদ্ধি বিবেচনা একটু ভাল বলে, আমার সাথে যে কোন একজন কাজিন কে যেতে হতো বাজারে। আমি বয়সে ছোট হলেও আমিই বস। টাকা পয়সা আমার হাতে, হিসেব-নিকেশ সহ । এখানেই আনন্দ।

বাসার প্রতিদিনের বাজার বাজেট পাঁচ টাকা। সাথে যাতায়াত খরচ জিগাতলা-নিউমার্কেট-জিগাতলা  ছয় আনা- ছয় আনা, বার আনা।আমার হিসাব সোজা । যদি হেটে মেরে দেই, বার আনা বেঁচে যায়। প্লাস অল্প একটু পয়সা বাচাতে পারলে, দুই ভাই পেট পুরে খাওয়া যায়। পাঁচ আনা করে এক বোতল কোক/ফান্টা সাথে বড় এক সন্দেশ দুই আনা, একটা সমুসা দুই আনা। আহা কি আনন্দ ।                                                                                                                                                                                                                                                       (তখন ছয় পয়সায় এক আনা ছিল।এরই পরিবর্তীত রুপ ২৫ পয়সায় চার আনা, ৫০ পয়সায় আট আনা এবং ৭৫ পয়সায় বার আনা।)

আকাশবাণী, বিবিসি,ভোয়া এবং বাঙ্গালির প্রান-প্রেরনা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ তখন জিবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । এম আর আক্তার মুকুলকে আমি জীবনে কখনো দেখিনি, কিন্তু ওঁর সেই “চরম পত্রের”  প্রতিটি ব্যঙ্গ – মুক্তি বাহিনীর ক্যচকি মাইরের চোটে, ভোমা ভোমা মুছুয়া সেনাদের পাতলা পায়খানার চোটে দেশটা দুর্গন্ধে এক্কে বারে শেষ হইয়া গেল রে ! বিচ্ছু পোলা পাইন গুলিরে এতো ডর ! হালারা সারা জীবন ঘি পরোটা খাইয়া, কেচকি মাছের মজা এইবার বুঝতেসে !!!!

ঝপ করে যেন যুদ্ধটা ঢাকা বাসিদের জন্য জ্যন্ত হয়ে ধরা দিলো। ডিসেম্বর এর প্রথম সপ্তাহ হবে। চারিদিকে সাইরেন আর এন্টি এয়ার ক্রাফট গানের কমলা রঙের ‘ টেনিস বল ‘ এ আকাশ ছেয়ে গেল। ঢাকা বাসি মুক্তি পাগল বাঙ্গালিরা প্রথম একটু আধটু ভয় পেলেও পরে একদম পাত্তাই দিচ্ছিলনা বেপারটায়, যেন আজন্ম এয়ার এট্যাক দেখতে জনগণ অভ্যস্ত ! আমাদের  সকলের একটা দৃঢ় বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে , ভারতীয় বিমান হামলা কোন বাঙালি ক্ষতি সাধন করার জন্যে নয়। প্রতিটি হামলা “On Target” হচ্ছে ।Civilian দের কোন ক্ষতি এতে হতেই পারে না!

দু একদিনের মধ্যে এতই গাঁ সহা হয়ে গিয়েছিল যে উর্দি পরা সৈনিকরা যখন বাঙ্কারে লুকানোতে ব্যস্ত, তখন সাধারণ জনগণ, আমরা ,মাঠে-রাস্তার ধারে দারিয়ে আকাশে রুপালি ইলিশের তামশা দেখি । নীল আকাশের বুকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আধুনিক হাল্কা পাতলা  রুপালী  MIG-21 গুলির তুলনায়, ছাই রঙের  পাকিস্তানি F-86 স্যেবর জেট বিমানগুলি কাদাকার পেট মোটা গুবরে পোকার মত লাগতো।আর টেকনিক্যাল বেপারগুলি আমরা সাধারণ মানুষ না বুঝলেও, প্র্যাক্টিক্যাল Dog Fight দেখে কারো বুঝতে অসুবিধাই হতোনা যে MIG এর speed, maneuverability র কাছে Saber Jet  কোন তুলনায়ই যোগ্য ছিল না।

MIG কে ধাওয়া করার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা দেখে অর্বাচীন বঙ্গ সন্তানদের আনন্দ উৎচ্ছাস খান সেনাদের বোধগম্য মোটেও হতো না। কারন বিমান আক্রমনের কারনে জীবন যাত্রা স্তব্ধ হওয়ার কোন কারন বাঙ্গালিরা খুজেই পায়নি, তাই আমাদের জীবন যাত্রা চলমান এবং একদম স্বাভাবিকই ছিল।

আকাশে ঘটে যাওয়া এই অমুল্য স্মৃতি যখন সকলে গোগ্রাসে গিলতে ব্যস্ত, এমনকি আমাদের কে  বাজারে যাওয়ার অনুমতি পর্যন্ত যেখানে রোহিত হয়নাই, সেখানে আহেতুক ভয়ে কম্পিত হানাদারদের “উৎরো” , “উৎরো” বলে রিকশা থেকে রাস্তার পাশের বাঙ্কারে নামানোর প্রানান্তকর প্রচেষ্টায় মানুষ হেসেই খুন। এবং সাথে সাথে আরেকটা বেপার পরিষ্কার যে, পাকি মিলিটারি দের দেখে, “যে মৃত্যু আতঙ্ক বাঙ্গালির চোখে বাসা বাঁধতো, সেই মৃত্যু আতংক এখন ওদের চোখে” !

চর্ম চক্ষে  Air Combat  এ তিনটা যুদ্ধ বিমান ধংশের জীবন্ত দৃশ্য  দেখার সৌভাগ্য সম্ভবত শুধু তখনকার ঢাকাবাসিদেরই হয়েছিল।প্রথম পাকিস্তানী স্যবরটা সম্ভবত মোহাম্মাদ পুরের ‘ আসাদ গেটের ‘ কাছে, পরেরটা মিন্টু বা দিলু রোডের দিকে এবং  শেষেরটা  বুড়িগঙ্গার অপর পার ‘ জিঞ্জিরায়’ ভেঙ্গে পরে  MIG এর Missile’ র আঘাতে ! প্রতিটা আক্রমণ এখনো স্পষ্ট চোখে ভেসে উঠে, পেছন থেকে আচমকা সামনে এসে  MIG তার পাখার পেছন দিকের মিসাইল ছুড়ে মারে ।মুহূর্তের মধ্যে দুই/তিন টুকরো  Saber Jet কাটা ঘুড়ির মত একরাশ কালো ধুঁয়া ছড়িয়ে আশহায় ঘূর্ণনে নিচের দিকে নেমে আসে । মাঝখান থেকে একটি কমলা বিন্দু তীরের মত উপরের দীকে উঠে পেখম মেলে। Eject করা পাইলট ! জনগণের মাঝে পড়ে ‘নদীর ওপারে’ জিঞ্জিরায় পড়া পাকিস্তানী পাইলট সাহেবের নাকি শেষ রক্ষা ও হয়নি শুনেছি।

ভারতীয় একটি বিমান ও ধ্বংস হয়েছে শুনেছি (কিন্তু দেখিনি) পাকিরা পৌছার অনেক আগেই জনগন নিরাপদ দূরত্বে তাকে সরিয়ে ফেলে।

ভাবলেও হাসি পায়, চট্টগ্রাম কালুরঘাট রেডিও ইষ্টিশন উড়িয়ে দেয়া সেই বীর বাহাদুর ১৯৫০ দশকের USA’র কোরীয়া যুদ্ধের খল নায়ক F 86 Saber Jet এর এই করুন দশা দেখে।

(চলবে)


 

 

৮৯০ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ।(বার)”

  1. রেজা শাওন (০১-০৭)

    চমৎকার বর্ণনা ভাইয়া। আপনার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সব লেখা সবগুলোই পড়েছি। এটা পরে একটু বেশিই ভাল লাগলো।

    বিমান পরা দেখা বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। তাও আবার যদি সেটা হয়, পাকি বিমান...

    জবাব দিন
  2. আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

    ধন্যবাদ রেজা শাওন, কষ্ট করে স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে 'আমার শৈশব' পড়ার জন্যে। Its such a rich Adolescence and so many way diversified... I really thank to Almighty.
    পুনশ্চ ঃ এই বিশাল ক্যানভাসের শতকরা পাঁচ ভাগও পোট্রেট করার ক্ষমতা আমাদের নেই।


    Smile n live, help let others do!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।