আমার ছোট বেলা-দুই “অদ্ভুতুড়ে গল্প”।

 

আমাদের বয়স ১০/১১ হবে।সবে মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। গ্রামে আছি মাস কয়েক ধরে অর্থাৎ সেই যে ১৩ই ডিসেম্বর ঢাকা থেকে পালিয়ে চলে এসেছি , তার পর রয়েই গেছি গ্রামে।গ্রামের নাম জয়পারা।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে কলাকোপা-বান্ধুরা।ওখান থেকে নৌকায় দোহার। শহর কেন্দ্র থেকে ৫০ মাইলের মধ্যে হলেও বর্ষায় মোটর লঞ্চে শাত/আট ঘণ্টার নদী পথ, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ঈছামতি পেরিয়ে নৌকায় আড়িয়াল বিল এর প্রচণ্ড ঢেউর নাচনে প্রাণটা যখন হাতের মুঠায়, তখন সারি বাধা গাছের খুঁটি গুলি নজরে পরলে স্বস্তি এনে দেয়, এসে গেছি প্রায়। জয়পারা আর সামান্য দুরে।

আর শীতে এই আড়িয়াল বিলের উপর দিয়েই ‘ মোমিন কোম্পানির ‘ চার চাকার “মুড়ির ডিব্বা” গুলি চলে ।কাঁচা রাস্তা, শুধু চাকা চলার জায়গায় দু সারি ইট বসানো ।জিঞ্জিরা হয়ে এতে করে ঝাঁকিয়ে-লাফিয়ে পৌঁছতে চার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায় ।

এই অজ পাড়া গাঁয়ে দুর্দান্ত আনন্দে আছি । এর মাঝে কত কিছু হয়ে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। হয়েছি আমরাও , মা-বাবাকে থোরাই তোয়াক্কা করি । মুক্তি বাহিনীর বড় ভাই দের সাথে বনে বাদাড়ে খামাখাই ঘুরে বেড়াই। ওরা দয়া করে স্টেন গানটা দিলে , গাছের ডাব , নারিকেল এর দিকে তাক করে ম্যাগাজিন শেষ করি।

সেই সময়ের কিছু অদ্ভুত ঘটনা । এর আগে আমাদের বাড়ির সামান্য বর্ণনা দেয়ার  প্রয়োজন। চুন সুরকির দেয়াল, মোটা  কাঠের কড়ি বরগা দেয়া ছাদের সেই  কবে কার তৈয়ারি দোতালা বাড়ি কারো জানা নেই । পশ্চিম পার্শে গাঁড় জঙ্গলা ভূমি ” নাপিতের ভিটা ” নামে পরিচিত । সেই দাদাদের জমিদারির সময়ে বনেদি পরিবারের নিজস্ব ধোপা – নাপিত থাকতো । তাদের বসতীর জন্যে আলাদা ভিটা মাটি দেয়া হতো ।

এখন সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যা ও নেই! পরে আছে বিশাল জঙ্গল , ভাঙ্গা উপাসনালয় । তবে ওরা নাকি নিয়মিত ভুত প্রেত পূজা করতো ।তাই পারত পক্ষে দিনে-দুপুরেও কেও যেত না ওঁই সব জায়গায়!  আমরা যেতাম।বাড়ি থেকে সকলে অগোচরে দাদার রেমিংটন দোনলা বন্দুক নিয়ে। ভুতের দেখা পেলেই গুলি করবো। কিন্তু কক্ষনোই পেতাম না। তাই বন্দুক এর নল মাটিতে অর্ধেকটা পুঁতে গুলি ছুড়তাম।গুলি বেরনোর সময় বন্দুক অনেক ধাক্কা দিতো তাই মাটিতে পুঁতার ব্যবস্থা। স্টেন গানে আবার ওই সমস্যা নাই।

আরও কত দুঃসাহসিক  কাজও যে করতাম তার ইয়ত্তা নেই। নতুন সাইকেল চালানো শিখেছি।সাথে জুটেছে শহুরে আরও কিছু এডভেঞ্চার পিপাসু কিশোর । প্ল্যান হলো রাত দুপুরে আড়িয়াল বিলের মাঝ বরাবর যে বিশাল বট গাছ এবং শ্মশান ঘাট আছে, ওই পর্যন্ত সাইকেল নিয়ে ঘুরে আসতে হবে। সাথে নেয়া কাপড়ের টুকরো প্রমাণ হিসাবে রেখে আসতে হবে। আমরা শহুরেরা শ্মশান, ভুতে-প্রেতে বিশ্বাস নেই প্রমাণ করতেই এই আয়োজন ।
বিদ্যুৎ হীন গ্রামে সন্ধ্যা নামলেই গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যায়, তার উপর সেবার শীতও পড়েছে খুব । সাথে কুয়াশা।কিন্তু আমরা পিছিয়ে যাবার বান্দা নই। মনে দুরু দুরু ভয় , মুখে সাহস নিয়ে আমরা কয়জন সাইকেল নিয়ে রওনা দিলাম। গ্রামের ভীতুর ডিম গুলি কাচারি ঘরে চাঁদর মুড়ি দিয়ে আমাদের অপেক্ষায় রইলো। ভুতে ওদের অনেক ভয়।

একসাথে চারটা বাই সাইকেল চলছে।পিছনের চাকার সাথে লাগানো ‘ডায়নামোর বাতির আলোয়’ আর কুয়াশায় আরও ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করছে । গ্রাম ছাড়তেই মিহি নরম বালি মাটির রাস্তায় সাইকেলের চাকা ঘুরাতে কষ্ট হচ্ছে । মাইল দেড় / দুই দূরে শ্মশান এবং প্রাচীন ঝুল ডাল পালা ধারী বট গাছ। ঠিক রাস্তার উপরে। হাঁট থেকে ফিরতি পথে কতো জনা নাকি ভয় পেয়েছে। নাঁকি সুরে মাছ চেয়েছে কেউ! আবার বিশাল দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, মাঝ খান দিয়ে যেতে বলেছে কাউকে।
যাহোক এমন গল্প সব গ্রামের মানুষরাই বিশ্বাস করে।আমরা করবো কোন দুঃখে? কিন্তু শ্মশান যতোই নিকটবর্তী হতে লাগলো , আমাদের প্রত্যয় সম্ভবত ততই কমতে লাগলো । এক পর্যায় দল নেতা সবচেয়ে বড় ‘কাজিন’ টি বলেই ফেললো,অনেক হয়েছে, চল এবার ফিরে যাই। কিন্তু সাথে দেয়া প্রমাণ কাপড়ের টুকরোর বাধ সাধলো। তাই বাধ্য হয়েই এগিয়ে চললাম ।
ভয়টা আসলে ছোঁয়াচে।একবার সংক্রামিত হলে ছড়িয়ে পরে এবং বাড়তে থাকে । প্রচণ্ড ভয় নিয়ে শ্মশানে পৌঁছুলাম । কাপড়ের চিহ্ন যথাস্থানে রেখে, ঘুরে ফিরতি পথে রওনা দিয়েছি। সামনে বাকি তিনটা সাইকেল একহাঁটু ধুলো ধূসরিত পথে কষ্ট করে এগিয়ে চলছে। হঠাৎ লক্ষ করলাম, আমার সাইকেলটা দু চাকা সোজা দাড়িয়ে আছে। প্যাডেল করাও যাচ্ছেনা, মাটিতে পরেও যাচ্ছেনা ! মনে হল ভুতে আমাকে এবং দু চাকার সাইকেলটাকে সুন্দর বসিয়ে রেখেছে, পড়তে দিচ্ছেনা ।
হৃদয়টা লাফ দিয়ে বেরিয়ে যাবে মনে হল।চিৎকার দিয়ে ওদের ডাকতে চেষ্টা করলাম, কিন্ত গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোলোনা ! সাহস হারালাম না।বুঝতে চেষ্টা করলাম কি হয়েছে? কেন আমি দু চাকার সাইকেলে থামা অবস্থায় বসে আছি ??? লাফ দিয়ে নামলাম, আতঙ্ক গ্রস্থ না হয়ে হাঁচর-পাঁচর করে আবার উঠে কোনোরকম অন্যদের সামিল হলাম। বাড়ি পৌঁছে সবাইকে বললাম ঘটনাটা। সকলে একবাক্যে মেনে নিলো এটা ভুতের কারসাজি । আমি কেন যেন কোন অবস্থায়ই মেনে নিতে পারছিলাম না।
পরের দিন আবার গেলাম দিনের বেলায় সেই জায়গাটায়। অনেক পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, গরুর গারি চলতে চলতে চিকন কাঠের চাকার যে খাঁদ সৃষ্টি হয়েছিলো, আমার সাইকেলের দুইটি চাকাই ওই খাঁদে পড়ে গিয়ে প্যাডেল পর্যন্ত ডুবে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো।আর আমি অজানা ভুতের ভঁয়ে ” আত্মা রাম বাবাজী খাঁচা ছাড়া অবস্থা “।

১,২৯৭ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “আমার ছোট বেলা-দুই “অদ্ভুতুড়ে গল্প”।”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    দুইটা কথা মনে হলো। এক। ভুতের ভয় মেনে নিতে না পারা, এবং সেটা ঠিক কিনা টা পরীক্ষা করতে যাওয়াটা অসাধারণ
    আর ২। আপনার ছোটবেলাটা অসাধারণ, আকাশ ভাইয়ের সাথে সহমত।

    জবাব দিন
  2. নাজমুল (০২-০৮)

    দুইটা কথা মনে হলো।
    এক। ভুতের ভয় মেনে নিতে না পারা, এবং সেটা ঠিক কিনা টা পরীক্ষা করতে যাওয়াটা অসাধারণ

    দুই। আপনি কাটিয়েছেন অসাধারণ শৈশব, আকাশ ভাই আর সামিয়া আপুর সাথে একমত 🙂

    জবাব দিন
  3. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    আেগ িক সুন্দর িদন কাটাইতাম ..............


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  4. মোর্শেদ (৯৮-০৪প.ক.ক)

    আপনি তো ভাই ছোট বেলায় ব্যাপক মাস্তিতে কাটাইছেন । স্টেন গান দিয়া ডাব পাইড়া খাইছেন। ইস্‌ কলেজে আমাদের যদি একটা স্টেন গান থাকত তাইলে আর কষ্ট করে ডাব গাছে উঠতে হত না 😡 ।


    মোর্শেদ_(৯৮-০৪)পাবনা ক্যাডেট কলেজ

    জবাব দিন
  5. রেজা শাওন (০১-০৭)

    আপনি তো ভাই ছোট বেলায় ব্যাপক মাস্তিতে কাটাইছেন । স্টেন গান দিয়া ডাব পাইড়া খাইছেন।

    ইস্‌ কলেজে আমাদের যদি একটা স্টেন গান থাকত তাইলে আর কষ্ট করে ডাব গাছে উঠতে হত না। 😡 :duel: :duel: :duel: :duel: :duel: :duel:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।