আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ।(এক)

(চল্লিশ বছরের পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলি লিখতে চেষ্টা করেছি । তথ্যগত ভুল ভ্রান্তি হয়ে যেতেও পারে , তবে সঠিক ঘটনা পরম্পরা কৈশোর এর দৃষ্টিতে যা দেখেছি , সহজ ভাবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি।)

১৯৭১ সাল। সবে তখন ক্লাস ফাইভে উঠেছি।অবাক বিস্ময়ে চারিদিকে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলি দেখি। কোনটা বুঝি , কোনটা বুঝিনা , কেন এমন হয় ??

আমাদের কর্ণফুলী কাগজ কলে বানানো বই-খাতার কাগজই নাকি পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্রি হয় দুই আনা দিস্তায়, (তখন ছয় পয়সায় এক আনা র হিসাব ছিল) অথচ সেই একি কাগজ নাকি পশ্চিম পাকিস্তান ঘুরে আসার কারণে আমাদেরকে চার আনা দিস্তায় কিনতে হচ্ছে ।এমন ভাবেই নাকি চিনি , চাল সব কিছুই পূর্ব পাকিস্তানী  বাঙালিদের বেশী দাম দিয়েই কিনতে হচ্ছে ।

কেন এমন হবে? কলেজ পড়ুয়া বড় ভাইয়েরা এসে বুঝিয়ে গেল।প্রতিবাদ হচ্ছে । আরও হবে।

চারিদিকে টান টান উত্তেজনা ।এসব নিয়ে প্রতিবাদ চলছে ।দেশের দুই প্রদেশ কে সমান চোখে দেখা হচ্ছে না। উর্দু ভাষী পশ্চিম পাকিস্তানীরা নাকি সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে , আর আমরা ‘ ভেতো বাঙালী ‘ কিছুরই যোগ্য নই ।

এই সব নিয়ে মান -অভিমানের স্তর পেরিয়ে , মন কষা- কষির সীমানা ছাড়িয়ে এখন প্রায় ঝগড়া – ঝাঁটির অবস্থায় পৌঁছে গাছি।

স্কুল-কলেজ, ক্লাসে আর কারো মন নেই। সেইদিন মহা আনন্দে চললো রাস্তায় রিক্সা ভাঙ্গার কাজ।

কেন, বুঝতে পারলাম না ।বেচারা রিকশা ওয়ালা কি অন্যায় করলো ? প্রবর্তক স্কুলের মোড়ে দাঁড়িয়ে বেশ মজা পেলাম রিকশা ভাঙ্গা দেখতে। আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছিলো এই কিশোর হৃদয় কে নাড়া দেবার জন্যে !

জীবনে প্রথম গাড়ী পোড়াতে দেখলাম । চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের উল্টো দিকেই ছিল আমেরিকার USIS লাইব্রেরী । ওরা নাকি সাম্রাজ্যবাদী , সমস্ত নষ্টের মূল । ওদের গাড়ীটা পুড়িয়ে দেয়া হলো , কালো ধুঁয়ায় চারিদিক ছেয়ে গেলো ।

তখনো বুঝিনি এই কালো ধুঁয়া আমাদেরকে সম্পূর্ণ ‘৭১ সালটা ঢেকে দিবে ।

যতোই সময় গড়াতে লাগলো , বড় মানুষ গুলোর চেহারায় বাড়তে লাগলো শঙ্কা, ভয় ও অনিশ্চয়তার ছাপ, রাস্তায় নিছক প্রতিবাদ রূপ নিলো জনতার অরণ্যে , প্রতিরোধের বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতে ।

মার্চের গোঁড়ার দিকের কথা , এদিক সেদিক অবাঙালীরা বাঙ্গালিদের উপর গুলি ছুঁড়ছে ।দু/ চারটা আহত , নিহত  প্রতিদিনই আসছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ।

বাসার একদম কাছে বলে দৌড়ে যাচ্ছি দেখতে ।এখন যেটা প্রধান কলেজ বিল্ডিং , ঐটার নিচের বারান্দায় অনেক রক্ত দেখেছি । এক-দুইটা লাশ ও সম্ভবত ছিল। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হতো মানুষগুলিকে । শুনতাম বন্দরে গুলি হয়েছিল , বাঙালি শ্রমিকরা জাহাজ থেকে গোলা-বারুদ খালাস না করার কারণে। রেলওয়ের বিহারীরা বাঙ্গালিদের মিছিলে গুলি চালিয়ে ছিল , সেই সব নিহতদের লাশ আসছিলো ।

দেশ জুড়ে ‘ অসহযোগ আন্দোলন ‘ চলছিল । ” শেখ মুজিবুর রহমান ” আর ” বাঙ্গালী ” নাম মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল ।শিকল ভাঙ্গার গান শুনিয়েছিলেন তিনি।সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে উদীপ্ত করেছিলেন সেই মন্ত্রে : ” এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ……”।

(চলবে)

১,১৪৫ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “আমার দেখা ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ।(এক)”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এও সিরিজ নিয়মিত পড়তে পারবো আশা করি, আপনার সেদিনের কিশোর চোখ দিয়ে দেখা ৭১ কে দেখি...


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আজিজ ভাই,

    একাত্তরের স্মৃতিচারণ চমৎকার। লিখে যান। আপনার সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্মৃতিতেও শান দিই!

    আপনার দু'বছরের ছোট বলে প্রায় একইরকমের স্মৃতি আমারো আছে। হরতাল, বিক্ষোভ, কার্ফ্যু, ব্যারিকেড- স্কুলে বড় ভাইরা এসে ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া; এক নিঃশ্বাসে সব মনে পড়ে যায়। এরকম হরতাল বা রাস্তা ব্যারিকেডে মতিঝিল পীরজঙ্গি মাঝারের কাছে রাস্তায় ইয়াহিয়া খানের কবর বানিয়ে তাতে জুতার মালা দেওয়ার জ্বলজ্বলে স্মৃতি এখনো ভুলিনি। ভুলিনি কার্ফ্যুর মধ্যে ফাঁকা রাস্তা দাপিয়ে বেড়ানো পাক সেনাদের কনভয়।

    একাত্তর ভুলিনি, ভুলবো না।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  3. নাফিজ (০৩-০৯)

    ভাই এই স্মৃতিচারণটা যদি ধারাবাহিকতা রেখে শেষ করতে পারেন তো এই ব্লগের জন্য একটা অমূল্য সম্পদ হবে সেটা। তাই চালিয়ে যান।


    আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।

    জবাব দিন
  4. মাহমুদুল (২০০০-০৬)
    স্কুল-কলেজ, ক্লাসে আর কারো মন নেই। সেইদিন মহা আনন্দে চললো রাস্তায় রিক্সা ভাঙ্গার কাজ।

    হা হা। আমাদের ছাত্রদের গাড়ি ভাঙ্গার সংস্কৃতি তাহলে নতুন নয়। :)) :))


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।