আমি যেভাবে ক্যাডেট হইলাম…এবং অতঃপর – ৩

(শুরুতে নাম ছিল ‘প্রথম দিন…প্রথম মাস…প্রথম টার্ম’। পরে দেখলাম যেভাবে লিখতেছি তাতে টাইটেলটা ঠিক যাচ্ছে না। তাই নাম পালটে দিলাম।

এই লেখাটা আগেই লেখা। পোস্ট করতে গিয়ে দেখি সিসিবি ডাউন…যেদিন আপ হলো অফিসে দেখলাম কিন্তু লেখা সাথে ছিলো না, বাসায় এসে পোস্ট করতে গিয়ে দেখি সিসিবি আবার ডাউন! লাভের লাভ হলো এখন আপ হবার পর এডজুট্যান্ট বাদে প্রথম লেখাটা আমিই দিলাম……হেহ হেহ…)

আগের লেখাঃ
আমি যেভাবে ক্যাডেট হইলাম…এবং অতঃপর – ১
আমি যেভাবে ক্যাডেট হইলাম…এবং অতঃপর – ২

৩. ইজ্জতহানির আগে ও পরে
(প্রথমেই বলে রাখি ভাইবা আগে হইসে না মেডিক্যাল আগে হইসে সেইটা আমার মনে নাই। মেডিক্যাল পরে হইসে এইটা ধরে নিয়ে লিখতেসি……)

বাসায় সবার থেকে বিভিন্ন ধরণের উপদেশমূলক বাণী যেমন ‘ঢুকেই সালাম দিবা’, বা ‘বসতে বলার আগে পর্যন্ত খবরদার খবরদার বসবা না’ ইত্যাদি ইত্যাদি ভালোমতন গলধকরণ করে আমি গুটিগুটি পায়ে টাইম মতন আমার ভাইবা দেবার জন্য সেন্টারে পৌছাইলাম। দেখি আরো ১০/১২ জন আগে থেকেই পাংশু মুখে বসে আসে। কাঠের বেঞ্চি ছিলো মনে হয়। কেউ কারো সাথে কথা বলতেসে না……সবাই চিন্তিত চেহারায় কি কি জিজ্ঞেস করতে পারে সেসব চিন্তা করতে মহা ব্যস্ত। আমার সমস্যা হলো……আমি আবার সাধারণ জ্ঞানে সেইরকম অসাধারণ ছিলাম। রিটেনের আগে দিয়ে অনেক কষ্টে সৃষ্টে কিছু ঠেলে গুতিয়ে শর্ট টার্ম মেমরিতে ঢুকাতে পারলেও ওগুলো দরকার মতন কিছুতেই মনে করতে পারতাম না। জিজ্ঞেস করলে ‘হা’ করে তাকায়ে থাকি। বেইজ্জতির মধ্যে পড়লে কিভাবে বাঁচবো……এই সব নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবা শুরু করলাম।

আমার পাশে যে ছেলেটা বেঞ্চিতে বসেছিলো, হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, এই ওয়ার্ল্ড কাপে প্রথম সেঞ্চুরি করলো তার নাম কি জান?’ আনন্দে আমার দাঁতগুলি সব বের হয়ে গেলো। কোয়েশ্চেন কমন পরসে। ইনফ্যাক্ট, ’৯৬এ নিউজিল্যান্ডের ওপেনিং ম্যাচটা আমি পুরাটা দেখসিলাম। মনে মনে বললাম, ‘গাধাহালা, খ্যালা দেখস নাই ক্যান!’ আর পায় কে! সামান্য ‘আমি কি হনু রে’ টাইপ ভাব নিয়ে মুখে বললাম, ‘নিউজিল্যান্ডের নাথান এস্টেল’ (ওরে যে এসলে বলে, সেইটা তখনো টের পাইনাই…)। সেই ছেলে তখন বার কয়েক ‘নাথান এস্টেল…… নাথান এস্টেল…নাথান এস্টেল… নাথান এস্টেল……’ বিড়বিড় করে আবার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘নাথান… কি?’

একসময় কল আসলো ভাইভা রুমে ঢোকার। ঢুকেই দেখি তিনজন একটা টেবিলের তিনদিকে বসে, যতদূর মনে পড়ে……তিনজনই ইউনিফর্ম পড়া। বসতে বললো, বসলাম। চোখের কোনে তাকায়ে দেখি এক কোনায় একটা বিশাল ম্যাপ টাঙানো। দেখে আত্মাটা একদম শুকায়ে গেল! আমার তখন এমনি অবস্থা যে……বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ছাড়া কিছুই বের করতে পারিনা! তাতেও আবার সামান্য টাইম লাগে। আর ভাগ্যটাও এমন! প্রথমেই আমাকে কম্বো না কম্বোডিয়া কিজানি একটা ম্যাপে বের করতে দিলো! আমি গিয়ে ম্যাপের সামনে হাবার মতন দাঁড়ায়ে থাকলাম। দুনিয়ার সব দেশ চোখে পড়তেসে…কিন্তু যেইটা বাইর করতে দিসে সেইটা আর কিচ্ছুতেই খুঁজে পাইতেসি না! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হতাশ হয়ে একজন বললো,’আচ্ছা, বলো ওইটা কোন মহাদেশে?’ আমি সন্দেহের সুরে ওনাকে বললাম, ‘আফ্রিকা?’ বললেন, ‘ঠিকাছে। তাইলে আফ্রিকাটা কোথায়?’ আমি তখন প্রানপণে আফ্রিকা খুঁজতে লাগলাম। ১/২ মিনিট পরে……(আমি তখনো আফ্রিকা খুঁজে যাচ্ছি)…… আমাকে বললো, ‘ঠিকাসে, বুঝছি! চলে আসো এইদিকে।’ গিয়ে আবার চেয়ারে বসলাম। ততক্ষণে আমার ক্লাস ওনারা ভালোই বুইঝে গেসেন। সেই জন্যেই মনে হয় ‘কোনটা বেমানান – গরু, মুরগি, ছাগল, ভেড়া, মাখন?’ এই টাইপ একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম। উনারাও খুশি, আমিও খুশি।

এইবার শুরু হলো আসল ভাইভা (?)! আমার অপজিটে বসা, উনি মনেহয় আর্মির প্রিন্সিপাল কোনো কলেজের……আমার এপ্লিকেশন ফর্মটা খুলে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার যেই ছবিটা দিসো, এখানেতো দেখি একদম ভুরু টুরু কুচকানো মহা বিরক্ত একটা ছবি দিসো! কেন?’ আমি তখন উকি ঝুকি মেরে আমার চাদবদনের ফটুখানা দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। সেইটা দেখে উনি নিজেই ফাইল বাঁকা করে আমাকে দেখালেন। আমি দেখে আমার চোখমুখ কুচকানোর ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গিয়ে বললাম, ‘কি বলেন স্যার! আমার কাছে তো মোটেও বিরক্ত চেহারা মনে হচ্ছে না!’ উনি তখন চোখ সরু সরু করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মনে হচ্ছে না?’ আমি কাচুমাচু গলায় বললাম, ‘স্যার, আমার মনে হয় ছবি তোলার সময় ফ্ল্যাশ লাইটটা ডাইরেক্ট চোখে পড়সিলো…এই জন্য সামান্য বিরক্ত মনে হলেও হতে পারে……এটা স্যার আপনার চোখে পড়লে আপনারও এরকম হতে পারতো। তবে আমার কাছে স্যার মোটামুটি নরমালই মনে হইতেসে’। উনি এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন। ওনার কাছে নরমাল মনে হয় নাই। বললেন, ‘দেখো ইয়াং ম্যান, একজন ক্যাডেট কে অনেক কষ্ট করতে হয়। পিটি,প্যারেড,পড়াশোনা……আমরা চাই যে একজন ক্যাডেট হাসি মুখে এইসব করবে……তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যাও……। তুমি কি হাসি মুখে এইসব করতে পারবা?’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই স্যার! আমি তো এম্নিতে সবসময়ই হাসি খুশি থাকি।’ বলে ওনাদের দিকে তাকায়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলাম। ওনাদের চেহারা দেখে হাসিটা উনারা খাইসে – এরকম কোন আলামত পাইলাম না। আমাকে বললো, ‘ঠিকাছে, তুমি যেতে পারো।’ এইটুকুই ছিলো আমার ভাইভা!

গিয়ে বসলাম মেডিক্যালের বেঞ্চিতে। এখানেও আমার আগে ৩/৪ জন ওয়েইট করতেসিলো। দেখি নার্ভাস একেকজন সাদামুখ নিয়ে ঢুকে আর লাল মুখ নিয়ে বের হয়। কাহিনী কিছুই বুঝতেসিলাম না। ইজ্জতহানির আশু ওয়ার্নিং আমারে আগে থেকে কেউ দিয়া রাখে নাই। সিরিয়ালে যখন আমার ডাক আসলো, তখন দরজা দিয়ে ঢোকার আগে দেখি দরজার চিপা দিয়ে রুমের ভিতর সামান্য দেখা যাইতেসে। দেখি আমার আগে যেই পোলাটা ঢুকলো সে একটা আন্ডারওয়্যার পরা, প্যান্ট পরতেসে! আমি ভাবলাম এইসব কি! প্যান্ট খোলায় ক্যান! আমারে তো এইসব কেউ আগে বলে নাই! তবে বাচোয়া যে আন্ডারওয়্যারটা রাখতে দিসে! নাইলে তো ইজ্জত একদম গেসিলো! ভিতরে ঢুকলাম, আমারে বললো…… ‘খুলো।’ আমি বললাম, ‘কি খুলবো?’ বলে, ‘প্যান্ট খুলো।’ কি আর করা! প্যান্ট খুলে দাঁড়ায়ে গেলাম। বলে, ‘ওইটাও খুলো।’ আমি ভাবলাম, ‘হায়! হায়! এইসব কি বলে!’ লজ্জার মাথা খায়া আন্ডারওয়্যারও খুলে ফেললাম। দেখি বেশ বাতাস টাতাস লাগে……লজ্জায় গা ও কেমন জানি উষ্ণ উষ্ণ লাগা শুরু করলো! এইবার আঙ্গুল দিয়ে জায়গামতন চিপি দিয়ে বলে, ‘কাশি দেও’। দিলাম। বলে, ‘হয়নাই, জোরে দেও।’ জোরে দিলাম। চিপাচিপি করে তাদেরকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হলো। সেই অবস্থাতেই আমার হাইট মেপে চোখের টেস্টগুলি করাইতে লাগলো। ততক্ষণে আমি মোটামুটি এডজাস্ট করে ফেলসি। খালি অদম্য লজ্জাবোধ থেকে মনে হয় শরীর সামান্য গরম গরম লাগতেসিলো। একসময় মেডিক্যাল টেস্ট শেষ হলো। বাকি সবার মতন আমিও লালমুখ নিয়ে বাইর হইলাম। চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম ফ্যাকাশে সাদা মুখ নিয়ে পরের বেচারা ঢুকতেসে……

মেডিক্যাল টেস্টের পরে ঠিক করে রাখসিলাম……যা হইসে হইসে……এই ঘটনা কাউরে বলা যাবে না। মাথা খারাপ নাকি! ফ্রেন্ডদের বললে টীজ খায়া উইড়া যাবো! আব্বা আম্মা জিগায়, ‘কেমন হইলো?’ আমি বলি, ‘ভালোই হইলো।’ ভাইবাতে উনারা এইটা এইটা বলসে, আমি এইটা এইটা বলসি। ‘মেডিক্যালে?’ ‘এইতো, হাইট ওয়েট এইসব দেখলো…… অনেক রঙের মধ্যে রঙ্গিন অক্ষর চিন্তে পারি নাকি দেখলো……এই সব আরকি!’ ধরাটা খাইলাম, আমার বিশিষ্ট ক্যাডেট এক্সপার্ট বড়খালা বেড়াইতে আসলেন একসপ্তাহ পরে। উনার দুইছেলে ক্যাডেট। আম্মা বললেন, ‘আশিক তো ভাইবা আর মেডিক্যাল দিয়ে আসলো’। শুনে উনার প্রথম রেসপন্স হলো, ‘ও, মেডিক্যাল দিয়ে আসছে? প্যান্ট খুলে দেখসে?’ আম্মা বলে, ‘সে কি! প্যান্ট খুলে আবার কি দেখবে! ও তো এইসব কিচ্ছু বলে নাই!’ আমারে ডাকা হইলো। বুঝলাম, বড়খালা এক্সপার্ট, উনার সামনে খামাখা চাপা মাইরা লাভ নাই। কোনরকমে মুখ কালো করে বললাম, ‘হ্যা, খুলতে হইসে’। বলেই দৌড়। পিছনে আবছা শুনলাম বড়খালা বলতেসে, ‘আমি তো জানিই…ওরা প্যান্ট খুলে দ্যাখে…’

এর মধ্যে একদিন রেজাল্ট দিয়ে দিলো। দেখি ওইরকম ভাণ্ডারী ভাইভা দিয়েও চান্স পেয়ে বসে আসি! নিজের পারফরম্যান্সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সমস্যা হলো, আমার আরেক মামাতো ভাই আসলো। উনি আবার নতুন এয়ার ফোর্সে ঢুকসেন। আম্মাকে বলেন, ‘ফুপু, ওকে যে ক্যাডেট কলেজে দিবেন, ওখানে তো অনেক কষ্ট।’ আম্মা বলে, ‘কেমন কষ্ট?’। মামাতো ভাই বলে, ‘আমাদেরকে তো হাড়কাপানো শীতের মধ্যে শাওয়ারের নিচে দাড় করায়ে রাখে। আবার কমোডের মধ্যে মাথা ঢুকায়ে ফ্ল্যাশ টেনে দেয়…ইত্যাদি ইত্যাদি।’ শুনে আম্মার অবস্থা টাইট। আমাকে ডাক দিয়ে বলে, ‘চান্স পাইসিস ভালো কথা, যাওয়ার দরকার নাই।’ কিন্তু আমিতো ইজ্জত হারায়ে ক্ষেপচুরুনিয়াস। নেংটাও হইলাম আবার গেলামও না! তাইলে কেম্নে কি! বললাম, ‘কষ্ট করে পড়ালেখা করে চান্স পাইসি…এখন যাবো না মানে! একশবার যাবো।’ এদিকে আব্বা তখন লেফট রাইটের স্বপ্ন দেখা শুরু করসে। পারলে নিজেই ক্যাডেট হয়ে ঢুকে পড়ে! তাল দিলো……বলে, ‘কষ্ট আবার কি! লেফট রাইট করবে, পিটি করবে…… ’ বলতে বলতে উনি স্বপ্নে বিভোর! এদিকে ক্যাডেট কলেজে থেকে আবার জিনিষপত্রের লিস্ট পাঠাইসে। সেই লিস্টি দেখে দেখে অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিষ কেনা শুরু হলো যেগুলা আমি আগে জীবনেও দেখি নাই! ধবধবে সাদা বেড শীট, কিস্তি টুপি, বদখত পাঞ্জাবী, নীল রঙ্গের স্লিপিং ড্রেস……ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশাল একটা সবুজ রঙের ব্যাগ বোঝাই করে এইসব হাবিজাবি জিনিষ নিয়ে ১৯৯৬ সালের জুন মাসের ৪ তারিখ আমি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ঢুকলাম……

চলবে……

২,০৬০ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “আমি যেভাবে ক্যাডেট হইলাম…এবং অতঃপর – ৩”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    আপনি ভিজুয়াল মোডে কোড ইউজ করসেন এইজন্য। সার্ভারের ফাইল পারমিশন এর জন্য এডিটর এর অপশনগুলো ঠিকঠাক কাজ করছেনা।কমেন্ট রিপ্লাইও ডিসএবলড আছে। ছোট ছোট ঝামেলাগুলা কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।

    ১.৫ কেবিপিএস স্পীড নিয়া সাইট মেইন্টেইন করার দু:খ কারে বোঝামু কন :((


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  2. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    আশিক,

    মেসে রুমে একা একা সেহরী করছিলাম আর তোমার লেখা পড়ে হো হো করে হেসে উঠছিলাম। আমার ব্যাটম্যান মনে হয় ভাবতেছিলো যে ওর স্যার পাগল হয়ে গেছে।

    অদ্ভুৎ লেখার ক্ষমতা তোমার। অসাধারণ। অনেকদিন ধরে এত মজা পাইনি কিছু পড়ে।

    তাড়াতাড়ি বাকিটা লিখে ফেল। তর সইছেনা আর।

    জবাব দিন
  3. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    জিহাদ এন্ড কোং এর জন্য আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল কষ্ট করে আবার সিবিসিকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলার জন্য।
    আশিক লেখাটা কন্টিনিউ করো খুব মজা পাইতাছি।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তৌফিক (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।