একজন অসামান্য ক্রাচধারী

ব্যক্তিগত পর্যায়ে কর্নেল তাহের বহুদিন যাবত আমার কাছে ছিল অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে উচ্চারিত এক আজন্ম বিপ্লবীর নাম। তথাপি তার ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক জীবনের খুঁটিনাটি আমার অজানা ছিল এই সেদিন পর্যন্তও। অসংখ্য ধন্যবাদ ডাঃ শাহাদুজ্জামান স্যারকে, “ক্রাচের কর্নেল” বইয়ের মাধ্যমে আমার সে ঘাটতি খানিকটা পূরন করে দেবার জন্য। স্যারের সাথে চট্টগ্রামের বিখ্যাত বইয়ের বাসা “বাতিঘর” এ একটা সমগ্র সন্ধ্যা কাটাবার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছে। এর জন্য “বাতিঘর” এর স্বত্তাধীকারী দেবাশীষ দা-কে জানাই অশেষ সাধুবাদ। যাই হোক, “ক্রাচের কর্নেল” বইটি পড়া শেষে এবং ঐ দিন সন্ধ্যায় স্যারের আলোচনা থেকে কর্নেল তাহেরের যে সব অসামান্য বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে তা অতি সংক্ষেপে বলার ইচ্ছা থেকেই এই লেখা।
অত্যন্ত বিস্ময় ও দুঃখের বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাওলানা ভাসানী বা মনি সিং বা তাজউদ্দীন আহমেদ বা জাতীয় চার নেতা প্রমুখের মতই প্রায় বিস্মৃত, অপাংক্তেয় অবস্থান কর্নেল তাহেরের! অপর দিকে, এদেশে জিয়া হয়েছেন স্বাধীনতার ঘোষক, হু মো এরশাদ হয়েছেন সফল রাষ্ট্রনায়ক, শেখ হাসিনা হয়েছেন দেশনেত্রী, খালেদা জিয়া হয়েছেন জননেত্রী, সৎ রাজনীতিবিদের শুভ্রতা নিয়ে বিরাজ করে স্বাধীনতা বিরোধী খুনীরা! এখানেই শেষ নয়, আমরা মেন্ডেলাকে নিয়ে গান বাধি, ক্লিনটনকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হই, ওবামার ভাষন মুখস্থ করি, সৌদি বাদশাহর বংশ পরিচয় পড়ে পুলকিত হই, একজন মাহাথির মোহাম্মদের অপেক্ষায় দিন যাপন করি, কিংবা দূর থেকে কাস্ট্রো অথবা হুগো শ্যাভেজের বীরত্বে মুগ্ধ হই! আর এসবের সম্মিলিত ফলাফল যা হবার তা-ই হয়েছে; রাজনীতি আজ লাভজনক একটি ব্যবসা, রাজনীতিবিদ আজ টাকায় বেচা-কেনা হওয়া একটি পদ, রাজনৈতিক দল একটি টেন্ডার ও কমিশনভিত্তিক অর্থলোলুপ প্রতিষ্ঠান!
নিঃসন্দেহে, কর্নেল তাহের বা তার সহযোগী ব্যক্তিবর্গ বা রাজনৈতিক দল হিসেবে “জাসদ” বা তার তৎকালীন নেতৃত্বের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা বা ঘাটতি সত্ত্বেও ১৯৭৫ এর “৭ই নভেম্বর” উপমহাদেশের রাজনৈতিক পালা বদলের এক অবিচ্ছেদ্য ও তাৎপর্য্যপূর্ন দিন। অনেক পরে নেপালে মাওবাদীদের ক্ষমতা আরোহনের প্রায় ৩০ বছর আগে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক একটি প্রক্রিয়া রাষ্ট্রক্ষমতার একেবারে কাছে চলে গিয়েছিল। সে যাওয়াটা কতখানি সঠিক ছিল বা পরবর্তীতে এ দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে তার প্রভাব কি হতে পারত সে বিতর্ক এড়িয়েও অকপটে বলা যায়- সে ছিল এক কালসংক্রান্তি, যুগসন্ধিক্ষণ, অভাবনীয় মূহুর্ত! পরিহাসের ব্যাপার হল, সেই বিরাট আয়োজনকে কাবু করতে জিয়াউর রহমান অতি অল্প সময় নিয়েছিলেন। (বঙ্গবন্ধুও ব্যর্থ হয়েছিলেন এই অসাধারন মানুষটির যোগ্যতাকে যথাযথ ভাবে ব্যবহার করতে, বরং তাকে সেনাবাহিনীর ক্রয় বিভাগে বদলী করে আওয়ামী নেতাদের একাংশের প্রকাশ্য মদদে দেশে চলমান দুর্নীতিগ্রস্ততাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন) মানবতার সকল পরাকাষ্ঠাকে ভেংচী কেটে, কৃতজ্ঞতাবোধের নির্মম উপেক্ষা প্রদর্শন করে একজন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রহসনের বিচারিক নাটকের মাধ্যমে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করলেন তাহেরকে!! তাহের কী কেবলই তার প্রানরক্ষাকারী ছিলেন? তাহের যে সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন তাতে নিজের যথোচিত অবস্থান জিয়ার অজানা ছিলনা, তাহের ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার, সম্মুখ যুদ্ধে আহত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, এই ফাঁসী ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক ফাঁসী, সেদিন ঠাট্টা করা হয়েছিল একজন পঙ্গু ব্যক্তির জীবনের অধিকারকে। একজন বেসামরিক ব্যাক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাহেরকে বিচার করা হয়েছিল সামরিক আদালতে এবং যে আইনে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় সে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন, যদিও তার হত্যাকান্ড সম্পন্ন হবার পর আইনটি সংশোধন করা হয়! স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের মাথায় একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে ফাঁসীতে ঝুলতে হল অপর এক মুক্তিযোদ্ধাকে; যারা একদিন হাতে হাত রেখে শপথ করেছিলেন জীবনের বিনিময়ে হলেও এ দেশকে স্বাধীন করার!(হয়তো দেশকে স্বাধীন করার শপথের চেয়েও দেশকে স্বাধীন রাখার শপথ করাটা বেশি কঠিন!)
যদিও এ বিষয়ে সকল গবেষকের মতে ঐ সময়ে জিয়া আর স্রেফ একজন উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা ছিলেননা, একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ছিলেন না কোনভাবেই এবং তাহেরকে তিনি অবশ্যই ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা বা আক্রোশ থেকে হত্যা করেননি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন একাধারে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ঔপনিবেশিক প্রথা টিকিয়ে রাখার, স্বাধীন বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের শেষ ভরসার জায়গা, সর্বশেষ রাজনৈতিক চাল, তুরুপের তাস। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সে দায়িত্ব তিনি সুচারুরূপেই পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন!
প্রসংগ থেকে খানিকটা বিচ্যুতি হয়েই গেল। প্রসংগে ফেরা যাক। তাহেরের যে বৈশিষ্ট্যসমূহ বা গুনাবলী সমসাময়িক যে কোন ব্যক্তির ভেতরেই অতুলনীয় ছিল সেগুলোর সারকথা হল-
১)ষাটের দশকের মধ্যভাগেই তাহের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের সম্ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষা লিখিতরুপে প্রকাশ করেছিলেন।
২)রাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবনকে সারাজীবন তিনি একীভূত করে দেখেছিলেন এবং সেটা সুযোগ বা ক্ষমতা ভোগের পন্থা হিসেবে নয় বরং সংগ্রামী একটি জীবনের অংশ হিসেবে করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাহের তার ভাই-বোনদের প্রশিক্ষিত করছিলেন একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য, যার দ্বিতীয় একটি উদাহরন খুঁজে পাওয়া যায়না।
৩)আমাদের দেশে খুব কম রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক দল প্রকৃত অর্থেই এ দেশের সমাজ ও আনুষঙ্গিক বাস্তবতা বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের কোন পরিকল্পনা বা দিক নির্দেশনা লিখিতভাবে হাজির করেছেন, এই কাজটি তাহের “ সোনার বাংলা গড়তে হলে” র মাধ্যমে করে গেছেন। ( ৪২ বছর ধরে স্বাধীন বাংলাদেশ শাসন করা কোন রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে সে আশা আজ কেউ আদৌ করে কিনা আমার জানা নেই!)
৪)মহান মুক্তিযুদ্ধ সর্বাগ্রে ছিল একটি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের অমোঘ পরিনতি। তাহের মুক্তযোদ্ধাদের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী ছিলেন এবং তার সেক্টরে সে ব্যবস্থাও করেছিলেন, যা অন্য কোন সেক্টর কমান্ডারই করেননি। ( পরবর্তীতে বিবেক বিকিয়ে দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক স্খলন বা মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে চরম রাজনৈতিক বিভ্রান্তি বা রাজনীতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যের অভাব দেখলেই বোঝা যায় এ উদ্যোগটি প্রকৃত অর্থেই কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল)
৫)মুক্তিযুদ্ধের রনকৌশল হিসেবে গেরিলা পন্থা ও দেশের অভ্যন্তরে সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থানান্তরের ব্যাপারে তাহেররে প্রস্তাবনা ছিল অনন্য চৌকসতার স্মারক।
৬)স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ঔপনিবেশিক খোলসমুক্ত করে একটি দায়িত্বশীল, জনবান্ধব পেশাদার বাহিনীতে পরিনত করা ও কেবলমাত্র জনগনের অর্থে পুষ্ট না হয়ে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহনের মাধ্যমে একটি দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল সেনাবাহিনীতে পরিনত করার জন্য বিভিন্ন সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
৭)পৃথিবীর বিস্তৃত ও ব্যাপক ইতিহাসের ভান্ডারে সেনাসদস্য ও সাধরন জনগনকে একীভূত করে কোন বিপ্লবী প্রক্রিয়া গড়ে তোলার নিদর্শন নিঃসন্দেহে বিরল। এই অসামান্য কাজটি তাহের করেছিলেন অসামান্য দক্ষতায়। (এদেশে ৭ই নভেম্বর জাতীয় সংহতি দিবস হিসেবে উদযাপিত হলেও এই দিনটির প্রকৃত ইতিহাস বা এই দিনটির রুপকারকে অত্যন্ত চতুরতা ও কৌশলের সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয়!)
তাহেরের মত একজন আজন্ম বিপ্লবীর সমগ্র জীবনটাই যোগ্যতা ও সফলতার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। একটি অন্যায় হত্যাকান্ড বা ব্যর্থ অভ্যুত্থান তাকে কখনোই ম্লান করে দিতে পারেনা। কারন, “জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ,মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়।“
তাই বুঝি নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাড়িয়ে কি অপার সাহস আর দৃঢ়তায় তাহের উচ্চারন করেছিলেন-
“জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে ,
কাঁপিয়েই গেলাম ।
জন্মেছি তাদের বুকে পদচিন্হ আঁকব বলে ,
একেই গেলাম ।
জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে ,
করেই গেলাম ।
জন্ম আর মৃত্যুর দুটো বিশাল পাথর রেখে গেলাম ।
পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম ।“

৯৭১ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “একজন অসামান্য ক্রাচধারী”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    তাহেরের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নাই। কিন্তু বিপ্লবি হিসাবে তিনি ড্রিমার ছিলেন এইটাও মিথ্যা নয়।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. টিটো মোস্তাফিজ

    “জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে ,
    কাঁপিয়েই গেলাম ।
    জন্মেছি তাদের বুকে পদচিন্হ আঁকব বলে ,
    একেই গেলাম ।
    জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে ,
    করেই গেলাম ।
    জন্ম আর মৃত্যুর দুটো বিশাল পাথর রেখে গেলাম ।
    পৃথিবী অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম ।“
    :gulli2: :gulli2: :gulli2:


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।