আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ!(চার)

কোরবানীগঞ্জ-খাতুনগঞ্জ ।চট্টগ্রামের, তথা দেশের আমদানি-রফতানি ব্যবসার তৎকালীন প্রান কেন্দ্র ।’জলিল-হাকিম ম্যানসনের’ চার তলায় বাবার অফিসের একাংশ পরিষ্কার করে মহাসুখে নতুন সংসার গুছিয়েছেন মা। চারিদিকে  উর্দু-গুজরাটি-বোম্বাইয়াদের ভিড় । হাসি খুশী ভদ্র সুন্দর ব্যবহার । মূলতঃ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়।

মজার ব্যপার হল, দেশকে ধ্রুত আবার স্বাভাবিক অবস্তায় ফিরিয়ে নিতে বদ্ধ পরিকর পাকিস্তানী ‘হুকুমত’ এইসব এলাকাকে এড়িয়ে চলছিলো । যাতে পূর্ণোদ্দমে অর্থনীতি আবার সচল হয়।

কিন্তু জেলখানার মানুষের আবার স্বাভাবিক জীবন ? সবার মনেই চাঁপা আতংক। সূর্য ডুবার সাথে সাথেই শহর গুলির ভূতুড়ে রুপ । রাস্তায় টহলরত সেনা , মাঝে মধ্যে গুলির শব্দ।

মহল্লার  ঘেয়ো কুকুর গুলিও মনে হয় নির্বাক! কিন্তু তাদের স্থান তাই বলে ফাঁকা নেই ,হাসি-হল্লা,আনন্দের চীৎকারে রাতের আঁধার মাতিয়ে রেখেছে ঘৃন্য কিছু বাঙ্গালী, সাথে পাঞ্জাবি-পশতু-মাকরানী ভাষী পাকসেনাদের দোসর উর্দু ভাষী অভিশপ্ত বিহারী গোস্ঠী । অস্র, ক্ষমতা আর অর্থের নেশায় তারা বাঙ্গালীর রক্তে হোলি খেলায় মত্ত ।দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের হিটলারের ” গেস্টাপো ” আদলে গড়ে তুলেছে তারা পাড়ায় পাড়ায় রাজাকার,আল-বদর,আল-সামস বাহিনী ।

বাবা তখন কেন যে এখান থেকে একেবারে দাদা-বাড়ী ঢাকার গ্রামে চলে যেতে মনস্থ করলেন, এক্ষণ বোধগম্য হয়! নিশাচর ” গেস্টাপোরা ” রাতের আঁধারই বেছে নিতো সমাজের শীর্ষ স্থানিয়দের তুলে নেয়ার জন্যে! তাই সম্ভবত তখন শহুরেদের গ্রামে প্রত্যাবর্তনের হুজুগ চলছিলো ।’ গ্রামে গেলে মা-বোন সকলেই পাক সেনাদের থেকে রেহাই পাবে ‘ এই বিশ্বাস নিয়ে অনেকেই জীবনের প্রথম গ্রামমুখো হয়েছিল। নাক সিটকানো গেঁয়োরাই শহুরে বাবুদের সাদরে আশ্রয় দিয়েছিল।

আমি খুবই উত্তেজিত গ্রামে যাচ্ছি তাই! গ্রামের সাথে আমাদের সম্পর্ক মধুর শিশু কাল থেকে। গ্রীষ্মের প্রতিটি ছুটি গ্রাম দাঁপিয়ে বেড়াতাম সমবয়সী চাচাত ভাইদের নিয়ে ।তাই বাক্স-পেটেরা বেঁধে গ্রামে যাওয়ার অধির অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম।

স্টেডিয়াম এর পূর্ব দিকে লাভ লেইন শুরুর একটু আগে,  PIA-র চট্টগ্রামের হেড অফিস। চট্টগ্রাম-ঢাকা বিমান ভাড়া ছিল সম্ভবত ২৭ টাকা অথবা ৪৫ টাকা এখন ঠিক মনে নেই।দিন ক্ষণ ঠিক, টিকিট ও কেনা হলো । এয়ার রুটই সব চেয়ে নিরাপদ , কারন ট্রেনে-বাসে চলাচলে বার বার আর্মি চেকিং, যাকে খুশি তাকে নামিয়ে নিয়ে ইন্টারোগেশন,আর ফিরে না আসা ,এসব খুবই স্বাভাবিক বাপ্যার তখন। মহিলারাও চেকিং এর গাঁ শির শির এই ঘৃণ্য অভিজ্ঞতা থেকে রেহাই পেত না।

চট্টগ্রাম ছাড়ছি । আমার প্রিয় চট্টগ্রাম । জীবিত আবার ফিরবো কিনা জানিনা। ছোট “টুইন অটার স্টল” বিমান। Twin Otter STOL (Short Takeoff and Landing) ২০-২৫ জন যাত্রী । এই নতুন বিমানগুলি আর বাংলাদেশ বিমানের বহরে ঠাই পায় নাই।শুনেছি পশ্চিমারা এগুলি নিয়ে আত্ম সমর্পণ এর আগ মুহূর্তে রেঙ্গুনে পালিয়ে যায় ।

বিমান বেশ নিচে দিয়ে উড়ছিল।ত্রিভুজ-চতুর্ভুজ সবুজ কার্পেটের মত জমিন ।মাঝে মাঝে ধোঁয়ার কুণ্ডলী।এগুলি শুধু কি দৈনন্দিন জীবন এর রান্না-বান্নার ধোঁয়া ?  নাকি হানাদারদের তাণ্ডব আর বহ্নি উৎসবের আগুনের ধোঁয়া দেখছি এত উপর থেকে, জানিনা।

চাট গাঁর কিছু ঘটনা মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অলস সময় ভাবছি কতো কথা।

কালুরঘাট আশ্রয়স্থল থেকে আরো গভীর গ্রামে সরে যাওয়ার দিনের কথা। রেডিও স্টেশনে  একদিকে বিছিন্ন ভাবে বিমান হামলা, অন্য দিকে আমরা আবার গাড়ী ভর্তি হয়ে পালাচ্ছি ! মদিনা ঘাট ব্রিজে উঠার আগে বাঙ্গালীরা চেক পোস্ট বসিয়েছে।অবাঙ্গালিরা নাকি গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। আমরা ভাই- বোনরা সবাই ফর্সা বলে সবাইকে একে একে বাংলা কথা  বলে পরীক্ষা দিতে হয়েছে যে, আমরা বাঙালি।

ঠিক একই জায়গায়, দু মাস পরে ফিরে আসার পথে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র ।

পাক আর্মিরা ওখানেই চেক পোস্ট বসিয়েছে। সন্দেহ হলেই যুবক, প্রৌড়দের বাস থেকে নামিয়ে প্রশ্ন করছে।পছন্দ সই না হলে খরস্রোতা হালদা নদীর কোমড় সমান পানিতে দাড় করিয়ে ‘ পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ ‘ থেকে ফায়ার করছে। গাড়ী থেকে লক্ষ্য করছিলাম, হতভাগ্য কিছু বাঙালি সন্তান কে পানিতে নামতে!

বাহ্ কি চমৎকার ব্যবস্থা, ঝামেলাহীন।কত শত লাশ যে খরস্রোতা হালদা ভাসিয়ে নিয়ে নিজ কোলে ঠাই দিয়েছে, কারো হিশেব নেই!

আসার পথে একই ভাবে ” পাক সারজামিন সাদ বাদ ” (পাকিস্তানী জাতীয় সঙ্গীত) গেয়ে সাঁচ্চা পাকিস্তানী হিসাবে আমাদের পরীক্ষা দিতে হলো ।এক-দুই মাসের তফাতে নিয়তির কি পরিহাস !

চাটগাঁর অধ্যায় শেষ করার আগে একটি বেদনা বিধুর কাহিনী না লিখলেই নয়।

বৃদ্ধ হাফিজ সাহেব ছিলেন একজন জীবন্ত কিংবদন্তী । অনেকে আসতো ওঁকে দেখতে। কোরানে হাফেজ ছিলেন। দু চোখই অন্ধ হলেও কারো সাহায্য ছাড়াই চলাচল করতেন। সুইচ বোর্ডের অনেক সুইচ থেকে সঠিক সুইচটা বেছে নেয়া বা শুধু স্পর্শ করেই মিলের কল কব্জার গলদ নাকি খুজে বের করতে পারতেন।

ওঁর ছেলে আমার দুই ক্লাস উপরে একই স্কুল সেন্ট প্লাসিডে পড়তো । নাম হালিম। কাহিনী প্রচলিত ছিল, নি:সন্তান, অতুলনীয় এই অন্ধ ধার্মিক ,কোরানে হাফেজ আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করতেন , দু চোখের বিনিময়ে হলেও আল্লাহ যেন একটি ছেলে সন্তান উনাকে উপহার দেন!

হাফিজ টেক্সটাইল মিল, হাফিজ জুট মিলস, মেডিকেল কলেজের পূর্ব গেইটে ‘ হাফিজ ভবন ‘ ( এখন যেটায় কাস্টম কমিশনার থাকেন ) সব কিছুর একক মালিক ছিলেন এই  ঋশী তুল্য হাফিজ সাহেব।লোক মুখে প্রচলিত ছিলো, হালিমের জন্মর দিনই নাকি ওঁর দু চোখ অন্ধ হয়ে যায়।

সম্ভবত মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে হবে। আইন শৃঙ্খলা বলে তখন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। শুনলাম হাফিজ সাহেব দের ওখান সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। ওরা তখন নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি এক নম্বর রোডের উল্টো দিকে থাকতো । কবরস্থান, মসজিদের পার্শে বিশাল গেইটওয়ালা বাড়ী । অনেক ভিড়ের জন্যে কাছেই যাওয়া গেল না । লোক মুখে শুনলাম, বৃদ্ধ হাফিজ সাহেব এবং সম্পূর্ণ পরিবারকে কেউ শত্রুতার জের ধরে খুন করে গেছে!

হালিমের মুখটা ভেসে উঠে, বন্ধু প্রায় সবাইকেই বলেছিলো , ” করাচী পোঁছে ইনশাল্লাহ চিঠি লিখবো ” । আজ চল্লিশ বছর পরেও ওর অনেক সহ পাঠী ‘ হালিমের চিঠির’ অপেক্ষা করে। ওদের কোন এক কর্মচারীর পূর্ব শত্রুতা বশতঃ নাকি স্বপরিবার  এই নির্মম হত্যাকাণ্ড !

আমেরিকার সিনেটর হিরাম জনসন ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের বর্ণনায় যথার্থই বলে ছিলেন : একটা যুদ্ধের প্রথম “ক্যসুয়ালিটিরা” হলো – ” মানবতা, সত্যবাদিতা  ও ন্যয়নীতি “, – হাফিজ পরিবার তার জ্বলন্ত প্রমাণ !

 

 

৮৭২ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ!(চার)”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    সবগুলো পর্বই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি, আগামী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম...


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।