ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প: পরিবেশগত, সামাজিক ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রভাব

গত কয়েক বছর এদেশের পত্র-পত্রিকা ও সভা-সেমিনারে ‘উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন’ প্রসঙ্গে পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা, বিতর্ক ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ হয়ে আসছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থ-বিরোধী জাতীয় সম্পদ (তেল, গ্যাস, কয়লা, বন্দর ইত্যাদি) সংক্রান্ত বিভিন্ন চুক্তি ও উদ্যোগের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা বিষয়ক জাতীয় কমিটি ধারাবাহিক আন্দোলনে নিয়োজিত আছে। এদেশের সরকার বহুজাতিক প্রভুদের স্বার্থরক্ষায় সাধারণ জনগণ এমন কি জাতীয় সংসদকে অন্ধকারে রেখে বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থ-বিরোধী চুক্তি সম্পাদন করে চলেছে, জাতীয় কমিটির আন্দোলনের বিষয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এরপরও জনগণ যখন প্রতিবাদে, প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে উঠছে লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস অথবা গুলি দিয়ে তা স্তব্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ফুলবাড়ি আন্দোলনের সময় ২০০৬ সালে সরকারী বাহিনীর গুলিতে ৩জন নিহত হয়েছেন, একজন চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন এবং আহত হয়েছিলেন শতাধিক মানুষ। জনগণের স্বার্থের পক্ষে বা বিপক্ষে উভয় প্রচারণার ক্ষেত্রেই এদেশের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের যুক্ত করেছেন। মজার বিষয় হল, যারা জনগণের স্বার্থের পক্ষে কথা বলছেন তাদের বক্তব্য একটাই এবং তা অত্যন্ত স্পষ্ট, যে কোন জাতীয় সম্পদের উপর জনগণের শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে এবং বহুজাতিক কোম্পানির সাথে জাতীয় স্বার্থ-বিরোধী কোন চুক্তি করা যাবে না। অপরপক্ষে, জনগণের স্বার্থ-বিরোধী বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন বিভিন্ন রুদ্ধদ্বার, গোপন বৈঠকে এবং মিথ্যে তথ্য, উপাত্ত ও আশ্বাসে পরিপূর্ণ বক্তব্য প্রচারে। তাদের নিশ্চয়ই জানা আছে জাতীয় সম্পদ বিদেশী প্রভুদের হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জ্বালানী বিষয়ক একটি দায়মুক্তি আইন পাশের প্রক্রিয়ায় আছে। যেটি পাশ হলে, জ্বালানী মন্ত্রণালয় কর্তৃক সম্পাদিত জ্বালানী বিষয়ক যে কোন চুক্তি এবং চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের কোন আদালতে কোনরকম মামলা করার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তারা নিশ্চয়ই জানেন, তবু তাদের কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ও বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষায় তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার কারণ জনগণ নিশ্চয়ই ভেবে দেখবে, সে দায়িত্ব এদেশের প্রতিটি সচেতন মানুষের। উম্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা এযাবৎ হয়েছে। এর সামাজিক, পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব নিয়েই আজকের আলোচনা।

মূল আলোচনায় যাবার আগে কিছু বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ফলে যে সামাজিক, পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হবে, তা শুধুমাত্র খনি এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। খনি এলাকার বিষাক্ত ও ক্ষতিকর বিভিন্ন পদার্থ বাতাস ও পানির সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়বে আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, এই অঞ্চলের নদীগুলোর দূষিত পানি দ্বারা যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীসহ তাদের অসংখ্য শাখা নদীর পানিও দূষিত হয়ে পড়বে। জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা লক্ষ লক্ষ মানুষের ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা আশেপাশের বিস্তৃত অঞ্চলকে গ্রাস করবে। এই পদ্ধতির সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হল ভূগর্ভস্থ পানি স্তরের অবলুপ্তি এবং দূষণ। ইতিমধ্যে এই অঞ্চলের কিছু নদীর উজানে ভারত সরকারের তৈরি করা বাধ ও ডোমের কারণে পানির প্রবাহ কমে গেছে আশংকাজনক হারে। এছাড়াও আছে বিভিন্ন নদীর নাব্যতা রক্ষায় বিগত সকল সরকারের সীমাহীন উদাসীনতা ও অবহেলা। সার্বিকভাবে এসবের মিলিত ফল হিসেবে অবশ্যম্ভাবী রূপে এই অঞ্চলে শুরু হবে মরুকরণ প্রক্রিয়া। পানির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল বৃষ্টি। খনি এলাকার দূষিত বায়ুস্তরের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান, যেমন- ঈঙ২, ঐ২ঝ, ঘঙ২ ইত্যাদির সংস্পর্শে প্রাণদায়িনী বৃষ্টি পরিণত হবে প্রাণঘাতী ‘এসিড রেইন’ এ। সবচেয়ে ভীতির কথা হল, বিশুদ্ধ বাতাস ও পানি প্রবাহের মাধ্যমে ইতিমধ্যে দূষিত হয়ে যাওয়া বাতাস, পানি ও মাটির বিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেননা, এই অঞ্চলের বাতাস, পানি ও মটি প্রতিনিয়ত শুধু দূষিতই হবে না, দূষণের মাত্রা, তীব্রতা ও ভয়াবহতা কেবল বেড়েই চলবে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই পৃথিবীর কোন খনি অঞ্চলেরই কিছু না কিছু ক্ষতিকর প্রভাব থাকে। কিন্তু, এত ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে সেসব ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাবে বহুগুণ। সবচেয়ে আতংকের কথা হল এই পদ্ধতির অবশ্যম্ভাবী পরিবেশগত, সামাজিক ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ক্ষতিকর দিকগুলি বা তাদের প্রতিরোধ করা বা সমাধান দেবার মত কোন বক্তব্যই চুক্তিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাসমূহ এবং দূষণ প্রক্রিয়া: ক্ষতিগ্রস্ততার কারণ, মাত্রা ও বিস্তৃতির উপর নির্ভর করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তিনটি ধরন ধারণা করা যায়।

১. খনি এলাকা: উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে সর্বোচ্চ ক্ষতির শিকার হবে মূল খনি অঞ্চল।

নিম্নোক্ত প্রক্রিয়াগুলোর প্রভাবে এর মাত্রা হবে ভয়াবহ-

বায়ু দূষণ: কোল, সিলিকা, সালফার ইত্যাদি বালুকণা এবং ঈঙ২, ঐ২ঝ, ঘঙ২ ইত্যাদি রাসায়নিক গ্যাস মিশ্রিত হয়ে সমগ্র খনি অঞ্চলের ভূমি সংলগ্ন বায়ুস্তর পরিণত হবে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন, ভারী বায়ুস্তরে। দূষণের মাত্রা এতটাই তীব্র হবে যে প্রতিবার শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার জন্য কষ্ট করতে হবে। আর প্রতিবার শ্বাস নেবার সময় শ্বাসনালী ও ফুসফুস পূর্ণ হয়ে উঠবে বিষাক্ত, ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে।

পানি দূষণ: ফুলবাড়ি অঞ্চলের কয়লার স্তরটি রয়েছে প্রায় ১২০ মিটার পুরু ভূ-গর্ভস্থ পানি-স্তরের নীচে। এর ফলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে হলে প্রথমেই এই পানির স্তরের পানি উত্তোলন করতে হবে এবং যখনই এই পানি স্তরের পানি পাম্পিং প্রক্রিয়ায় উত্তোলন শুরু হবে, সমগ্র স্তরের পানি প্রচণ্ড বেগে উত্তোলন এলাকার দিকে ধাবিত হবে। সুতরাং, উত্তরবঙ্গের পানির প্রধানতম সঞ্চয় ভাণ্ডার নিঃশেষিত করেই কেবল এই পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন সম্ভব। এছাড়া, এত পুরু একটি ভূ-স্তর হঠাৎ করে সরিয়ে ফেললে উপরের প্রতিটি স্তর অবধারিতভাবে ধ্বসের শিকার হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই উত্তোলিত পানি হয়ে দাঁড়াবে আরেক সমস্যা- একদিকে উত্তোলন প্রক্রিয়ার সময়ে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত হয়ে এই পানি দূষিত হবে এবং তা হয়ে পড়বে ব্যবহারের অনুপযোগী, আরেকদিকে এই বিপুল পরিমাণ পানি অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলনের ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা অথবা বর্ষা মৌসুমে বন্যার সৃষ্টি হবে। আর উত্তোলিত দূষিত পানি এই অঞ্চলের নদীতে ছড়িয়ে পড়লে তা শুধু ঐ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বঙ্গোপসাগর অভিমুখী স্রোতের মাধ্যমে যমুনা, পদ্মা ও মেঘনাসহ তাদের অসংখ্য শাখা নদীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং এসব নদীর পানিও বিভিন্ন মাত্রায় দূষিত হবে। সামগ্রিকভাবে পানি দূষণের ফলে এই অঞ্চলে পানি ও মাটির যে ব্যাপক ক্ষতি হবে তা কী শুধু উপাত্ত দিয়ে উপস্থাপন করা সম্ভব?

এসিড বৃষ্টি: শুধু ভূ-গর্ভস্থ বা ভূ-স্তরের বিভিন্ন জলাশয়ের পানিই নয় বৃষ্টির পানি বায়ুস্তরের বিভিন্ন রাসায়নিক গ্যাস যেমন- ঈঙ২, ঐ২ঝ, ঘঙ২ ইত্যাদি বৃষ্টির পানির সাথে মিশ্রিত হয়ে বৃষ্টির পানিকেও দূষিত করে ঘটাবে এসিড বৃষ্টি।

মাটি দূষণ: দূষণ না বলে এই অঞ্চলের মৃত্তিকাসংক্রান্ত ক্ষতির প্রক্রিয়াকে নিঃশেষণ বলাই যৌক্তিক। কেননা, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরুই হবে ভূ-স্তরের সবচেয়ে উপরের নরম, উর্বর স্তরটিকে অপসারণ করার মধ্য দিয়ে। যার ফলে এই অঞ্চলের মাটির উর্বর স্তরটি চিরতরে হারিয়ে যাবে।

২. খনি-সংলগ্ন এলাকা: মূল খনি অঞ্চলের নিকটবর্তী আরো বিস্তীর্ণ অঞ্চলও মারাত্মক পরিবেশ দূষণের শিকার হবে। বাতাস ও পানির প্রবাহের মাধ্যমে খনি অঞ্চলের ক্ষতিকর উপাদান ও পদার্থ এসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে।

বায়ু দূষণ: খনি অঞ্চলের দূষিত বায়ু নিম্নতর মাত্রায় খনি-সংলগ্ন বায়ুস্তরকেও দূষিত করে ফেলবে। দূষণের মাত্রা মূল খনি এলাকার চেয়ে কম হলেও তা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে।

পানি দূষণ: মূল খনি অঞ্চলে সংঘটিত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এই অঞ্চলেরও ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-স্তরের পানি দূষণের শিকার হবে।

মাটি দূষণ: দূষিত বাতাস ও পানি দ্বারা বাহিত বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে সঞ্চিত হবে যার ফলে মাটি দূষিত হয়ে পড়বে এবং উর্বরতা হারাবে। এছাড়া ধারাবাহিক ভাবে চরম দূষণের কারণে এই অঞ্চলের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে মাটির উর্বর স্তর বা ‘হিউমেরাস’ গঠনের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

৩. দূরবর্তী অঞ্চল: খনি অঞ্চলের দূরবর্তী এলাকাও দূষণ প্রক্রিয়ার আওতা থেকে মুক্ত থাকবে না। দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে দূষণের প্রক্রিয়াটি হবে খনি অঞ্চলের নদীগুলোর দূষিত পানি যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীসহ তাদের বিভিন্ন শাখা নদীতে প্রবাহের মাধ্যমে। এছাড়া নদীগুলির দূষিত পানির প্রভাবে নদী-সংলগ্ন দু’পারের বিস্তৃত অঞ্চলের মাটিও দূষিত হবে। এক্ষেত্রে দূষণের মাত্রা খনি অঞ্চল থেকে দূরত্বের উপর নির্ভর করবে।

ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ:

স্বাস্থ্য-জনিত প্রভাব: উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক ও অন্যান্য পেশাজীবী এবং খনি-সংলগ্ন অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্য চরমভাবে বিপদগ্রস্ত হবে। স্বাস্থ্য-জনিত সমস্যাগুলি হবে নানামুখী এবং এর মাত্রা হবে সাধারণ হাঁচি, কাশি, শ্বাসনালী ও ফুসফুস-জনিত বিভিন্ন রোগ থেকে শুরু করে অকাল মৃত্যু পর্যন্ত। রোগতত্ত্ব বিষয়ক গবেষকদের মতে, কয়লা খনির শ্রমিকদের মৃত্যুর হার সাধারণ মানুষের মৃত্যুহারের দ্বিগুণ। নিজস্ব পারিপার্শ্বিকতার আমূল পরিবর্তন, বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বায়ু, মাটি ও পানির দূষণ, অসংখ্য মানুষের জীবিকা হারানো, বেকারত্ব এবং জোরপূর্বক উচ্ছেদকৃত মানুষের পরবর্তী আবাসস্থলের ঘনবসতিপূর্ণ, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ইত্যাদি প্রক্রিয়া এই অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলবে।

খনি এলাকার বিভিন্ন বালুকণা, যেমন- কোল, সিলিকা, সালফার ইত্যাদি বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস ও উপাদান, যেমন- ঐ২ঝ, ঘঙ২, ঈঙ, ঈঙ২ ইত্যাদি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে। এর ফলে শ্বাসনালীর প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত বিভিন্ন রোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদির প্রকোপ দেখা দেবে। বালুকণাজনিত ফুসফুসের রোগগুলোকে একত্রে বলা হয়, ‘নিউমোকোনিওসিস’। যে কোন খনি এলাকার প্রায় সব মানুষই বিভিন্ন তীব্রতায় এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হন। উন্মুক্ত পদ্ধতির কারণে যার পরিমাণ বেড়ে যাবে। শ্বাস-প্রশ্বাস বা ফুসফুস-জনিত বিভিন্ন রোগের বা অসুস্থতার কারণে সমগ্র অঞ্চলের প্রত্যেকটি মানুষের কর্মদক্ষতা বিভিন্ন মাত্রায় হ্রাস পাবে, স্বাস্থ্যগত সমস্যার জন্য ব্যয় বৃদ্ধির কারণে জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচনের ফলে জীবনযাত্রার মান ব্যাহত হবে মারাত্মকভাবে, বিপুল সংখ্যক মানুষ চিরস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হবে বা অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।

শুধু বায়ু দূষণ নয় পানি দূষণের কারণেও স্বাস্থ্যহানির ঘটনা ঘটবে। ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত, এর সাথে যুক্ত হবে সালফার, সিলিকা বা বিভিন্ন রাসায়নিক এসিডজনিত বিষক্রিয়া। পানির অভাবে আবহাওয়ার আর্দ্রতা নষ্ট হওয়ার ফলে বিভিন্ন রকমের চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে।

দূষণজনিত পরিবেশের কারণে ফসল উৎপাদন, পশুপাখি পালন ও মাছ আহরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যহত হবে। যার ফলে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান বিশেষ করে প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের উৎস নষ্ট হবে। এর সাথে ঐ অঞ্চলের মানুষের বেকারত্ব ও নিম্ন আয় যুক্ত হয়ে তৈরি করবে অপুষ্টিজনিত সমস্যা। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় ১০টি শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। অপুষ্টিজনিত মৃত্যুবরণ ছাড়াও অপুষ্টির কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।

কৌতূহলের বিষয় হল, শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতা বা রোগ সম্বন্ধে আমাদের কিছু ধারণা থাকলেও পরিবেশ দূষণের সাথে অন্যান্য সামাজিক বাস্তবতার মিলিত ক্রিয়ার প্রভাবে সমগ্র অঞ্চলের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের যে ব্যাঘাত ঘটবে তা কখনোই আলোচনায় আসেনি। অথচ, রোগতত্ত্ব গবেষকদের মতে যে কোন সামাজিক ও পরিবেশগত বাস্তবতায় শারীরিক ক্ষতির চেয়ে মানসিক ক্ষতির পরিমাণ ও বিস্তৃতি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। খনি এলাকায় কর্মরত শ্রমিক ও উচ্ছেদকৃত লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে দেখা দেবে অস্থিরতা, হতাশা, বিষাদ, দুশ্চিন্তা প্রবণতা, হিংস্রতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ইত্যাদি মানসিক উপসর্গ। শুধু মানসিক উপসর্গই নয় বিভিন্ন মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি বিভিন্ন মনো-দৈহিক অসুস্থতা যেমন- অতিমাত্রায় দুর্বলতা, মাথা, কাঁধসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের তীব্র ব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, সহজেই হাঁপ ধরে যাওয়া ইত্যাদি।

সর্বোপরি বলা যায়, অপুষ্টি, পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জীবনযাত্রার মানের অবনমন, মানসিক অবসাদ বা প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি কারণে এই অঞ্চলের মানুষের উচ্চ-রক্তচাপ, হাঁপানি, পাকস্থলীর ঘা বা আলসার, ডায়াবেটিস, স্নায়ু-জনিত রোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, দ্রুত বয়স বৃদ্ধি ইত্যাদির মাত্রা বেড়ে যাবে। এবং অবধারিতভাবে গড় আকাঙ্ক্ষিত আয়ুষ্কাল কমে যাবে কয়েক বছর এবং মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাবে।

স্বাস্থ্য-জনিত এই ব্যাপক ক্ষতির প্রভাবে এবং তার চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে। যার হিসেব অবশ্যই করা প্রয়োজন। অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষতির সাথে এটিকেও যুক্ত করে দেখা দরকার।

সামাজিক প্রভাব: জোরপূর্বক উচ্ছেদ, বেকারত্ব, অপুষ্টি, ঘনবসতিপূর্ণ মানবেতর বাসস্থান, প্রতিনিয়ত শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি এ অঞ্চলের মানুষের ভিতরে হতাশা, ক্ষোভ, বিষাদ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ইত্যাদির জন্ম দেবে। এছাড়া মাদকাসক্তি ও বিভিন্ন সমাজবিরোধী, নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ড সমগ্র অঞ্চলকে একটি সামাজিক অপরাধপ্রবণ অঞ্চলে পরিণত করবে। সামাজিক অস্থিরতা, পারষ্পারিক সংঘর্ষ ও সংঘাত এবং সন্ত্রাস পুরো এলাকার সামাজিক বাস্তবতাকে গ্রাস করবে।

পরিবেশ দূষণ, বেকারত্ব, রোগাক্রান্ত হবার হার বা সম্ভাবনা, মৃত্যুহার ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রভাবের সম্ভাব্য একটা গাণিতিক হিসেব তাও দাড় করানো যায়। কিন্তু পূর্বপুরুষের ভিটে-বাড়ী, শৈশবের খেলার মাঠ, কৈশোর জুড়ে ছুটে বেড়ানো ফসলী প্রান্তর থেকে জোরপূর্বক চিরতরে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের বেদনার ভার পৃথিবীর কোন পাল্লায় মাপা হবে? স্থাবর সম্পত্তির মতই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া সামাজিক সম্পর্কগুলো, তথাকথিত উন্নয়নের স্রোতে ভেসে যাওয়া মানবিক বোধগুলো, গৃহত্যাগী অজস্র মানুষের মিছিলে হারিয়ে ফেলা চির চেনা প্রিয় মুখগুলো কিংবা সমগ্র জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতিভূমির অধিকার হারানোর ব্যথা অশ্রু“র নীরব সাগরে নিত্য যে ঢেউ তুলে যাবে, তার পরিমাপ কীভাবে করবেন আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী বা তাদের বহুজাতিক প্রভুদের উচ্ছিষ্টভোগী অনুচরেরা? ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে জোরপূর্বক সমতলের বাঙ্গালী পুনর্বাসনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। ভারতের জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার স্বার্থে শুরু হয়েছে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ। ন্যূনতম মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ আদিবাসী জনগণ যখন মরণপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন, মাওবাদী আখ্যা দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্য শুরু হয়েছে জাঁকজমকপূর্ণ সামরিক সজ্জা। একই প্রক্রিয়া ও পরিণতির শিকার হয়েছে পৃথিবীর সকল খনি অঞ্চলের ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সাধারণ জনগণ (কয়েকটি দেশ বা খনি অঞ্চল অবশ্য এর ব্যতিক্রম, কিন্তু তা শুধুমাত্র ঐ দেশগুলির সরকারের অনমনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে)। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়া আজো হঠাৎ চমকে ওঠে খনিজ সম্পদের লোভে সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও প্রতিষ্ঠানের গণহত্যার তাণ্ডবে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া রেড ইন্ডিয়ান বা অ্যাবোরোজিনদের কথা ভেবে।

কোন এক দূর দেশের কল-কারখানার যন্ত্রে যখন এদেশের কয়লায় প্রাণ স্পন্দিত হবে, এদেশের খনি অঞ্চল পরিণত হবে মৃত্যুপুরীতে, এদেশের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ সংকট পৌঁছাবে সর্বশেষ পর্যায়ে। এই পরিণতি নীরবে দেখে যাবার জন্যই কী আমাদের বেঁচে থাকা? অক্ষম আবেগ দিয়েই কী ব্যর্থ করে দেয়া যাবে গভীর, সুনিপুণ এই চক্রান্ত? ফুলবাড়ির শুষ্ক মাটি যে লক্ষ লক্ষ মানুষের অশ্রু“জলে সিক্ত হবে, যাদের বুকের রক্তে রঞ্জিত হবে কালো ভূমি, তাদের ব্যথা যদি আমাদের স্পর্শ না করে, ২০০৬ সালে ফুলবাড়ি আন্দোলনে শহীদদের চরমতম আত্মত্যাগ যদি ব্যর্থ হয়ে যায়, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমাদের মনুষ্যত্বের দাবী, নিজেদের মানুষ বলার দাবী?

২,১৫৭ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প: পরিবেশগত, সামাজিক ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রভাব”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    পোষ্ট ভালো লেগেছে। অনেক কিছু আগে থেকে জানা-থাকার কারণে বক্তব্যও সহজে বোঝা গেছে।

    একটা কথা, তোমার নিজের ফিল্ডে- অর্থ্যাৎ ডাক্তারিতে- অনেককিছুই আছে যা' আমরা আম-জনতা জানি না। সেসবের মধ্যে নিশ্চয়ই কত না মজার-আকর্ষনীয়-গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে! আমাদের ব্লগে অনেক ডাক্তার আছেন জানি, কিন্তু তারা এখনো সেইসব বিষয়ে লিখা শুরু করেননি। তোমার লেখার ষ্টাইল আর লেগে-থাকা দেখে মনে হলো তুমিও ত' শুরু করতে পারো এই দিকটায় খানিকটা নজর দিতে।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    লেখাটা কয়েকবার ফিরে ফিরে পড়লাম।
    তোমার কাব্যিক আর হৃদয়স্পর্শী গদ্যের কথা বলতেও
    কেমন ভারাক্রান্ত বোধ করছি।
    খুব অসহায় লাগে নিজেদের,
    এমন বর্তমান আর ভবিষ্যতের কথা ভাবলে।

    জবাব দিন
  3. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    এখনও কিছুটা হালকা মাথায় আছি। লেখাটা পড়ে মতামত জানানোর ইচ্ছা রইলো। বিষয়টাতে আমার খুব আগ্রহ আছে।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  4. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ধন্যবাদ আসিফ মর্মস্পর্শী এই বিবরণের জন্য। একটা জ্বালানি ক্ষুধার্ত দেশের জন্য এই কয়লা তো দেখি ভীষণ বিপজ্জনক! তুমি যেসব সমস্যার কথা বলেছ, তা সংগ্রাম কমিটির বদৌলতে আমরা সবাই জানি। আমরা এটাও জানি এই মূহুর্তে যদি জাতীয় গ্রীডে ৩ হাজার এবং আগামী ৫/৭ বছরে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে পারি দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দুই অংকে পৌঁছুবে। সারা বিশ্ব উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলছে। ধনী যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অষ্ট্রেলিয়া, চীন থেকে ভারত পর্যন্ত। জনবহুল দেশ থেকে জনবিরল অঞ্চলেও কয়লা তোলা হচ্ছে। স্বাস্থ্য, পরিবেশ, পূনর্বাসন, কর্মসংস্থান সব কিছু করেই এটা হচ্ছে। সমস্যা শুনতে শুনতে শেষ ভাইয়া। সমাধান দাও।

    আবার বলে বসো না বিদেশি কোম্পানির টাকায় আমি জার্মানি, অষ্ট্রেলিয়া ঘুরে এসে তাদের পক্ষে লিখতে বসেছি! ভালো থেকো।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

      সানা ভাই, ধন্যবাদ।
      ১।যে কোন মূল্যে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির সক্রিয় বিরোধিতায় অংশগ্রহণ করা। :gulti:
      ২।জাতীয় সম্পদ উত্তোলন ও ব্যবহারের উপযোগী অবকাঠামো ও জনবল ৈতরী করার জন্য সরকারের উপর তীব্র চাপ বজায় রাখা। :chup:
      ৩।জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রতি অংগীকারবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান করা। :bash:

      জবাব দিন
      • আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

        ১।সারা বিশ্বের কোথাও ১৫০ মিটারের বেশী গভীরতায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হচ্ছেনা।কারণ তাতে উত্তোলন ব্যয় এত বেশী হবে যে কয়লা উত্তোলন লাভজনক হবে না।
        ২।জনবহুল দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু খনি অঞ্চলগুলো জনবসতিহীন বা ইতিমধ্যে সে এলাকাগুলো থেকে জনগণকে অন্য অঞ্চলে পুনর্বাসিত করা হয়েছে যেমন- জার্মানী। আর যেখানে মাত্র কয়েক হাজার মানুষও বাস করে সেখানে আন্দোলন বা আলোচনা চলছে যেমন- অস্ট্রেলিয়া,ভারত।

        জবাব দিন
        • সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

          আসিফ, পদ্মা সেতু করতে প্রায় ৭৫ হাজার মানুষকে সরাতে হচ্ছে। বাংলাদেশে যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য উচ্ছেদের বিকল্প নাই। ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪ বা ৬ লেন সড়ক করতে গেলে লাখ লাখ মানুষ উচ্ছেদ করতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে পূণর্বাসন, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। যমুনা সেতু পূণর্বাসনে আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলাম।


          "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

          জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আসিফ, দেশীয় কোম্পানিকেই কাজ দাও। যোগ্যতা বাড়াও। বাইরে থেকে প্রশিক্ষণ করিয়ে আনো। কিন্তু কয়লা আমাদের লাগবে। আর খনি পদ্ধতিতে কয়লা তোলা আমাদের জন্য বিলাসীতা। মোট মজুদের মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা তুলে আমরা কি করবো? ছোট ছোট কয়েকটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র? এমনকি স্টিল মিলও করতে পারবো না! এর বিপরীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে আমরা মজুদের ৯০ শতাংশ কয়লা তুলতে পারবো। অর্থাৎ তোমার ভাষায় "জাতীয় সম্পদের" সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যাবে। আর খনি পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে গেলে জ্বালানির জন্য, কাঁচামালের জন্য বিদেশের উপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
    সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে দুই/তিন লাখ মানুষের পূণর্বাসন, কর্মসংস্থান খুব কঠিন কাজ মনে করি না। এটা নিশ্চিত করার জন্য সমাজের বিভিন্ন অংশের লোকজনকে নিয়ে একটা স্থায়ী তদারকি কমিশন করা যায়। বিশ বা ত্রিশ বছর পর যখন ব্যবহৃত কয়লা খনির জমি ফেরত আসা শুরু করবে সেখানে আদি বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা যায়।
    পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে সারা বিশ্বে। পরিবেশ আন্দোলন আরো জোরদার হবে। কিন্তু দেশের বা বিদেশের আন্দোলনকারীরা আমাদের জ্বালানি বা বিদ্যূৎ দেবে না। আবার বিকল্প জ্বালানি আমাদের যে দ্রুত প্রবৃদ্ধি দরকার তাও নিশ্চিত করতে পারবে না। তাহলে বিকল্প তোমার-আমার। কয়লা আমরা মাটির নিচে রেখে দেবো, নাকি তুলে দেশের উন্নয়নে সর্বোচ্চ ব্যবহার করবো।
    তুমি নিশ্চয়ই জানো ভারত মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা করছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করছে। আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হলে আমরাও সেরকম কিছু করতে পারতাম। কিন্তু হায়, আমরা দারিদ্র ফেরি করি। নজরুল শিখিয়ে গেছেন, "হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান!" আমরা মনে-প্রাণে সেটাই বিশ্বাস করি। কিন্তু বাকি বিশ্ব বসে নেই। প্রতিবেশি ভারতও নিজেদের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য যখন বড় বড় প্রকল্প হাতে নিচ্ছে, তথন আমরা নিজেদের সম্পদও কাজে লাগাবো না!


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

      সানাউল্লাহ ভাই,
      ১।আমার বক্তব্য একই-নিজেদের সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা চালাতে হবে।
      ২।বিদেশী কোম্পানীকে কাজ দেয়ায় আপত্তি থাকার কিছু নেই যদি চুক্তিপত্রে আমাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।
      ৩। ফুলবাড়ীর বিষয়টিতে পুনর্বাসন ছাড়াও আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হল এ অঞলের কয়লার স্তর ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ণীচে।অন্য বিষয় গুলি বাদ দিলেও শুধুমাত্র এই পানি স্তর ধ্বংসের প্রভাব ভয়ংকর হবে।
      ৪। জ্বালানী সংকট নিয়ে আরো আগে থেকেই আমাদের চিন্তা শুরু করা উচিত ছিল।অন্ততঃ আর সময় ক্ষেপণের কোন সুযোগ নেই।কিন্তু সে দিকগুলি নিয়ে চিন্তা না করে তাড়াহুড়ো করে এশিয়া এনার্জিকে কাজটা কেন দিতে চাওয়া হচ্ছে?এর আগে আরেকটি বিদেশী কোম্পানী একই ইচ্ছা নিয়ে এসেছিল,কিন্তু ফুলবাড়ীর ক্ষেত্রে লাভজনক হবেনা বলে তারা ফিরে গেছে।
      ৫। আমাদের গ্যাস উত্তোলন নিয়ে চলছে চরম উদাসীনতা ও দূর্ণীতি।
      ৬।আমার লেখার এক জায়গায় আমি বলেছি,পৃথিবীর ইতিহাস বলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোন দেশ এই সমস্যার সমাধান শুধু প্রযুক্তিগত ভাবে করতে পারেনি।আর জাতীয় সম্পদের উপর মালিকানা প্রতিষঠা করতে গিয়ে ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার অনেক রাষট্রপ্রধান নিহত হয়েছে তথাকথিত আততায়ীর হাতে। আর ল্যাটিন আমেরিকার জনগণকে দীর্ঘ্য আন্দোলন করতে হয়েছে।সেখানে কিন্তু গত শতকের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনগুলো জাতীয় সম্পদের উপর মালিকানা প্রতিষঠার আন্দোলন থেকেই শুরু হয়েছিল।মানে, আমরা জ্বালানী খাতে উন্নতি করব আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তা চেয়ে চেয়ে দেখবে এটা ভাবার কোন সুযোগ নেই।
      ৭। আমরা মোটেই দরিদ্র নই।যদিও এই চাপিয়ে দেয়া দারিদ্রের বৃত্ত ভাংগার কোন আগ্রহ আমাদের জাতিমানসে এখনো আমি দেখতে পাইনা।তবে ব্যক্তিজীবনে কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে আসার সীমাহীন চেষটা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।এই চেষটাটাকেই জাতীয় জীবনে সফল করার ইচ্ছার অভাব আমাদের মাঝে তীব্র।কোন সরকার বা রাজনৈতিক দলের মুন্ডুপাত করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এই বোধটা আমাদের মাঝে আসা খুব দরকার,পাশাপাশি ব্যক্তি বা সমষটিগতভাবে যতটুকু পারা যায় বিভিন্ন উন্নয়ন বা সমাজসেবামূলক কাজে নিজেদের যুক্ত করতে হবে।অর্থাৎ সংগ্রামটা চালাতে হবে নিজের ব্যক্তিগত,পারিবারিক,সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান থেকে,মানে জীবনের সর্বক্ষেত্রব্যাপী।আমার স্ত্রীকে অধিকার না দিয়ে রাজপথে নারী অধিকার নিয়ে আমরা অনেক গলা ফাটিয়েছি,তাতে নিজেদের কর্ম ও চিন্তার দন্দ্ব প্রকাশিত হওয়া ছাড়া আর কোন লাভের লাভ হয়নি।

      জবাব দিন
  6. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    আসিফ একটা জিনিষ বুঝলাম না, যদি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভেদ করতে হয় তাহলে তো খনি বলো বা উন্মুক্ত বলো যে কোন পদ্ধতিতে এই সমস্যা থাকবে। খনি পদ্ধতিটিতে কী কোন আলাদা গার্ডের ব্যবস্থা আছে? যদি থাকে তাহলে তো সেটা দুটো পদ্ধতি্র জন্যই উপযুক্ত হবে।
    যে পদ্ধতিতেই এ্টা করা হোক না কেন কিছু মানুষকে জায়গা ছাড়তে হবে। আন্দোলনের সাথে যদি এটাও যোগ হয় যে যেই দেশের কোম্পানি এই কাজ করবে সেই দেশে সে সব পরিবারগুলোকে অভিবাসী করতে হবে তাহলে কেমন হয়?


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।