পর্বতশৃঙ্গে

পর্বতশৃঙ্গে

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

“এরপর গঙ্গার উৎপত্তিস্থল হিমালয় শিখর! সেই শিখর তুষারে আচ্ছন্ন বলেই শ্বেতবর্ণ। সেখানে কস্তুরী মৃগের দল এসে বসে। তাদের নাভির কস্তুরী গন্ধে পর্বতের শিখা সুরভিত হয়ে উঠে”। – কালিদাস (মেঘদুত)

২০০২ সালে সিয়েরালিওনে জাতিসংঘ মিশন করা কালে ছুটিতে আসার পথে আমি আর সাইদুল স্যার লন্ডনে ছিলাম কয়েকদিন। এই সময়ে টিউব ট্রেনে করে সাইদুল স্যারের মামার বাসায় যাবার সময়ে সাইদুল স্যারের অন্যমনস্কতার কারণে আমরা পথ হারিয়ে ফেলি। শুধু তাই নয়, লন্ডন ছেড়ে ব্রিটেনের গ্রামেগঞ্জে প্রবেশ করে ঘুরতে থাকি কক্ষচ্যুত বা অনিকেত নক্ষত্রের মতন। এই সময়েই সবিস্ময়ে আমি খেয়াল করলাম খোদ ব্রিটেনের সৌন্দর্যও তার আভিজাত্যের ভেতরে নিহিত নয়। নয়  লন্ডন টাওয়ার, উইন্ডসোর ক্যাসল, গোথিক ক্যাথিড্র্যাল ওয়েস্টমিনস্টার আ্যবে, ট্রাফালগার স্কোয়ার,  কেনসিংটন প্যালেস, বাকিংহাম প্যালেস, লন্ডন আই, মাদাম তুসো ও বিগ বেন।এগুলোকে মানুষের উৎকর্ষতার উদাহরণ হিশেবে ধরা যেতে পারে। সৌন্দর্যের নয়। এমনকি সাজানো গোছানো আলোকোজ্জ্বল টেমস নদীকেও আমার কাছে আমার ঘোলা জলের যমুনার কাছে ম্রিয়মাণ মনে হয়েছে।    বরং আমার কাছে মনে হয়েছে ইংল্যান্ডের আসল সৌন্দর্য নিহিত আছে তার অবারিত প্রান্তর আর শস্য ক্ষেত্রের নয়নাভিরাম দৃশ্যপটের ভেতরে। ট্রেনে করে চলতে চলতে আপনার সত্যি সত্যিই আপনার চোখে কেউ মায়ার অঞ্জন বুলিয়ে দেবে। মনে হবে, “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা”! অর্থাৎ প্রকৃতিই সৌন্দর্যের একমাত্র আধার। আদিকাল থেকে। অন্যকিছু নয়!

২০১০ সাল। সরকারী কাজে সেনাবাহিনীর আরও কয়েকজনের সাথে এসেছি জার্মানির মিউনিখে।এই যাত্রায় আমি জার্মানির ভেতরে পরিভ্রমণ করা ছাড়াও যাব সুইজারল্যান্ডের জুরিখে, ইতালির বোলোনা শহরে, রোমিও এবং জুলিয়েটের ভেরনা শহরে, জলের শহর ভেনিসে এবং গ্রীক মিথিলজির রোমে। পুরো পথটাই ট্রেনে করে। অথবা সংক্ষিপ্ত সময়গুলোতে কারে করে। বন্ধু না পরিচিত জনদের মহানুভবতায়। এই সময়েই আমার পূর্বোক্ত বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে। বিশেষ করে প্রায় পুরো ইউরোপ জুড়ে বিস্তৃত আল্পস পর্বতমালার এবং অশ্বের ছুটে চলা প্রেইরির প্রান্তরের মতন বিশালতার সৌন্দর্য    থেকে। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, স্লোভানিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত এই পর্বতমালার বিস্তৃত । নদী এবং লেইক গুলো এই সৌন্দর্যকে দিয়েছে নয়নাভিরাম মাত্রা।

আমাদের আজ সকালের গন্তব্য আল্পস পর্বতমালা। জার্মানির জার্মানির সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ৎসুগষ্পিৎসে (Zugspitze) এর শীর্ষদেশ। সমতল থেকে উচ্চতা ২,৯৬২ মিটার উঁচুতে। জার্মানি আর অস্ট্রিয়ার সংযোগ স্থলে অবস্থিত এই পর্বতশৃঙ্গ। আমার জীবনে এটাই সর্বপ্রথম কোন পর্বতশৃঙ্গ দর্শন এবং আরোহণ।

আমরা যখন পর্বতের পাদদেশে পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর। EIBSEE নামক নীল নয়না এক লেইকের পাশ থেকে আমরা ৎসুগষ্পিৎসে’র শীর্ষে আরোহণ করবো। গ্রীষ্মকাল। দূরে সোনালি রোদে ৎসুগষ্পিৎসে’র শীর্ষ চিকচিক করছে। অবশ্য শীর্ষের অনেক নীচেই পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমে আছে। তিনভাবে এই পর্বত শীর্ষে আরোহণ করা সম্ভব। মাউনটেইন ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে। ক্যাবল কারের মাধ্যমে। আর ট্রেনে চড়ে।

আমাদের গাইড এক প্রাণবন্ত জার্মান যুবক। নাম ফিলিপ। ওর সাথে কথা বললে কখনই আপনার মনে হবে না যে, জার্মানরা যে ভীষণ অহংকারী জাতি। ফিলিপ আমরা যে কোম্পানিতে পরিদর্শন করতে এসেছি তারই কর্মকর্তা। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা পর্বত শিখরে উঠবো ক্যাবল কারে করে।অতঃপর সেখান থেকে নেমে আসবো ট্রেনে করে।

সুতরাং আমাদের এই পর্বতারোহণ নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী এডমন্ড হিলারি এবং নেপালের  শেরপা তেনজিং নোরগে’র সর্বপ্রথম মানব হিশেবে এভারেস্টের চুড়ায় আরোহণ নয়। আমাদের ভ্রমণ তুলনীয় বোরাক রূপী আকাশ ভেলায় চড়ে আল্লাহ্‌র আরশ পর্যন্ত আরোহণ। কোন ক্লেশ ছাড়াই। এখানে আসতেই চোখে পড়েছে শত শত মানুষেরা আকাশ ভেলায় (ক্যাবল কার) করে নামছে আর উঠছে!

ক্যাবল কারটা আমাদেরকে নিয়ে পাহাড়ের ওপর দিয়ে মহাশুন্যের মধ্য দিয়ে চলা শুরু করল। প্রায় নব্বই ডিগ্রি কোনে আমাদের এই ভার্টিক্যাল আরোহণ। যিশু খ্রিষ্টের সপ্তম আকাশে যাত্রার মতন।  আমার মনে হল আমি বোরাকে করে চলে যাচ্ছি পৃথিবী থেকে দূরের কোন গ্রহে। যেখান থেকে আমি আর কোনোদিন ফিরে নাও আসতে পারি! মনে পড়ে গেল সুদূর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত আমার প্রিয় দেশ।  আমার পরিবার এবং আমার দুই মেয়েকে। আর যদি কোনদিন ফিরে না আসা হয়! অথবা ক্যাবল কারের তার ছিঁড়ে আমি যদি পরে যাই বরফাচ্ছাদিত কোন গহীন উপতাক্যায়!দূরে আরও কয়েকটা ক্যাবল কার চলছে। একবার মনে হল আমাদের ক্যাবল কারটা ওপর থেকে নেমে আসা আর একটি ক্যাবল কারের সাথে লেগে যাবে! আমি মনে মনে ভীষণ শঙ্কিত।

একসময়ে আমরা নীল আকাশের পটভূমিতে সবুজ সাদায় আবৃত ছোট বড় পাহাড়গুলোকে অতিক্রম করে মেঘের রাজ্যে ঢুকে পড়লাম! আমাদের ক্যাবল কারের চারপাশ জুড়ে মেঘ! কুয়াশা আর জলে ভিজে যাবার কারনে ক্যাবল কারের ভেতর থেকে কিছুই আর দৃশ্যমান নয়। আমি কারের এয়ার কন্ডিশনের ভেতরেও ঘেমে উঠছি। মাধ্যাকর্ষণের টানে আমার শরীরের মধ্যে শিরশির অনুভব!  আমার মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় পড়া ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের কথা। মেঘনাদের অন্য নাম ছিল ইন্দ্রজিত। তিনি মেঘকে আড়াল হিশেবে ব্যবহার করে শত্রুদের ওপর তীর ছুড়তেন। এই প্রথম বারের মতন আমি সত্য বুঝতে পারলাম। এটা কবির পাগলা কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। কারণ , মেঘের ভেতর বা পিছন থেকে কখনই দূরের বা কাছের কিছুই দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়।  তা সে শত্রু বা মিত্র যেই হোকনা কেন!

ক্যাবল কার থেকে নামার সময়ে মনে হল স্পেস ষ্টেশন থেকে নামছি! মহাশুন্যের ভেতরে এরা নগর গড়ে রেখেছে! বিল্ডিং গুলোর ভেতর থেকে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে, আমি পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে অনেক ওপরে উঠে এসেছি। সবচেয়ে উঁচুতলাটা কাঠের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। চারপাশটায় কাঁচের জানালা। কিন্তু কুয়াশার কারনে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। খুব শীত করছে। আমাদেরকে উত্তপ্ত করার জন্যে ফিলিপ বিয়ার এবং কফির অর্ডার দেয়।

এই খানেই ঘটলো সবচেয়ে মজার ব্যাপার। এহসান ফিলিপের সাথে বাংলাদেশের শেয়ার বাজার নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। এমনভাবে কথা বলছে যে, মনে হচ্ছে এখান থেকেই সে শুধুমাত্র বাংলাদেশের শেয়ার বাজার নয়, পুরো পৃথিবীর অর্থনীতিকেই নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম! ফিলিপ মুগ্ধভাবে তার কথা শুনছে।আমার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। অলিম্পাস থেকে দেবতা জিউস অথবা অন্নপূর্ণা থেকে শিব বোধ হয় এভাবেই মর্তের মানুষদের সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রন করতেন! ঘুনাক্ষুরেও মনে হল না এর মাত্র দুই মাস পরেই বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে প্রবল ধ্বস নামবে। যাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা খোদ সরকার কেন, মহাশক্তিশালী শিব বা দেবতা জিউসেরও থাকবেনা!

পর্বতের চুড়ায় কয়েক বর্গ হাত জায়গা জুড়ে বরফ জমে আছে। বছরের কোন সময়েই নাকি এই বরফ গলেনা! পাশেই দেয়ালে ভারতীয় এক সন্তের বানী দেয়ালের গায়ে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তিনি চিরন্তন শান্তির কথা বলেছেন। নীচে অনেক নীচে মেঘের ফাঁক দিয়ে EIBSEE লেইক বা সরোবর দেখা যাচ্ছে। অস্পষ্ট কিন্তু নয়নাভিরাম। পৃথিবী পৃষ্ঠ আসলেই সুন্দর।

আমার মনে হল পর্বতের চূড়া দেবতা বা সন্তদের জন্যেই বসবাসের জন্যেই ঠিক জায়গা। আমার মতন সাধারণ মানুষের জন্যে নয়! পার্থিব যে কোন মানুষের মতন আমি শীত অনুভব করছি। বেশীক্ষণ থাকলে হয়তো বা জমেই যাব। আমি সীমান্তের দুই পাড়ে অবস্থিত পর্বত শৃঙ্গের জার্মান এবং অস্ট্রিয়ার দুই দোকান থেকে আমার দুই মেয়ের জন্যে স্যুভেনির কেনার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ি!

“ঐ মানস সরোবর ,স্বর্ণকমলে ভরা! এর জল তুমি পান করো” –কালিদাস (মেঘদুত)

৫,০৪৮ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “পর্বতশৃঙ্গে”

মওন্তব্য করুন : আসাদ (৭৭-৮৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।