বিপ্লব, যুদ্ধ এবং শৈশব (দ্বিতীয় পর্ব)

বিপ্লব, যুদ্ধ এবং শৈশব (দ্বিতীয় পর্ব)   

‘‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে/ লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে/ কখন আসবে কবি? / …শতবছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ …কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’’ –  নির্মলেন্দু গুন
১৯৭০ সাল। আইয়ুব খানের পর ক্ষমতায় এসেছেন ইয়াহিয়া খান। সামরিক শাসন জারী করার পরেও গণদাবীর মুখে তিনি ডিসেম্বর মাসে সাধারন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর তারিখ রাতে বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরগুনা ও ভোলাসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে স্মরন কালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় ‘গোর্কি’। উপকূলের উপর দিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া এই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিহত হয় অন্তত দশ লাখ মানুষ, লাখ লাখ গবাদি পশু। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ঘরবাড়ী ও বিস্তীর্ণ জনপদ। ফসলের মাঠগুলো হয়ে যায় বিরান মুল্লুক। পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরও জরুরি ত্রাণকার্য পরিচালনায় গড়িমসি করে। ঘূর্ণিঝড়ের পরও যারা বেঁচে ছিল তারা মারা যায় খাবার আর পানির অভাবে। ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বীকার করেন যে  সরকার দুর্যোগের ভয়াবহতা বুঝতে না পারার কারণেই ত্রাণকার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।   
এর অব্যবহিত পরেই ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় সাধারন নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ৩১৩আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে। অপরদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘পাকিস্তান পিপলস’ পার্টি’ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে।শুরু হয় আবার ষড়যন্ত্র, যে ষড়যন্ত্রের সুত্রপাত হয়েছিল পলাশীর আম্রকাননে!
 
আমরা যারা ছোট তাদেরকে কেউ কিছুই না বললেও আমরা ঠিকই বুঝে যাই সময়ের এবং পরিস্থিতির ভয়াবহতা! আমাদের বাড়ীতে আমার বুদ্ধিলগ্ন থেকেই দেখে আসছি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা রাখা হয়। প্রতিদিন আমিই বিকেল ৫ টার দিকে স্কুলের পাশের পোস্টঅফিস থেকে বাড়ী পর্যন্ত আমার বাবার ঠিকানা সম্বলিত কাগজের ব্যান্ড পরানো ভাঁজকরা এই পত্রিকাটা নিয়ে আসি। স্কুলের মাঠ পেরুতে না পেরুতেই আমার চোখের সামনে পত্রিকাটা খুলে ধরে সেই দিনকার দেশ এবং হয়তোবা পৃথিবীও! আমি অবশ্য পত্রিকাতে দেয়া ছবিগুলো ছাড়া আর কোনকিছুতেই আগ্রহী নই! এই ছবিগুলোতেই আমি দেখেছি  জলমগ্ন এক বিস্তীর্ণ জনপদের ভেতরে বধ্যভূমির লাশের মতন অথবা পানির ওপরে উল্টে যাওয়া শুশুকের মতন ভাসছে অজস্র মানুষ এবং গবাদিপশুর ফুলে যাওয়া শরীরের মিছিল। এই জল আগামী এক বছরেও দূষণমুক্ত হবেনা অথবা পান/স্নানের জন্যে উপযুক্ত হবেনা। আর ঝড় অথবা ঘূর্ণি ঝড়ের ভয়ঙ্কর সুন্দর রুপ আমি কয়েকদিন আগেই দেখেছি। মাত্র কিছুদিন আগেই আমাদের এলাকা দিয়ে একটা কালবোশেখি ঝড় হয়ে গেছে যেখানে আমি আমাদের পাশের বাড়ীর একটা দোমড়ানো মুচড়ানো টিনের চালকে ধূসর আকাশের ভেতরে ঘুড্ডি অথবা চিলের মতন উড়ে যেতে দেখেছি!
 
আমাদের হাইস্কুলের ওপরের শ্রেণীতে পড়া সকল স্থানীয় এবং লজিঙের ছাত্রেরা দলবেঁধে ট্রেনে করে গতকাল ঢাকায় গিয়েছিল রেস কোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগ দেবার জন্যে।রাতের ভেতরেই সবাই ফিরে এসেছে।প্রত্যাবর্তনের পর সবাই যেন এক লাফে অকস্মাৎ পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করেছে! হাইস্কুলের সকল ছাত্রদের হাতে বাঁশের মোটা কঞ্চি দিয়ে তৈরি একহাত লম্বা লাঠি।বিদ্যুতের বেগে সেগুলো ঘুরছে তাদের হাতের চারপাশে।সবার ভেতরেই চাঁপা আক্রোশ বা উত্তেজনা! যে কোন সময়েই সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতন উদগিরন শুরু করতে পারে!
 
প্রত্যুষকাল ৮ মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ । সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হয়েছে রেডিতে। আমাদের পুরো গ্রামে দুটো মাত্র রেডিও আছে। একটা গ্রামের শেষপ্রান্তে তালুকদার বাড়ীতে। অন্যটা আমাদের বাড়ীতে। গ্রামের সকল নারীপুরুষ, কিশোরকিশোরী এবং আমরা শিশুরাও ভিড় করে বসে আছি রেডিওর সামনে।আমাদের সবাইকে আন্দোলিত করে বজ্রনিনাদের মতন উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য! পরক্ষনেই মেঘ অথবা সমুদ্রের গর্জনের মতন লক্ষ কণ্ঠধনিতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যেন বা সমগ্র চরাচর। সবাই বিস্মিত, উদ্বেলিত, আবেগাক্রান্ত! মনে হয় জন্ম জন্মান্তর ধরে সবাই অপেক্ষা করছিল এমন একজনের যার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে সবার আমাদের ঘরবাহির সব একাকার হয়ে যাবে! ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিতে-প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে চারদিক!
 
চারপাশের বড়দের চাপা আক্রোশ এবং উত্তেজনা ক্রমশ সংক্রামিত করছে আমাদের মতন ছোটদেরকেও!এ যেন এক ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’! মুক্ত আলো ক্রমশ ছড়িয়ে পরছে সবার অন্তরমহলে!  
 
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
৩,৭০২ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “বিপ্লব, যুদ্ধ এবং শৈশব (দ্বিতীয় পর্ব)”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    সত্তরের ঘুর্নিঝড়ের কথা আবছা আবছা মনে আছে।
    তবে ৭ই মার্চের কথা পরিষ্কার মনে পড়ে।
    গ্রাম থেকে নিজ খরচে অনেক লোকজন আমাদের বাসায় এসেছিল ঐ মিটিং-এ যোগ দিতে।
    তাদেরই একটা গ্রুপের সাথে আব্বার তখনকার মুহুরির কোলে কাধে চেপে রেসকোর্সের খুব কাছে কোথাও থেকে ভাষনটা দেখেছি ও শুনেছি।
    আমরা তখন আগামসিহ লেনে থাকতাম।
    খুব একটা দুরের রাস্তা তখন সেটা ছিল না......... (সম্পাদিত)


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।