প্রথম দিন

ক্যাডেট কলেজের প্রথম দিনটির কথা আজো ভীষন মনে পরে । দিনটি ছিল ১২ই মে । গেট খোলার কথা ২ টায় । আমি, বড় আপু এবং রশিদ স্যার ১২ টার সময় পৌছেছিলাম গেট এ। আমার বাড়ি কলেজ থেকে ৮০ কিমি দূরে হবে । লক্কর মারকা বাস এ ২ ঘন্টার মত লাগল। আমার যে খুব মন খারাপ হচ্ছিল বাড়ির জন্য এমন নয় । তবু আজগুবি একটা অনুভুতি হচ্ছিল, শিহরন ও বলা যায় । সারা জীবন গ্রামে থেকেছি, প্রাইমারি পড়েছি এমন স্কুলে যার ব্রেঞ্ছির পাশের টিনের বেড়ার পাশ ছিল ভাঙ্গা , ক্লাস চলার সময় ও ওই দিক দিয়ে আমরা বের হয়ে গেছি কতবার !

গেটের ফাকা দিয়ে উকি মারি, কি সুন্দর সাজানো গোছানো চারদিক। মনে হচ্ছিল মাত্র কেউ বুঝি গুছিয়ে রেখেছে সব কিছু । গেটের বাইরে আরো অনেকে অপেক্ষা করছিল। ২ টা বাজার কিছু আগেই গেট খুলে দিল। ভিতরে ঢুকে প্রথমেই খুরশীদ স্টাফ এর খপ্পরে পরলাম। আমার ব্যাগ খুলে সব কিছু দেখলে লাগল। আমি যে রুমাল নিয়ে আসছিলাম ওই গুলতে সাদার উপর সামান্য ফুল করা ছিল। স্টাফ ঘোষনা দিল এই রুমাল নিয়ে যাওয়া যাবে না! তথাস্তু !

চারদিকে তাকিয়ে দেখি সাদা পোশাক পরা প্রায় আমাদের বয়সি কিছু ক্যাডেট ভাব নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে (কিছুক্ষন পরেই জেনেছিলাম তারা অষ্টম শ্রেনীর ক্যাডেট) । এই সাদার দল থেকে একজন বেরিয়ে এসে আমাকে তার পরিচয় দিয়ে ঘোষনা দিল ” আমি তোমার গাইড” । তার চোখে সামান্ন হতাশা হয়ত ছিল কারন আমাকে দেখতে গ্রাম্য ভুতের মতই লাগছিল। পরে জেনেছিলাম ভাল (চেহারা/গান/পরাশুনা/খেলা) আন্ডার গাইড নিয়ে তাদের ভিতর প্রতি্যোগীতা ছিল। এরপর মাসুম ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন হাউসের ভীতরে। আমার হাউস এর নাম ছিল ভাসানী হাউস। এক তলায় দেখে সামান্ন খারাপ লেগেছিল শুরুতে। গেটের ভিতরেই টেবিল পেতে বসে ছিল ক্লাস টুয়েলভ এর গ্যাং। তারা নবাগত ক্যাডেট দের টাই পরিয়ে দিত আর সামান্ন ফান করত। আমাকে আমার পরিবারের কাছ থেকে আ্লাদা করে সেখানে নেয়া হল। ভাইয়ারা আমাকে বলল তুমি আমাদের কিছু করে দেখাও। আমি সত্য কথা বল্লাম “কিছু পারি না ভ্যাআ” (অবিশাস্য হলেও সত্য যে অনেকেই আমাকে বলেছে যে আমি নাকি ক্লাস সেভেনে ভাইয়া না বলে ভ্যাআ বলতাম !!) । উনাদের পীড়াপীড়ি তে থাকতে না পেরে আমার ক্যাডেট লাইফের প্রথম ভুলটা করে বসলাম। পত্রিকায় পড়া একটা কৌতুক শুনিয়ে দিলাম !! ভাইয়ারা হেসে একজন আরেকজনের উপরে পরতে লাগল। আমি রীতিমত গরব অনুভব করতে লাগলাম !! (পরে টের পেয়েছিলাম তারা কেন এত হেসেছিল। আমার কৌতুক ক্যাডেট সমাজে এত নিম্ন শ্রেনীর ছিল যে অইটা হীট জোকসের চেয়েও বেশী হাসি এনেছিল। পরে অনেকদিন তারা আমাকে দেখলেই বলেছে “একটা জোকস বল”। বলেই হেসে দিয়েছে। আমার জোকস বলা লাগে নাই। ) এর পরে ভাইয়ারা আমাকে টাই পরিয়ে দিল। ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম টাই পরা ।

এর পরেই আমার গাইড আমাকে আমার রুম এ নিয়ে গেল। রুম নাম্বার ১০৩ ! আমাদের কলেজের রুম গুলো বেশি বড় না। আমাদের রুম এ উঠলাম আমি – ক্যাডেট নাম্বার ৮৫৮, রহমান – ক্যাডেট নাম্বার ৮৫৯ আর মনিরুজ্জামান – ক্যাডেট নাম্বার ৮৬১। আমার ক্যাডেট নাম্বার ওদের আগে হবার কারনে আমি হলাম রুম লীডার ! (এই রুম লীডার পোষ্ট টা আমার খুব ই মজা লাগত, যার একমাত্র কাম ছিল ইন্সপেকশনের সময় “রুম সাবধান” বলা। ) এরপরে ওইদিন আরো অনেক কিছু হল।ডাইনিং এ প্যারেন্টস দের আকটা নাশ্তা দেয়া হল। প্রিন্সিপালের বক্তিতা হল। এখন সময় হল প্যারেন্টস দের বিদায় নেবার। আমার পেটের নিচের দিকে কেমন যেন পাক দিতে লাগল। ওটাই ছিল আমার প্রথম বিদায় যখন আমি জানি আগামী ৮ দিন আমি আমার পরিবারের কাউকে দেখব না।

রাতে ডিনারের পর রুমে আসলাম (ডিনার এর কাহিনি আরেক ইতিহাস। কাটা চামচ এর যন্ত্রনার কারনে প্রায় কিছুই খেতে পারি নাই।) আরো কিছু কাহিনি হবার পরে লাইটস অফ এর ঘন্টি বাজ়ল। এত অবাক লাগছিল যে বলার নয়। নিজেকে রুপকথার সেই রাজকন্যার মত লাগছিল যাকে সোনার কাঠি দিয়ে ঘুম পারানো হত আর রুপার কাঠি দিয়ে জাগান হত। আর আমাদের ঘন্টা বাজিয়ে ঘুম পারানো হবে আর বাশী বাজিয়ে জাগানো হবে !! সেটা ছিল আসলেই দারুন ব্যাপার।

আসল সমস্যা শুরু হল তখন। রহমান এবং মনিরুজ্জামান দুইজনই ঘোষনা করল তারা একা এক বিছানায় ঘুমাতে পারবে না, ভয় করছে। দেখা গেল আমিই একমাত্র সাহসী !! কিন্তু তিনজন এক বিছানায় ঘুমান অসম্ভব। অনেল মুলামুলির পরে রহমান আর আমি আমার বিছানায় ঘুমালাম আর মনিরুজ্জামান ঘুমাল পাশের বিছানায়। (ব্যাপারটার মধ্যে অন্য কিছুর গন্ধ পাবার আগেই আবারো মনে করিয়ে দেই ওইটা ছিল পিসিসি তে আমাদের প্রথম রাত )। আমরা বেশ রাত জেগে গল্প করেছিলাম। যখন সবাই মানসিক যন্ত্রনার ভীতরে থাকে তখন একজন আরেকজনকে কিভাবে টেনে তুলতে পারে, এটা ছিল তার চমৎকার উদাহরন।( আমি এই দুই জনের সাথে মাত্র সাত দিন ই রুমমেট হিসাবে থাকতে পেরেছিলাম। এর পরেই আমাদের কলেজে Mix Room চালু হয়। ক্লাস সেভেনের দুইজন আর এইটের দুইজন। সেটা ছিল খুবই জঘন্য ব্যাপার।) ।

আজো প্রত্যেক ১২ই মে (আমার কলেজ ঢোকার দিন) আমি সবার আগে রহমান আর মনিরুজ্জামান কে এসএমএস করে এই কাহিনি মনে করিয়ে দেই।সেই দিনটির কথা মনে করতে দারুন লাগে !

৪,৭৪৩ বার দেখা হয়েছে

৪৭ টি মন্তব্য : “প্রথম দিন”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আজাদ ভাই, ঐ জোক্সটা এইখানেও বলেন... আমরাও একটু হাসি 😀


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. নাজমুল (০২-০৮)

    পাবনা ক্যাডেট কলেজটাকে আমার খুব ভালো লাগে 😀
    বিশেষ করে APEC। :boss:
    বেক্সকা নাইট এর ইনভাইটেশন কার্ড দেয়ার জন্য APEC এ যাই।
    গিয়ে দেখি সামনের রুমে কম্পিউটার এর সামনে একজন ভাইয়া বসে আছে শার্ট পড়ে। আমি ভাবলাম বাপরে কী ফর্মাল 😛
    কীন্তু আমার পরিচয় দেয়ার পর ভাইয়া আমাকে বললেন চলো ভিতরে যাই। ভাইয়া দাড়ানোর পর দেখলাম বেচারা হেগার্স পড়া =)) :khekz:
    আর ভিতরে তো জোসসসসসসস অবস্থা বিশাল এক বেড পুরা রুম এসি। আমার ওখানে থাকার লোভ হইসে 🙁
    আজাদ ভাই আপনার লিখা পড়ে ভাল লাগলো।
    বরিশাল এবং পাবনার সম্পর্কি আলাদা B-)

    জবাব দিন
  3. রাব্বি (১৯৯৮-২০০৪)

    আজ়াদ ভাই
    আপ্নে কই ?? লিখা জুসস হইসে। :clap: :clap:

    অনেল মুলামুলির পরে রহমান আর আমি আমার বিছানায় ঘুমালা

    অফ টপিকঃ রহমান ভাই কইলাম দেক্তে সোন্দর আসিল। বলা লাগব না আমি শুরু কইরা দিসি :frontroll: :frontroll: :frontroll:

    জবাব দিন
  4. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    দোস্ত, খুব সুন্দর লিখছিস।
    একে একে বাকি কাহিনীও লিখে ফেল।
    আর ব্লগে লাবলু ভাইকে একটু এড়াইয়া চলিস। 😉 তোর রিসিপশন হয়নায় শুনলেই মুহাহাহহাহা হাসি দিয়া রগড়ানো শুরু কইরা দিবে। (ক্লাসমেট ফিলিংস 😉 )


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  5. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    ভালো লাগল, কারণ আমিও সরাসরি একতা অজ পাড়াগাঁ থেকে সরাসরি সিসিআর এ দাখিল হওয়ায় প্রথম দিনের অনেক অভিজ্ঞতাই মিলে গেল।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  6. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    ভালো লাগলো, কত কিছু মনে করায়া দিলা ভাই :dreamy:
    আমাদের ২১শে মে'ও সামনেই।
    লিখতে থাকো প্রাণখুলে। সামনে রাজশাহী আছে, কুইক ধরে ফেলো 😀


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কচুপাতা

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।