সেনাবাহিনীর অনুশীলন এবং আমার বন্ধু হারানো!

সেনাবাহিনীর অনুশীলন এবং আমার বন্ধু হারানো!

“হঠাৎ রাস্তায় অফিস অঞ্চলে

হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে

বন্ধু কি খবর বল

কত দিন দেখা হয়নি”! –  (গান, শিল্পীঃ সুমন চট্টপাধ্যায়)

১৯৯০ সাল।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর  ‘স্কুল অফ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স’ (এস এম আই)  এর ছাত্র অফিসার হিসেবে বহিরাঙ্গন  অনুশীলনের জন্য কুমিল্লা সেনানিবাস হতে ঢাকায় এসেছি।‘মোবাইল সারভেইলেন্স’ নামক গোয়েন্দা প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুশীলন।

প্রথম পর্যায়ের অনুশীলন হয়েছে কুমিল্লা শহরে। এই অনুশীলনে একজন জীবন্ত গতিশীল মানব লক্ষ্যবস্তু আমাদের (ছাত্রদের) দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমন করবেন।আমাদের দায়িত্ব হল তার এই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেওয়া। এস এম আই’তে প্রশিক্ষক অফিসারের সল্পতার কারনে সেনানিবাসের অন্য ইউনিট হতে সাময়িক ভিত্তিতে একজন অফিসারকে বর্ণিত লক্ষ্যবস্তু হিশেবে আনা হয়েছে। আমাদেরকে তার পাসপোর্ট সাইজের অস্পষ্ট ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে। অনেকটা PRISMA’র বিমূর্ত ছবির মতন। তার পরেও অনুশীলন শুরু হলে তার ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে আমরা তাকে চিনে ফেলি এবং তার পিছু নেই। লক্ষ্যবস্তুর ওপরে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা আছে যে তিনি শহরের নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের যুদ্ধংদেহী পশ্চাদ্ধাবন দেখে তিনি ভয়ানক শঙ্কিত। আমরা তার ৩০০ গজের ভেতরে যেতেই তিনি একটা দ্রুতগামী স্কুটারে চড়ে বসলেন এবং আমাদের দৃষ্টির সম্মুখ হতে মুহূর্তের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেলেন। ভোজবাজীর মতন। আমাদের ছাত্রদের ওপরে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা আছে আমরা রিক্সার চেয়ে অধিকতর গতিশীল কোন বাহন ব্যবহার করতে পারবোনা। কাজেই আমরা আমাদের প্রশিক্ষকগনের কাছে আত্নসমর্পণ পূর্বক তাদের সহযোগিতা কামনা করলাম। অতঃপর শুরু হল আমাদের যৌথ অনুসন্ধান। তিল তিল করে অনুসন্ধান করেও তাকে নির্ধারিত অনুশীলন এলাকার মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেলনা। এমন কি আমাদের কোর্সের অবশিষ্ট দিনগুলোতেও।

দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুশীলন পূর্বের অনুশীলনের ঠিক উল্টো। অর্থাৎ আমি বা আমরা যারা ছাত্র তারা হলাম পূর্বের সেই জীবন্ত গতিশীল মানব লক্ষ্যবস্তু বা সাবজেক্ট। আমার দায়িত্ব হচ্ছে নির্ধারিত ছদ্মবেশ ধারন করে আমার গোয়েন্দা  প্রশিক্ষকদের নিবিড় চোখে ধুলো দিয়ে, এন্টি-সার্ভেইলেন্স টেকনিক ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শাহবাগ থেকে শুরু করে হোটেল ‘সোনার গাঁ’র পার্শ্ববর্তী তপ্ত, রৌদ্র দগ্ধ ঝর্না পর্যন্ত আগমন করা।আমার এই পরিভ্রমনে আমি শুধুমাত্র প্রধান সড়ক, সেই সড়কের কয়েকটা কানাগলি, রাস্তা সংলগ্ন দোকানপাট অথবা পরিচিত অফিস বিল্ডিং গুলোর আশ্রয় সাময়িকভাবে ব্যবহার করতে পারব। তবে প্রধান সড়ক হতে কোনক্রমেই ৫০ গজের বেশি ডানে-বামে লুকিয়ে থাকা চলবেনা। এছাড়া যদিও আমি ছদ্মবেশে আছি, এই ছদ্মবেশ ধারন আমার জন্যে কোন অতিরিক্ত গোপনীয়তার সৃষ্টি করেনি। আগে পরিচয় দিতাম ক্যাপ্টেন আসাদ বলে। এখন আমাকে পরিচয় দিতে হবে ‘আবুল’ বা অন্যনামে। চেহারা সুরত আগেরটাই আছে। প্রশিক্ষকগন সবাই আমাকে নিবিড় ভাবে চেনেন-জানেন। জিয়া সফদার স্যারকে আমি আমাদের বেসিক কোর্সের সময় হতেই চিনি এবং উনার সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে আমি পূর্ব পরিচিত। মাহমুদ স্যার আমার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু পাগলা জাহিদের দুলাভাই। আরিফ স্যার আমাদের সিগন্যাল কোরের অফিসার। ইব্রাহীম স্যার আমাদের ঠিক আগের কোর্সের। কোর্স শুরু হবার মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বেই আমি ইউনিট থেকে এসে এসএমআই’র এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যাক-ষ্টেজ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কাজে তাদেরকে আমি সহায়তা করেছি। অবশ্য এখন তারা সকলেই এমন ভাব করেন যে, কস্মিনকালেও তাদের সাথে আমার কোনোদিন দেখা হয়নি। আমার সকল ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের কলকব্জাও তাদের হাতে। এক্সারসাইজ প্ল্যানে আমি আমার ছদ্মবেশের পরিচয়, বাবার নাম, পেশা, ছবি সবই তদেরকে  ফরমালি হস্তান্তর করেছি। এমনকি অনুশীলন শুরুর অব্যবহিত পূর্বে আমাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, আমি যত বড়ই গোয়েন্দা হইনা কেন প্রধান সড়ক থেকে ৫০ গজের বেশি দূরের অলিতে গলিতে লুকিয়ে যেয়ে আমি যেন তাদের বিব্রত না করি। ত্রুটিহীন  সুস্পষ্ট নির্দেশনা!

কাজেই এক্সারসাইজ যখন শুরু হল তখন আমাকে ইতিপূর্বে শেখানো এন্টি-সারভেইলেন্স টেকনিকগুলোর কোনটাই আমার কোন কাজে আসলো না। বরং কিছু কিছু সময়ে আমি দৌড় দিয়ে যখন আমাকে অনুসরণকারী প্রশিক্ষক থেকে দূরে সরে যেতাম, শুধুমাত্র তখন তারা কিছুটা অসুবিধায় পতিত হতেন।  কারন একজন প্রবল প্রানশক্তির একজন উঠতি বয়সের গতিময় কিশোরের সাথে একজন স্থির বা পড়ন্ত যৌবনের মানুষের কখনই দৌড়ে পেরে ওঠার কথা না!

দৌড় ব্যতীত ব্যতীত অন্য সময়গুলোতে আমার অবস্থা শ্রী কৃষ্ণের রাধার মতন! আমি হয়ত একটা দোকানে কোন কিছু কেনার ভান করছি। ডানে ঘাড় ফেরাতেই দেখি আমার ইন্সট্রাকটর মাত্র দু’গজ দূরত্ব থেকে আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন। আমি হয়ত ফুটপাথের ওপর থেকে নিচু হয়ে কিছু একটা তোলার চেষ্টা করছি। হঠাৎ আমার কোমরে মৃদু স্পর্শ! আমি পিছন ফিরতেই দেখি তিনি আমার দিকে সহাস্য মুখে তাকিয়ে আছেন ! মোট কথা আমি রাধার মতন চোখ খুললেও দেখি কৃষ্ণরূপী আমার ইন্সট্রাকটরকে ; চোখ বন্ধ রাখলেও দেখি তাকেই। এমন প্রেমময় অবস্থা আমার !

ফলে কিছুটা বিভ্রান্ত এবং কিছুটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে দৌড়-লুকোচুরি ইত্যাদি ধরনের ছেলেবেলার খেলাধুলার মধ্য দিয়েই আমি যাত্রাপথের মধ্যস্থলে অবস্থিত হোটেল শেরাটনের (বর্তমানে হোটেল রূপসী বাংলা) কাছে চলে আসতে সমর্থ হলাম। আমার ইন্সট্রাকটর আরিফ স্যার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার কারনে তিনি এই মুহূর্তে আমার থেকে প্রায় ২০০ গজ পিছনে। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটলো হোটেল শেরাটনের গেটে আসার পর। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমার মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ক্লাসমেট এবং নিবিড় বন্ধু শাহিন!১৯৭৭ সন হতে ১৯৮৩ সন পর্যন্ত একসাথে আমরা পিতামাতা, ভাইবোনদের ছেড়ে মধুপুর গড়ের নিবিড় জঙ্গলের ভেতরে একসাথে বসবাস করেছি। কলেজ থেকে বের হবার পর দীর্ঘ সাত বছর পর তার সাথে আমার প্রথম দেখা। আমাকে পেয়ে সে ভীষণ আত্মহারা! আমিও। মুহূর্তের ভেতরে ভুলেই গেলাম যে, বিশেষ কোন কাজে আমি বের হয়েছি।গেটের পাশে দাঁড়িয়েই আমরা পরস্পরের সাথে নিবিড় আলাপচারিতা শুরু করে দিলাম।

শাহিন আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভদ্র এবং দার্শনিক টাইপের ছেলে। একবার ফজলুল হক হাউজের কমন টয়লেটে ক্লাস সেভেনের নতুন এক ক্যাডেট টয়লেটের ব্যবহারের সময়ে টয়লেটের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছে। শাহিন হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে ঢুকেছে বাথরুমে। ছেলেটা শাহিনকে দেখে ভয়ে অথবা সম্মান দেখানোর জন্য দরজা খোলা টয়লেটের ভেতর থেকেই দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অন্য কেউ হলে হয়ত প্রবল ফান করত; তার অবশিষ্ট ক্যাডেট জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলত। কিন্তু শাহিন ভদ্রতার সাথে প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “ আরে, দাঁড়িয়েছ কেন তুমি?  বস ,বস!” এমন মানুষকে আমি এভইড করি কিভাবে?

অথচ আমার প্রশিক্ষক আরিফ স্যার আমার প্রায় ২৫/৩০ গজ দূরত্বের মধ্যে চলে এসেছেন। একটু পরেই আমরা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যাব। আমি উপায়ন্তর না দেখে শাহিনকে বললাম, “ শাহিন আমি একটু ‘পি’ করার জন্য ভেতরে যাচ্ছি। তুমি এখানে একটু দাঁড়াও।” –  বলেই তাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে হোটেল শেরাটনের এর ভেতরে ঢুকে গেলাম এবং পিছনের দরজা দিয়ে লক্ষন সেনের মতন পালিয়ে গেলাম!

শাহিনের সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হয়নি। বুয়েটে পড়াশুনা শেষ করে আমেরিকাতে সে গিয়েছিল উচ্চতর পড়াশুনার জন্য। সেখানে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের এই বন্ধুটি চিরতরে হারিয়ে যায়!

শাহিনের মৃত্যু এখনও আমাকে অপরাধী করে রেখেছে। কালে ভদ্রে আমি যখন হোটেল শেরাটন (হোটেল রূপসী বাংলা) এর গেইট অতিক্রম করি আমার মনে হয় শাহিন এখনও আমার জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে! ভুল জেনেও আমার চোখ তাকে খুঁজতে থাকে!

“সমুদ্রের জলে আমি থুতু ফেলেছিলাম

কেউ দেখেনি, কেউ টের পায়নি

প্রবল ঢেউ এর মধ্যে ফেনার মাথায়

মিশে গিয়েছিল আমার থুতু

তবু আমার লজ্জা হয়, এতদিন পর আমি শুনতে পাই

সমুদ্রের অভিশাপ”। – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

(সম্পাদিত)

(বন্ধু দিবসে শাহিনের জন্যে আমার ভালবাসা)

– মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

০৭ আগস্ট ২০১৬

৪,৫১৫ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “সেনাবাহিনীর অনুশীলন এবং আমার বন্ধু হারানো!”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আপনার সিনিয়র হইলে এই লেখার জন্য মাইর দিতাম।
    যেহেতু জুনিয়র তাই মন খারাপ করে বসে আছি।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহমদ (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।