ও ফাসানি…বলে যাও…

কখনো যদি একগাদা মানুষকে প্রশ্ন করা হয়…… “আচ্ছা, ফাসানো কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি? উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কে করতে পারবে?” – আমি সিওর……ওই একগাদা মানুষের ভিতরে ক্যাডেটগুলি সবার আগে ৩২ পাটি দাঁত বের করে দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে যাবে। ক্লাস সেভেনের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপিলেরা মায়ের কোল থেকে সরাসরি ক্যাডেট কলেজে এসে লংআপ হয়ে উলটো করে ১০০০ থেকে কেঁপে কেঁপে ১ পর্যন্ত গোনার সময় দুবার ধুম করে মেঝেতে পড়বে……আর তৃতীয়বার সিনিয়রদের কাছে ক্লাসমেটদের নাম বলে দেবে ফল্টের জন্য…… এটার জন্য তাদের দোষ দেয়া যায় না। তবে সেও দু একবারই বড়জোর। কারণ অল্প কিছুদিনের ভেতরই ক্লাসমেট ফিলিংস নামের বস্তুটা বুকের ভেতর হাওয়া থেকে পয়দা হয়ে গেলে……..তারই বদৌলতে সারা ব্যাচ ঘণ্টাধরে নোংরা মেঝেতে গড়াগড়ি খাবে……কিন্তু অপকর্মটা কোন রত্ন করেছে সেটা সিনিয়রদের আর জানা হয়ে উঠবে না।

নাহ সেই ফাসানোর কথা বলছিনা। এ ফাসানো অন্য ফাসানো। এই ফাসানোতে বিবেকের কাছে দশবিশ বার করে কৈফিয়ত দেয়া লাগে না। হাসি মুখে একদিনে যতবার খুশি ফাসানো যায়। পরিণামে শুধু কোনএক ক্লাসমেটের বিষদৃষ্টি নিক্ষেপটুকু সহ্য করতে পারলেই চলে। এটাও কোন এক সিনিওর ভাইয়ের কাছেই ফাসানো……তবে কোন ফল্টে না, কাজে।

আহা সেই বিখ্যাত দিনগুলো! যেদিন ধোপা থেকে কাপড় আসবে……যেদিনের পরের দিন প্যারেড থাকবে……যেদিন হাউজ ইন্সপেকশন থাকবে……সিনিয়রদের প্র্যাক্টিকাল খাতা জমা দেবার দিনগুলো এগিয়ে আসবে……যেদিন যেদিন বিকালে সিনিয়রদের বংগজ না হলে মিল্ক বিস্কিট খাবার শখ জাগবে……সেদিন গুলোতে কাউকে না কাউকে যে ফাসতেই হবে!

এক এক জনের বাঁচার উপায় গুলোও একেক রকম বাহারী! প্রেয়াররুম কোন দিকে ঠিকমতন বলতে পারে কিনা সন্দেহ এরকম ছেলেপুলেদের দেখা যায় ধোপা থেকে কাপড় আসার দিন সেইযে প্রেয়ার রুমে ঢোকে আর বের হওয়া টওয়ার বালাই নেই। প্রিন্সিপাল প্যারেডের আগে দিয়ে দেখা যায় ক্লাস টুয়েল্ভের সহানুভূতিশীল কোন সিনিয়রের দুজোড়া জুতা নিয়ে এসেছে সেধে সেধে। তারপর যখনি……

‘অই মাশরুর, নিচে আবুল ভাইয়ের কাছে যাও।’
-‘পারবো না। আমাকে ক্লাস টুয়েল্ভের তৌহিদ ভাই কাজ দিসে।’
‘তৌহিদ ভাইয়েরটা শেষ হইলেই যাও।’
-‘তৌহিদ ভাই আর কারো থেকে কাজ নিতে না করসে।’

কঠিন অবস্থা……অগত্যা অন্য কোন গোবেচারা কে না ফাসিয়ে উপায় নাই।

যাদের হাতের লেখা মোটামুটি সুন্দর, যারা পুর্বজন্মের কোন এক পাপে এক আধটু ছবি আঁকার দুঃসাহস দেখিয়েছিল ভুল করে……তাদের লাইফটা হেল। ডেস্কের উপর খাতার পর খাতা – বায়োলজি, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি। পারলে দুইহাতে দুইটা লিখতে হয়! সেই খাতা দেখিয়ে আবার সিনিয়ররা হাসিমুখে ল্যাবে ‘জী স্যার আমি নিজে লেখসি স্যার……এইটাই আমার হাতের লেখা স্যার’ বলে ২৫শে ২৫ নিয়ে বেড়িয়ে আসতেন। আর হতভাগা জুনিয়রগুলোর পুরস্কার হতো পরের পরীক্ষার খাতা খানিও ওদের ঘাড়েই পড়তো।

প্রিন্সিপাল ইন্সপেকশনের দিন……নিজের জায়গার খবর নাই……জুতার ব্রাশের আঁশগুলো ক্ষয় করে দিয়ে আসতাম সিনিয়রদের নেটের জানালায় ঘষে ঘষে। কোনরকমে এক রুমের কাজ করে নিজের রুমে আসতে না আসতেই আবারো…… ‘জুনিয়র, অমুক ভাইয়ের রুমে গিয়ে বলবা তমুক ভাই পাঠাইসে।’ অনেকে আবার কিভাবে কিভাবে পিছলা মাছের মতন এগুলো থেকে বের হয়ে যেত। আর আমরা আমাদের কপাল চাপড়াতাম দুঃখে!

আমাদের ফররুখ ইসলাম মোঃ ফিরোজের নাম হয়ে গেল ফররুখ ফাসানি ফিরোজ…এ.কে.এ…এফ কিউব। ও বেচারা এম্নিতে একটু চুপচাপ থাকে। অন্য রুমে অত যায় টায় না। ফলাফল ……পাশের রুম থেকে রিপোর্ট আসলো ও নাকি পাশের রুমের যায়ই খালি ফাসানোর জন্য। ও কে রুমের সামনে দেখলেই তাই আমাদের টেন সীটার পাশেররুমের ৮টা ক্লাসমেট যার যার জান হাতে নিয়ে কেউ প্রানপণে খাটের তলায় ডাইভ দিত, কেউ হাতের কাছের জুতাটা পালিশের ভাব ধরে ছাল চামড়া উঠিয়ে দিত, কারো কারো বেডকাভারটা মুড়ি দেয়া দেখে মনে হতো এ বোধ হয় জন্মথেকেই ঘুমাচ্ছিলো……। এ সবের মধ্যেই আমাদের ফিরোজ টপাটপ ফাসিয়ে বের হয়ে আসতো। ওর ও তো কিছু করারও নেই। কারণ আমাদের তখনকার একব্যাচ সিনিয়র রুমলীডার আশরাফ ভাইয়ের গোপন ইন্সট্রাকশন দেয়া আছে…‘ওই মিয়া…আগে পাশের রুম থেকে ফাসাবা, না পাইলে পরে নিজের রুমে আসবা’।

একই রকম ফাসাতেন আমাদের একব্যাচ সিনিয়র ফাসানি জাহিদ ভাই। উনিও ঘাঘু ফাসানি……এমনিতে খুব একটা আমাদের, জুনিয়রদের রুমে আসতেন না। কাজেই রটে গেল……উনার আসা মানেই ফাসাতে আসা। একদিন রুমে আমি, ইফতেখার, মাশরুর আর প্রিন্স। গ্যাজানোর ফাঁকে টের পাইনাই হঠাৎ দেখি জাহিদ ভাই রুমে ঢুকে গিয়েছেন। পালানোর কোন উপায় নাই। এ ওর মুখের দিকে কাচুমাচু হয়ে তাকিয়ে কি অজুহাত দেব ঠিক করার চেষ্টা করছি আর মনে মনে ভাবছি……মোট চার জন আছি রুমে, আমার চাঁদবদন খানা ওনার চোখে ভালোমতন না পড়লেই তো বেঁচে যাই……কিন্তু জাহিদ ভাই কাউকে কোন চান্স না দিয়ে…… ‘আশিক, নিচে আসিফ কামাল ভাইয়ের কাছে যাও। মাশরুর, ৮ নাম্বার রুমে সাজিদ ভাইয়ের কাছে। ইফতেখার, পাশের রুমে সামির ভাই। প্রিন্স, তুমি আমার সাথে আসো।’ মানে যাকে বলে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারের মত ঠাঁ ঠাঁ চারজন কে ধরাশায়ী করে উনি উনার রাস্তায়। পেছনে বেকুবের মতন তাকিয়ে থাকি ভ্যাবাচেকা খাওয়া আমরা।

সেদিন আমরা অসহায়ের মতন মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। আসলে ফাসানো একটা আর্ট, আর জাহিদ ভাই…আমাদের ফিরোজ – এরা সেই আর্টের কঠিন ধরণের আর্টিস্ট…………

১,০৬৭ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “ও ফাসানি…বলে যাও…”

  1. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    কলেজে যে একটু বড় ভাইয়ের কাছে কালারড থাকত তাকেই দেখতাম সারাদিন দৌড়ের উপর...।
    শেষ পর্যন্ত এমন হ্ল যে পোলাপাইন বলত যে ওমুক ভাই তোর নাম ধইরা বলছে যাইতে। শেষে ধরা খাইয়া একরাশ গালির বন্যা বয়ে যেত। আরেক পার্টি ছিল(নাম কমু না) তারা আবার অতি উৎসাহ দিয়া যত্নের সাথে ফাইফরমাশ খাটত।

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    আমি ডজ দেওয়ার একটা উপায় জানতাম। ইন্সপেকশনের সময় মেটাল বোর্ড(যেইটাতে হাউসের নাম,হাসপাতালে কয়জন এইগুলা লিখা থাকতো)।আমি সারা ইন্সপেকশন ওই বোর্ড মেটাল পালিশ করতাম আর ঠিক ১৫ মিনিট আগে ডর্মে যাইতাম।হে হে হে হে হে...

    আশিক ভাই,ফাটানি লিখা হইছে মামু! 😀 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।