প্রত্যেকে আমরা নিজের তরে

বেশ কয়েকদিন আগে থেকে গল্পটা শুরু করেছিলাম। নাম বিভ্রাটে এগুতে পারিনি। প্রথম ভাবছিলাম ‘ প্রত্যেকে আমরা “পরের” তরে ‘ দিবো , কিন্তু পরবর্তীতে ভাবলাম তার চেয়ে নাম হোক ‘প্রতি জন আমরা “একজনের” তরে”। কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত ” প্রত্যেকে আমরা “নিজের” তরে ” এবং এটাই আসলে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য ! কেন এই স্বার্থ পর সিদ্ধান্ত ?

গল্প লিখা আমার দারা হয় না এবং ভবিষ্যতেও হবে না। কারণ আমার অতো নিখুঁত ভাবে প্লট সাজাবার, ভাববার মেধা নেই। আমি যা চেষ্টা করি , সেটা হচ্ছে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলি মনে করে, অতিরঞ্জন বিহীন সাদামাটা ভাবে উপস্থাপন করা।তাই গল্পকার, উপন্যাসিকের সৃষ্টির গর্বে আমি গর্বিত নই। কলম পেষা কেরানি বৃত্তিতেই আমি খুশী।

আমার সমস্যা হল, ইচ্ছা হলেও অনেক কথা আমি লিখতে পারিনা।লিখলে শত ভাগ সত্যের গ্যারান্টি সহকারেই লিখি। এতে করে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা যার সম্বন্ধে লিখবো, সে সবের সাথে যে সব ‘সাধারণ’ মানুষ তখন জড়িত ছিলেন, তারা অনেকে এখন আলাউদ্দিনের চেরাগের স্পর্শে “অসাধারণ” হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন।তাই তাঁদের সম্বন্ধে লিখার আগে দশ বার ভাবতে হয়, তাঁরা কোন মনে কষ্ট পাবেন নাতো বা ভাড়াটে গুণ্ডা লেলিয়ে দিবেন না তো ?

শুধু আমি পরে আছি একই জায়গায় , কোন উত্থানও নেই -সম্ভবত তাই পতনও নেই ! দিল্লির কুতুব মিনারের মত ‘সাক্ষী গোপাল’ হয়ে দাড়িয়ে আছি নিজের জায়গায়।

যাহোক যে ঘটনা লিখার কথা ভাবছি, সম্ভবত ১৯৯৫ বা ১৯৯৬ সালের ঘটনা ।চিটাগাং ক্লাবের সুইমিংপুল । সুন্দর একটি বিকাল, পড়ন্ত রোদে ওল্ড ফৌজিয়ান চিটাগাং চ্যাপ্টারের কোন একটা চা চক্র অনুষ্ঠান হচ্ছে। সাইফুল ইসলাম ভাই ও আরো কিছু সিনিয়র ভাইদের সাথে জম্পেশ আড্ডা মারছিলাম। সাইফ ভাই সহাস্যে জিগ্যেস করলেন, কি মিয়াঁ চিটাগাং স্টক এক্সচেঞ্জ এর মেম্বারশিপ নাকি নিলা ? কি হবে ঐটা দিয়ে ? আমি উত্তরে বললাম ঃ ঠিক জানিনা কি হবে, কিন্তু জার্মানিতে ‘ শেয়ার অ্যান্ড ভালুএবল্স ‘ এর উপর একটা পেপার পড়েছিলাম, তাই চান্স পেয়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে নিয়ে নিলাম।কি হবে জানিনা, তবে আজীবন “ফাউন্ডার মেম্বার” হিসাবে নাম তো থেকে যাবে, নাহয় বন্ধ করে রেখে দিব, একটু দাম বাড়লে পরে বেচে দিবো !

ব্যাপারটা নিছক হাস্যকৌতুক পূর্ণ একটি ছোট্ট ঘটনা। কিন্তু প্রশ্নটা যে কারো জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়ার একটি মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল, তা শুধু বিধাতারই জানা ছিল নিশ্চয়ই !

ছোট খাট, অল্প বয়স্ক একটা ছেলে। দাড়ি গোঁফও ভাল মত উঠে নাই ! আমাকে একটু একা পেয়ে নাম আর এফ,সি,সি ব্যাচ নম্বর বলল।এবং আমার অফিস কোথায় জিগ্যেস করে দেখা করতে চাইলো । আমি ওকে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে সানন্দে দেখা করার অনুমতি দিলাম।

ধরা যাক ওর নাম মুনির চৌধুরী।পরের দিন ঠিক দশটায় ও আমার অফিসে এসে হাজির। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। টিউশনি, ক্যাডেট কোচিং ইত্যাদি করিয়ে আই,সি,এম,এ পরছে।এতটুকু বয়সে ওর জীবন সংগ্রামের কাহিনী শুনে ভালই লাগল। আমার কাছে ওর ‘অত্যন্ত সামান্য চাওয়া ‘ । ওই গত কাল ওফা’ র আড্ডায় যে ষ্টক মেম্বারশিপ ‘বন্ধ করে রেখে দিবো’ বলেছিলাম , যদি অনুমতি দিই, ও ঐটা চালু করতে চায় ।শুনে বেশ মজা পেলাম। শেয়ার ব্যবসা সম্বন্ধে ধারনা বা পরিচালনা করার যোগ্য ব্যক্তি তখন অন্তত চিটাগাং খুব একটা নাই।

ওর আগ্রহ দেখে, ঢাকা ষ্টক মেম্বার এক আত্মীয় কে ফোন করলাম। ওর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে জানলাম।ওই একই মিটিং এ তিন হাজার টাকা বেতন নির্ধারণ করে , অগ্রিম দিয়ে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। কোন সার্টিফিকেট, পরিচয় সূত্র, কিছুই জানার কথা মনেই আসলো না । এক্স ক্যাডেট , তার পরিচয়ের মুল প্রতিপাদ্য হয়ে রইল।

সেই তার জীবনের শুরু। এর পর আর তাকে পেছন ফিরে চাইতে হয়নি। তার মেধা, কর্ম দক্ষতা এবং সর্বোপরি ফৌজিয়ান যোগাযোগ তাকে বিগত ১৫ বছরে সমাজের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছে। গাড়ী বাড়ী, সম্মান প্রতিপত্তি সবই তার হাতের মুঠায় । আমার আবেগ, আমার ভাল লাগা ,শুভ কামনা তার প্রতিটি সাফল্যে উদ্বেলিত করেছে।

সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে বিমানের অন্তহীন ‘ Delay ‘ নিয়ে বসে বসে একটা ‘ ট্যাবলয়েডে ‘ ” ডোনাল্ড ট্রাম্প ” এর মজার কাহিনী পড়ছিলাম । হাই স্টেকে জুয়ায় এক রাতে ট্রাম্প নাকি সব হারিয়ে নিঃস্ব কপর্দকহীন হয়ে পরে। ক্যাসিনো ছাড়তে যখন বাধ্য হচ্ছেন, পকেটে টয়লেটে যাবার পয়সা ও তখন তার কাছে ছিলনা । একজনের কাছে থেকে এক ডলারের একটা কয়েন চেয়ে টয়লেটে যেতে মনস্থ করেন। (ওখানকার টয়লেটে ঢুকতে এক ডলারের কয়েন ঢুকালে তবেই দরজা খুলে) ঠিক যখন কয়েনটা ঢুকাতে যাবেন , সেই সময় একজন বেরুতে থাকায় খোলা দরজা পেয়ে সুড়ুত করে উনি ঢুকে পরেন। কাজ সেরে বেরুবার পথে সারি সারি ‘ Slot মেশিন ‘ দেখে ওই ডলারটাও রেখে যাওয়ার মানসে একটা মেশিনে ঢুকাতেই ‘ Jack Pot ‘ হিট করে প্রচুর টাকা জিতে নেন এবং ওই টাকা দিয়ে বাকি রাত জুয়া খেলে আবার সব হারানো ধন সম্পদ ফিরে পান।

একজন সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করে ঃ আপনি কি ওই বন্ধুকে ধন্যবাদ দিবেন না, যে আপনাকে এক ডলারের কয়েন দিয়ে সাহায্য করেছিল ? উনি হেসে বললেন ঃ অবশ্যই না। আমি ধন্যবাদ জানাবো ওই লোকটাকে, যে আমাকে টাকাটা ব্যবহার না করেই টয়লেটে ঢুকতে সাহায্য করেছিল। আসলেই সব চাইতে গুরুত্ব পূর্ণ এবং জরুরি হল, যে আমাকে Entry দিলো । না হলে আমি এখন কি তার প্রমাণ করার সুযোগই তো পেতাম না।

ভাবছিলাম এই সুন্দর , ছোট্ট, সত্য ঘটনাটা উল্লেখ করে প্রায় পঁচিশ হাজার এক্স ক্যাডেট কে “প্রত্যেকে আমরা পরের তরে” বলে উপদেশ দিই। কিন্তু পরে ভাবলাম না, এর চেয়ে যুক্তিযুক্ত হবে “প্রতি জন আমরা “একজনের” তরে” কারণ এই পঁচিশ হাজারের অর্ধেক যদি আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকি, এবং প্রতিজন যদি অন্তত ‘একজন এক্স ক্যাডেটকে’ আন্তরিক ভাবে সাহায্য করি, তাহলে দেশের অন্তত দশ/বার হাজার যুবকের গতি হতো।

কিন্তু পরবর্তীতে ক্যাপশন পরিবর্তন করে ” প্রত্যেকে আমরা “নিজের” তরে ” করার তিক্ত অভিজ্ঞতা কেন হলো সে না হয় অন্য কোন এক উপাখ্যানে লিখবো ।

১,০০৩ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “প্রত্যেকে আমরা নিজের তরে”

  1. রকিব (০১-০৭)
    কিন্তু পরবর্তীতে ক্যাপশান পরিবর্তন করে ” প্রত্যেকে আমরা “নিজের” তরে ” করার তিক্ত অভিজ্ঞতা কেন হলো সে না হয় অন্য কোন এক উপাখ্যানে লিখবো ।

    এটুকু পড়বার অপেক্ষায় রইলাম।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    কত অভিজ্ঞতা এক জীবনে!

    যেই ছেলেটার কথা আপনি বললেন এখানে সেটা পড়ে মনে হল, কানেকশন, রিস্ক টেকিং আর বুদ্ধিমত্তা এই তিনটারই সে সদ্বব্যবহার করেছে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।