আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ!(পাচ)

১৫০০০ ফিট উপর থেকে সবুজ শ্যামল দেশটা কে কত সুন্দর লাগছে। ছোট ছোট ম্যাচ বক্স এর মত ঘর বাড়ি ,পুকুর।এর চেয়েও ছোট মানুষ। পিঁপড়া থেকেও ছোট ।এত উপর থেকে দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। তাদের এই জমিনএ এই তাণ্ডব, এত হানা-হানি।আল্লাহ্‌ তালা নিশ্চয় উপর থেকে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছেন ও হাসছেন।ভাবনাটা সাংঘাতিক।ছোটদের এরকম ভাবতে নেই ।শাস্তি যোগ্য অপরাধ।

সবুজ পোশাক, সবুজ টুপি পরা বিমান বালা এবার ভালো ব্যাবহার করেই ‘কে,রাহমান’ এর ‘বেনানা মিল্ক’ সেঁধে গেল। লজেনস দেয়ার সময় দুই মুঠো নেয়াতে বড় বড় চোখ করে যেভাবে তাকাল, বাঙালি প্লেন চড়ছি বলে লজ্জাই পেয়ে গিয়েছিলাম। ওদেরতো আবার অ্যাড্ স্লোগানঃ “PIA , great people to fly with” ! গ্রেট পিঁপল তো আসলে আমরা নই, নিছক মধ্য বিত্ত “বাঙালি পরিবার”।

আকাশ পাতাল কত কিছুই না ভাবছি। ছেড়ে আসা চাটগাঁর কথা।শুনেছি মৃত্যু পথ যাত্রী ডুবন্ত মানুষের চোখে নাকি পাঁচ-দশ সেকেন্ডে  ভিডিও চিত্রের মত সারা জীবনের গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা গুলি ভেসে উঠে।  আমার ও কি তাই হচ্ছে?

বন্ধু মামুন এর মুখে ‘তমাল নন্দির’ কথা শুনছিলাম। অনেকের সাথে পুলিশ লাইনের পাহাড়ে ওকেও লাইন করে ব্রাশ ফাইয়ার করে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তমাল এর ভাষায় ” মৃত্যুর ওপার থেকে দেখছি, এক সারি লাশ এর মধ্যে নিজের লাশ টাও দেখলাম। রক্তাক্ত শরির। শেষ বারের  মত ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করল। চটচটে রক্ত গাঁ ভর্তি। মানুষের মৃত্যু হলেও কি চিঁমটি কাটলে  ব্যথা লাগে?  লাগছে তো!  তাহলে কি আমি মরিনি?
নাতো ! আরও দুচার জনের আর্তনাদের  আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি । তার মানে আমি মরিনি। এদিক উদিক দেখি কেও কথাও নেই। পালাতে হবে। প্রথম মাথা সঠিক ভাবে কাজ করছে  ।হাত দিয়ে অনুভব করে দেখি কথাও গুলি লাগেনি।হয়ত ব্রাশ ফায়ার লাগার আগেই অজ্ঞান হয়ে পরে যাই। যাহোক ভাগ্য আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। হামাগুড়ি দিয়ে কোনরকম শরীরটা গড়িয়ে দেই পাহাড়ের ঢালুতে। রাত কটা বাজে খেয়াল নেই।
কিভাবে জীবিত দের মাঝে, বাঙ্গালীদের মাঝে ফিরে এলাম কোনরকমে মনে নেই।

হাসি পাচ্ছিলো ঘটনাটা মনে পড়ে। বেচারা মরেও বেঁচে আছে, আর লাখো বাঙালি বেঁচেও মরতে যাচ্ছে প্রতি নিয়ত।আগামীতে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে আল্লাহই জানেন। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোয় পরতে যাচ্ছি কিনা জানিনা। ঢাকায় যাচ্ছি অনেক আশায় বুক বেধে।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে কলাকোপা-বান্ধুরা।ওখান থেকে নৌকায় দোহার, গ্রামের নাম জয়পারা। শহর কেন্দ্র থেকে ৫০ মাইলের মধ্যে হলেও মোটর লঞ্চে সাত/আট ঘণ্টার নদী পথ, বুড়িগঙ্গা, ধলেশরি, ইসামতি পেরিয়ে নৌকায় আড়িয়াল বিল এর প্রচণ্ড ঢেউর নাচনে প্রাণটা যখন হাতের মুঠায়, তখন সারি বাধা গাছের খুঁটি গুলি নজরে পরলে স্বস্তি এনে দেয়, এসে গেছি প্রায়। জয়পারা আর সামান্য দুরে।

বাবার হিসাব ঠিকই ছিল। মরু-পাহাড়ি অঞ্চলের বেঁড়ে উঠা পাকি আর্মি দের “পানি-আতংক” সর্বজন বিদিত।সরাসরি রাস্তাঘাট হীন প্রত্যন্ত গ্রাম। লঞ্চ-নৌকায় ১০/১২ ঘণ্টার রাস্তায় তাদের আসার সম্ভবনা শতকরা শুন্য ভাগ! আর বর্ষা ও এবার পূর্ণ শক্তিতে সমাসীন। নদীনালা টইটুম্বুর, চারিদিকে থই থই পানি। একদিকে প্রমত্ত পদ্মা আরেক দিকে ইসামতি-আড়িয়াল বিলের বিস্তৃতি।মাঝে জয়পারা-শাইনপুকুর-রাইপাড়া এক গুচ্ছ গ্রাম।আমাদের নিরাপদ আশ্রয়।
আসলেই আর্মিদের জন্য এই অঞ্চল ছিল ‘non-strategic’ or ‘to be avoided’ ক্যাটাগরির। জলমগ্ন হওয়ার আগেই একবার এসে ঘুরে গেছে। “সব ক্যুচ ঠিক হ্যাঁয়” রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।সব পক্ষই খুশি।

প্রাক স্বাধীনতার সময় গুলিতে প্রায় বনেদী পরিবারই মুসলিম লীগ আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল, কারন ,আমার ধারণা , পাক-ভারত স্বাধীনতার সময় এরাই ছিল “বিপ্লবী ভাবনার ধারক-বাহক”।সেই “রেনেসাঁর ” একই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এ আওয়ামী লীগ পন্থী দের বেলায় ও প্রযোজ্য, অর্থাৎ এরাই  “পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমকালীন ধ্যান ধারণার পৃষ্ঠ পোষক”।

আমাদের পরিবারে বাবা-চাচাদের মধ্যে বাবাই বড় এবং স্কুল জীবন সেই মহা যুদ্ধের সময় থেকেই চাটগাঁএ। তাই রাজনীতির চেয়ে অর্থনীতিতেই আগ্রহ বেশি।সেজ চাচা দেশের জমি-জমা দেখা শুনা করতেন।গ্রাম, রাজনীতি তারই মাথা ব্যথা।
সেই আইয়ুব খান এর basic democracy-র শুরুতে ১৯৬৪-৬৫ সন থেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউনিয়ন কাউন্সিল এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন।বাবার কথায় “বাড়ীর খেয়ে বনের মোষ তাড়াতেন”।

আমরা তখনো চাটগাঁএ। পাক আর্মিরা এসে প্রতি ইউনিয়ন কাউঞ্চিলেই খোঁজখবর করে গেছে কোন ‘মুক্তি’, কোন হিন্দু আছে কিনা। নেই জেনে দায়সারা একটা “শান্তি কমিটি” করে রেখে div head quarterএ ফিরে গেছে। কোন জালাও পোরাও, অত্যাচার কিছুই হতে দেন নাই চেয়ারম্যান সাহেব। এতে গ্রামবাসী সহ সব পক্ষই খুশি।

কিন্তু এই সুখ বেশি দিন সইলো না। চেয়ারম্যান চাচার ছেলে হালিম ভাই, আমার দের/দু বছর এর বড়। আমার সারা দিনের খেলার সাথী। জাল, ছিপ দিয়ে মাছ মারা, বাজারে যেয়ে পেট পুরে “ছানার আমৃতি” খাওয়া এই ছিল আমাদের দৈনন্দিন রুটিন ।
সেদিন ও বাজারে এসছি। সকাল ১১ টা হবে। হটাৎ বোমা ফাটার বিকট আওয়াজ, সাথে টানা স্টেন গান এর ব্রাশ ফায়ার এর শব্দ। মানুষ যে যেদিকে পাড়ছে ছুট্। আমরাও দুজন হাত ধরাধরি করে ছুটছি। এক দৌড়ে দেড় মাইল রাস্তা পেরিয়ে একেবারে বাড়ী।পরে শুনলাম মুক্তি বাহিনীর অপারেশান হয়েছে।পাশাপাশি থানা-ব্যাংক থেকে অশ্র গোলা বারুদ, টাকা পয়সা সব নিয়ে গেছে।
VHF Wireless station যেটা আমাদের একমাত্র নগরসভ্যতার সাথে যোগাযোগ, গ্রাম থেকে ঢাকা-চাট গাঁ ফোনে কথা বলার একমাত্র মাধ্যম ছিল,সেটার যন্ত্রপাতিই বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়ে গেছে।মুক্তিবাহিনীরা কাওকে হতাহত করেনি। clean operation.

(চলবে)

৮২৫ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ!(পাচ)”

মওন্তব্য করুন : তৌফিক (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।