আমার বাবা-বেলা – ৩

[নয়] কানাডার প্রবাসী জীবন অনেক টানাপোড়েন। বেশ কিছুদিন চাকরীর টাকায় দিন আনা দিন খাওয়া চললো। অবশেষে আমেরিকায় একটি চাকরী জুটলো। কানাডার বেতনের তুলনায় অনেক বেশী। গিন্নীর মনটা ভারী। কিন্তু বাচ্চাগুলো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না কি ঘটতে চললো। যথারীতি চাকরীতে যোগদিলাম। র‌্যালী – নর্থ ক্যারোলিনা। টরন্টো থেকে প্রায় সাড়ে আটশো মাইল। আমাকে প্রতিটি উইকএন্ডের রাতে ওদের ফোনে গল্প বলে ঘুম পাড়াতে হতো। মানে ওরা হোম ফোনটা স্পীকার ফোনে দিতো আর আমি গল্প বলে যেতাম। এবং, এক পর্যায়ে ওরা ঘুমিয়ে পড়তো।
বড়টার মনটা খুবই শক্ত। বাইরে প্রকাশ না করলেও বেশ বুঝতে পারছিলাম সে ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পাচ্ছে। আর ছোটটা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না বলে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। একদিন সুযোগ করে আমাকে বলল:
– বাবা হোয়াই ডিড ইউ লীভ আস?
– বাবা, আমাদের টাকা দরকার। তাই বাবা ওখানে কাজ করে টাকা রোজগার করছে। আমাদের খুব শিঘ্রই অনেক টাকা হবে। তোমাদের জন্য ’টয়’ কিনতে পারবো তখন।
– ইউ নো, বাবা, ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু গো দ্যাট ফার। উই হ্যাভ অ্যা স্টোর নিয়ার আওয়ার হাউস, অ্যান্ড দেয়ার ইজ অ্যা মেশিন! আই উইল গীভ ইউ অ্যা কার্ড ফ্রম মামি, ইউ’ ল গো টু দ্যা মেশিন এন্ড দ্যা মেশিন উইল গীভ ইউ মানি!

[দশ] ছোটটির বয়স তখন চার। ভাবলাম সাইকেল চালনা তালিম দিই। ও যদিও ট্রেইনার হুইল দিয়ে ভালোই চালাতে পারে। তো ট্রেইনার হুইল খুলে ওকে বললাম, ”বাবা তুমি এখন আর বেবী নও। তাই বেবীদের যে হুইল থাকে ওটা খুলে নিলাম। তুমি শুধু প্যাডলিং করবে এবং বাবা পেছন থেকে ধরে রাখবো। এইভাবেই তুমি সাইকেল চালানো শিখে যাবে।
যেই কথা সেই কাজ।
আমরা বাপ-বেটিতে মিলে একটি পার্কে গেলাম। এবং যেভাবে কথা ছিলো, ও প্যাডেল ঘুরাচ্ছে আর আমি ওর সিট ধরে দৌরাচ্ছি। এক মিনিট পর আমি ছেড়ে দিলাম। বেচারি কিছুই টের পায়নি। প্রায় এক মিনিট পর যখন টের পেল ’শী ইজ অন হার অউন’ ওমনি এক চিত্কার দিয়ে কান্না জুড়ে দিল এবং ভয়ে সাইকেল সহ পড়ে গেল!
আমি বললাম, বাবা তো অনেকক্ষণ হলো তোমাকে ধরছিলো না। কারণ তুমিতো বড় হয়ে গেছ এবং ভালোভাবেই সাইকেল চালাতে পারছো। ও বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে সে সাইকেল চালাতে পারে। তখন সে সত্যি সত্যি একা একা কিছুক্ষণ চালালো।
বাসায় ফিরে বড় বোনটির কাছে বেশ বড়াই করে বলতে লাগলো যে সে বড় হয়ে গিয়েছে। শী ইজ অ্যা বীগ গার্ল নাউ। এবং সে ট্রেইনার হুইল ছাড়াই সাইকেল চালাতে পারে!

[এগারো] এই ঘটনাটিও আমার ছোট মেয়ের সাথে। ও তখন টডলার। মানে ওর বয়স আঠারো মাসের নীচে। ডে কেয়ারে যায়। বড়টির সাথে একই ডে কেয়ারে। কিন্তু দু’বোনের কোনো ইন্টারেকশান নেই।
তখন ডিসেম্বর মাস। ডে কেয়ারে চলছে ক্রিসমাসের উত্সব। একজন সান্‌তা ক্লজ আসলেন। ওদের গ্রুপে ছেলে মেয়েতে মিলে মোট দশ বারো জন। সান্‌তা ক্লজ যখন ওদের গ্রুপে এসে বসলেন, তখন সব বাচ্চাগুলো ভয়ে এবং বিষ্ময়ে সরে গিয়ে দূর থেকে সান্‌তা ক্লজকে দেখতে লাগলো। শুধু আমার মেয়েটি বেশ গম্ভীরভাবে হেটে হেটে সান্‌তা ক্লজের কোলে গিয়ে বসে রইলো।

[বারো] এটিকে বলা যেতে পারে আমার বাবার বাবা-বেলা। আমার বয়স কত আমি নিজেই জানি না। বড়জোড় তিন। ভাইবোনদের মাঝে সবার ছোট হওয়ায় সবার কোলে কোলে ঘুরি আর একটু আধটু কথা বলি। শুধু একটাই দোষ, আমার বোনরা যখনই কারো বাসায় আমায় নিয়ে যায়, আমার সজাগ নজড় থাকে জলখাবার কখন আসবে! আসামাত্রই আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে খাবারটি হাতে নিয়েই মুখে পুরে দিই।
এইটি আমার বোনদের খুব বিব্রতকরে অবস্থায় ফেললো। আমার তিন বোনের মধ্যে সবচাইতে ভয় পেতাম মেজো বোনকে। তো একদিন ওনি আমাকে ওনার এক বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যাবার আগে খুব করে বোঝালেন যে খাবার আসামাত্রই না খেতে। শুধু তাই নয়। তিনবার সাধাসাধি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। তারপর খেতে।
সময়মতো খাবার এসে গেলো। এবং বান্ধবী আপাটিও সাধতে লাগলেন, ”খাও!”
গুনে গুনে তিনবার হবার পর বললাম, ”মেজোপু, তিনবারতো সাধা হয়ে গেলো, এবার খাই?”
[সমাপ্ত] ♠

১,০৯৩ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “আমার বাবা-বেলা – ৩”

  1. ফেরদৌস জামান রিফাত (ঝকক/২০০৪-২০১০)

    শুধু একটাই দোষ, আমার বোনরা যখনই কারো বাসায় আমায় নিয়ে যায়, আমার সজাগ নজড় থাকে জলখাবার কখন আসবে! আসামাত্রই আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে খাবারটি হাতে নিয়েই মুখে পুরে দিই।

    শিশু অবস্থাতেই আপনার ভেতর ক্যাডেটের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল =)) =))


    যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আজহার (১৯৮২-১৯৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।