আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ।(আট)

সম্ভবত তিনটা প্রধান কারনে তল্পি গুটিয়ে আবার গ্রাম ছেড়ে শহর মুখো হতে হোল।

প্রথম এবং প্রধান মনস্তাতিক সমস্যা : ভেসে আসা লাশের সংখ্যা ! প্রতি দিন ইসামতির মৃদু ঢেউএ ভেসে আসতে লাগলো অনেক হতভাগ্য মানুষ । ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরের  ঘূর্ণি ঝড়ের মৃত সভ্যতা ভোলা- চর ফ্যশান এর সংবাদ পত্রের সেই ‘লাশ আর লাশের’  ছবি গুলিরই যেন বাস্তব উপস্থাপনা হয়ে উঠল নানা বাড়ীর এই মধুর আনন্দের ঝাঁপিয়ে পরে গোসল করা নদীটি ! ফুলে উঠা পচা লাশ আর কাকের ভোজ দেখতে অনভ্যস্ত চোখ-মন পালাও পালাও বলে হাঁফিয়ে উঠল।

সেবার ইলিশ ও হয়েছিল প্রচুর ! আমার এই জীবনে এতো ইলিশ আমি কখনো দেখিনি! সব চেয়ে বড় দেড় -দুই কেজি সাইজের একজোড়া ইলিশ বাজারে মাত্র দুই/চার আনায় বিকাতে লাগলো।  একমাত্র হত দরিদ্র মানুষ ছাড়া কেও খেতেও চাইত না। কারন রব উঠল “মরা মানুষ খেয়েই এবার  এত বড়  বড় আর এত ইলিশ ধরা পড়ছে” ! সাথে গ্রামে মহামারী আকারে কলেরা দেখা দিলো ।

ওদিকে নিজ বাড়ী জয়পারায়,  চাচার চেয়ারম্যন বিষয়ক সমস্যা টাও প্রকট আকার ধারণ করলো ! আর কিছুতেই সময় দিতে রাজি নয় পাকিস্তানী সেনারা। চেয়ারম্যন সাহেব কে তাদের চাই ই চাই । অবিলম্বে হাজির করতে হবে। না হয় বাড়ীটা আর বাঁচানো যাবেনা । ক্ষমতার চূড়ান্ত ব্যবহার করে যত দিন সম্ভব জ্বালিয়ে দেয়া থেকে রক্ষা করলেন সেই নোয়াখালির তরুণ লেফটেন্যান্ট ।

এর মাঝে বাড়ীর মসজিদের ইমাম সাহেব শুধু ‘ নাতি বয়স্ক ‘ অফিসারের পা ধরতে বাকি রাখলেন।তবুও শেষ রক্ষা হয়না। ওদের দিন প্রায় শেষ হয়ে আসার দিকে, একদিন হুকুম হল হয় চেয়ারম্যন না হয় ‘ হাজী বাড়ী ‘ । হুজুরকেই বেছে নিতে বলা হলো, কোনটা চান।ওদের আচরণ, স্বভাব আগের মতও আর নেই। পাগলা কুকুরের মত হিংস্র মনে হল হুজুরের কাছে।

দ্বিধাদন্দে দোল্যমান তরুন সেনা কর্মকর্তা ‘অর্ডার ক্যারি আউট’ করতে বাধ্য হোল। ঠিকই সাথে আনা গান পাউডার, পেট্রোল সারা বাড়ী ছিটিয়ে আগুন দেয়া হল। তবে আমাদের অতি প্রিয় পুরানো ‘হাজি বাড়ী’ নয়। আমার জ্যাঠার পরিবার নিয়ে এক-দেড় ‘শ গজ দূরে সরে যাওয়া ‘ জলিল হাজি বাড়ী ‘।ইমাম সাহেবের ‘ লক্ষী পুরের’ ঘরনার ইজ্জত রাখলেন  তিনি জীবন বাজি রেখে।

সেই তরুন বাঙালি অফিসারের নাম কি ছিল, আজ কোথায় আছেন কারো জানা নেই। ইমাম সাহেব বেঁচে থাকলে আরো কিছু তথ্য হয়তো সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। তবে যেখানেই উনি থাকুন, আমাদের স্বস্শ্রদ্ধ সালাম। আইনের দৃষ্টিতে এমন বহু সেনা-পুলিশ অফিসার অবরুদ্ধ নয় মাসে শিকল ভাঙ্গার সাহস পায় নাই বটে , কিন্তু লোক চক্ষুর অন্তরালে যত টুকু সম্ভব বাঙালীদের সাহায্য করে গেছেন। ঠিক ‘আল-শামস, আলবদর দের বিপরীত মানসিকতা নিয়ে।

সেই পরিস্তিতিতে বাড়ী থেকে মাত্র ৫/৭ মেইল দূরে নানা বাড়ীতে থাকার চাইতে  পিতৃদেব আবার স্বপরিবারে ঢাকা শহরে ফিরে আসার সিদ্ধান্তই সবচেয়ে উত্তম  ছিল বলে আমার ধারনা।

মনে হয় জুলাই-আগস্ট  বা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে, ঢাকা শহরই সব চেয়ে নিরাপদ শহর হয়ে উঠে ছিলো।কারন বিদেশীদের দেখানোর জন্যে ঢাকা তখন প্রসাধনচর্চিত ‘ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ’ ! তবে শুনেছি বাঘা সাংবাদিক ‘ এন্থনি মাস্কারানহাস’ , ডেভিড ফ্রস্ট ,লরেঞ্জ লিফশুলজ, জন পিলজার, ওরিয়ানি ফালাচী দের কে এত সহজে বোকা বানানো সম্ভব হয়নি।দেশের হাঁড়ির খবর তারা ঠিকই পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ফাঁস করে দিচ্ছিলেন তথ্য প্রমান সহ । ভারতীয় প্ররোচনায় ‘ মাশরেকি পাকিস্তানের ‘ মিথ্যা  বানোয়াট খবর পরিবেশনের দায়ে গোস্বা করে হুকুমত বি বি সি কে শুনেছি বরখাস্তও করে ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে।

যাই হোক , আমরা আবার তল্পি তল্পা বেঁধে একদিন সকালে বান্ধুরা-কলাকোপা-নবাবগঞ্জ-আগলা-বাররা-ফতুল্লা হয়ে আট/নয় ঘণ্টা লঞ্চে ইসামতি, ধলেশ্বরী, মেঘনা বেয়ে বুড়িগঙ্গায় ‘ নবাব বাড়ী’ ফেলে সদর ঘাটে পৌছলাম।

আর কি কপালে লিখা আছে, কে জানে ? কোথায় স্বাধীনতা ?…কালের সেই উদ্বাস্তুদের করুন আকুতি আমাদের কণ্ঠে,  দিল্লী আর কত দূর ?? ইব্রাহিম লোদীদের ফারসি ভাষার একই করুন প্রতিধ্বনি:  ” দিল্লী হনু দুরস্ত “??

(চলবে)

 

১,৩৭৩ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ।(আট)”

  1. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    ভাইয়া আপনার এই সিরিজ এর জন্য সবসময়ই অপেক্ষা করি। অনেক কিছু জানতে চাই তবে আপনি আগেই বলেছেন এটা নিজের অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। আপনার প্রথম পর্বে যেমন স্বাধীনতার ঘোষণার কোন স্পষ্ট কিছু ছিল না। আমি বলতে চাচ্ছিলাম আমাদের দেশে যেসব বিতর্ক চলে আসছে সেগুলো নিয়ে। কে কত তারিখে দিয়েছে কে আগে দিল কি বলল আপনারা যারা সেসময় ছিলেন তারা যদি এই বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাটুকু ও বলেন তাও আমাদের অনেক কিছু জানা হয়। আমরা তো ৫ বছর পর পর নিজেদের জানা আপডেট করছি অনেক দিন ধরেই।

    জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      ভাই কামরুল, তোমাকে ধন্যবাদ। "স্বাধীনতার ঘোষণা" ব্যপারটা 'জ্ঞাণ পাপীদের' সৃষ্ট একটা চরম ফাজলামি। এটা শুধু 'গবু চন্দ্রদের' দেশেই বিশ্বাস যোগ্য।
      ব্যাপারটা একটা উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে। ধরো এখন যদি কোন ইতিহাসবিদ ক্লেইম করে , জিন্না অথবা মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা দিয়েছিল বলে এদেশ ইংরেজদের থেকে স্বাধীন হয়েছে, কেমন 'খেলো' লাগবে না শুনতে?
      তাহলে ১৮৫৭ সনের সেপাহি বিদ্রোহ বা তারও একশত বছর আগে ১৭৫৭ এর ২৩সে জুন সিরাজ দৌলার পতন থেকে শুরু হওয়া ঘটনাবলী , জালিয়ানাবাগ, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, নেতাজি সুভাষ বসু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ ... লাখো মানুষ, লাখো ঘটনার সম্মিলিত ফসল ব্রিটিশ রাজের ভারত ত্যাগ !
      এদেশে ম্রুক্ষরা যা বলছে বলুক।
      আমাদের শুধু বাছ বিচার করে দেখতে হবে , তখন (১৯৭১) সালে কয়জন মানুষ ' শেখ মুজিব কে চিনতো আর কয় জন এক সামান্য 'মেজর' কে।
      We have to call a 'Spade', a 'Spade'..সে যত ভাল বা খারাপই হোক না কেন! "victim of circumstance" যেমন হয়, Zia is just "A product of circumstance".ওই কালুরঘাট বেতারের 'বক্তব্যের পাঠক' হওয়া ব্যেতিত, পরবর্তী তে মুক্তি যোদ্ধা হিসাবে অবদান রাখা ছাড়া আর কোন বৃহৎ স্থান তার স্বাধীনতার ইতি হাসে নেই । (সম্পাদিত)


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      সে সময় কালুরঘাট রেডিও স্টেশনে উপস্থিত বিভিন্ন কুশলী ও বাদ্য যন্ত্রী দের মুখ থেকে শুনা ঘটনা : (সত্যতা শুধু তাঁদের কেও জীবিত থাকলেই দিতে পারবেন)

      সম্ভবত চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আদেশ প্রাপ্ত হয়ে চট্টগ্রামের কাছে পিঠে (এক্ষণ ঠিক মনে পড়ছে না পটিয়া না দোহাজারি) অবস্থানরত ইউনিট নিয়ে সেনানিবাসে গমন পথে জিয়া সাহেব কালুরঘাট বেতারে "ঘটনা চক্রে" উপস্থিত হলে, সেসময় আওয়ামী নেতৃবৃন্দ (হান্নান/মান্নান/জহুর আহমদ ) প্রমুখদের কে একটি ঘোষণার খসড়া করতে সাহায্য করেন। ঘোষণা টি চূড়ান্ত হলে কে পাঠ করবে এই নিয়ে দ্বিধার এক পর্যায়ে হান্নান সাহেব নাকি রসিকতার ছলে বলেন " আমরা ত সকলেই এখানে 'মাইনর' ,শুধু আপনিই ' মেজর'।ঘোষণা টা আপনি ই করুন না! যদিও নিছক কৌতুকের ছলে কথাটা বলা হয়েছিল, কিন্তু ব্যাপারটা উনি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে পড়তে লাগলেন । এবং ভালই পরলেন। এতে করে সকলেই ওনার পড়ার ব্যাপারে সম্মতি দিলেন।
      বাংলাদেশের ইতিহাসের 'কফিনে' আরেকটি পেরেক ঠুকা হয়ে গেল, সকলের অজান্তে !!!


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন
  2. সামিয়া (৯৯-০৫)

    গতকাল একটা বইয়ে হাজার হাজার লাশের বিভৎস বর্ণনা পড়লাম। আজকে এখানে এসেও লাশের কথা শুনের কেমন যেন লাগল। সকালেও একবার দেখে গেছি, এই ব্যাপারটা মনের মাঝে কেমন করছিলো।
    লেখাটা বরাবরের মতই, ঘটনার মাঝে দিয়ে ইতিহাসকে দেখছি।

    জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      সামিয়া,
      লাশই তো যুদ্ধের by product, বোন ! আল্লাহর কাছে হাজার শুকুর তোমরা এ নির্মমতা দেখনি! FB'র ফৌজিয়ান পাতায় ঢুকতে পারলে ১৯৬৮~৬৯'র ছবিতে দেখো এডজুটান্ট ক্যাপ্টেন জুবেরির ছবি।কি সুন্দর স্মার্ট একটি তরুন !
      যুদ্ধের শেষে ওকে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে ধরে, আমাদের ফজলুল হক ভবনের পেছনে জবেহ করে হত্যা করা হয়েছে। আমাদেরই কলেজের একটা 'মেস ওয়েটার' ওকে জবেহ করে । কি ভাবে? এই নির্মম বিত্যান্ত আমার নিজ কানে 'ওই পিচাশ' থেকেই শুনা।

      আবার বিপরীত কাহিনীও আছে। যুদ্ধের নয় মাস ভয়ে পালিয়ে থাকা মেয়ের সাথে চুটিয়ে প্রেম করে স্বাধীনতার পর পরই ধুম ধাম করে বিয়ে করে আমারই একদম ছোট চাচা!!

      যুদ্ধ মানবীয় আবেগ গুলির এক্সট্রিম এ নিয়ে যায়, আমার ধারনা ।


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন
  3. রাব্বী (৯২-৯৮)

    আপনার এই মুক্তিযুদ্ধ সিরিজ লেখাটা আগ্রহ নিয়ে পড়ে যাচ্ছি, আজিজুল ভাই। আগ্রহের জায়গাটা মূলতঃ আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ানে একাত্তরকে তুলে ধরা। তবে পর্বগুলো আরেকটু বড় এবং বিশদ বর্ণনা হলে আরো বেশি ভাল হতো।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
    • আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

      < পর্বগুলো আরেকটু বড় এবং বিশদ বর্ণনা হলে আরো বেশি ভাল হতো।blockquote> রাব্বী, আমার মত আলসে লোক যে ' চন্দ্রাহতের ' ( কথাটা কি ঠিক হল? ইংরাজি থেক বাংলা করলাম যে ?) মত লিখে চলছি। দু টাকার সিন্নি দেয়া উচিৎ আমার নামে ! আবার বড় ও বিশদ বর্ণনা, হাহ্!!


      Smile n live, help let others do!

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।