সমুদ্রপারে তাদের পাড়ায় পাড়ায়! (তৃতীয় পর্ব)

সমুদ্রপারে তাদের পাড়ায় পাড়ায়! (তৃতীয় পর্ব)

গডরিচ জেলেপাড়া

সমুদ্র সৈকতে যাবার অনুমতি এখনো মেলেনি!কারন সিয়েরালিওনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধুলার ভেতরে লালমাটিতে স্থাপিত বাংলাদেশ সেক্টর সদর দপ্তর এখনো আমাদের ওপরে রুষ্ট। তারপরেও সমুদ্র প্রতিনিয়ত আমাদেরকে টানে। কারন মানুষের জীবনে জল একটা প্রধান অনুষঙ্গ।বিবর্তনের প্রাথমিক স্তরে জলজ জীবন থেকেই একদিন সে ডাঙায় উঠে এসেছিলো!

এপ্রিল ২০০২ সন। আমরা ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের সরবরাহকৃত এ্যাম্বুলেন্স সাইজের ফ্রিজের ভেতরের বরফে রুপান্তরিত ফসিলের মতন কঠিন সামুদ্রিক মাছ-মাংশ ভক্ষন করতে করতে প্রথমে নিরাসক্ত এবং পরবর্তীতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।বিশাল আকৃতির টার্কি মুরগিগুলোকে ফ্রিজ থেকে বের করার পর সকালের উজ্জ্বল আলোতে শিকারির গুলিতে নিহত হরিন শিশু বলে মনে হয়। রাতের বেলায় জাতিসংঘ সদস্যদের নিয়ে বারবিকিউ পার্টিতে এরাই মধ্যমণি। এদের পোড়া গন্ধে মৌ মৌ করতে থাকে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের আকাশ বাতাস। তবে পুড়িয়ে খাওয়া ছাড়া অন্য যে কোন ফর্মে রান্না করে এদেরকে খাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। যুবায়ের ইতিমধ্যেই তার নিজস্ব ধরনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তার ধারনামতে সরবরাহকৃত টার্কিগুলো এবং গরুর মাংশের গরুগুলো এই দশকে জবাই করা হয়েছিলো কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। এছাড়া এদেরকে জবাই না হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়েও সে প্রবলভাবে সন্দিহান। কাজেই সে নিজের টাকা খরচ করে পার্শ্ববর্তী গ্রাম বা বাজার থেকে কয়েকটা মুরগি কিনে এনেছে। আমার মনে হয় ফার্মের মুর্গী ব্যতিত পৃথিবীর সকল মুক্ত মুরগিইই দেখতে প্রায় একই রকমের এবং এদের ব্যক্তিত্বও অবিকল এক! আমাদের অনেকেই জাতিসংঘ সরবরাহকৃত মাছ-মাংশ বর্জন করে ইতিমধ্যে আঙুর, কলা আর আপেলভোজী হয়ে গেছে। এই ফলগুলোই শুধুমাত্র বৃক্ষচ্যুত হবার অনেকদিন পরেও সাগর মহাসাগর পেরিয়ে তাদের স্বর্গীয় গুণাবলী ধরে রেখেছে, যদিও তাদের রঙ ইতিমধ্যেই বিবর্ণ হতে হতে এই এলাকার পাথরের ন্যায় লালচে-কাল বর্ণ ধারন করেছে! আর একটা খাদ্য এখনো তার বিশুদ্ধটা বজায় রাখতে পেরেছে। সেটা হল মুরগির ডিম। এর আকৃতি, বর্ণ, আয়তন কোন কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। ইউনিট অধিনায়ক প্রতিদিন সকালের ব্রেকফাস্টে প্রত্যেকে দুটো করে ডিম সিদ্ধ খেয়ে থাকেন, যদিও তার বয়স পঞ্চাশ এর ওপরে! পরিবার সাথে না থাকাতে তাকে শাসন করার কেউই নাই!

ইউনিটের এডজুটেনট সরকার নজরুল ইসলাম খুবই উদ্যমী একজন অফিসার। একদিন সকালে সে অধিনায়কের অনুমতি নিয়ে কোয়ার্টার মাস্টার এবং এক প্লাটুন সৈনিক সমভ্যিহারে পার্শ্ববর্তী কোন এক জেলেপাড়ায় গেল সমুদ্র থেকে সদ্য ধৃত মাছ মাছ কিনতে। ফিরে আসার পর তার কণ্ঠে প্রবল উত্তেজনা। সে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ কিনে এনেছে! বিশাল নীল রঙের পাত্রের ভেতরে এক ঝাঁক রুপালী ইলিশ দেখতে পেয়ে আমরাও সবাই ভীষণ রকম অবাক। আমরা টহলে ইউনিটের বাইরে গেলেই আমাদের গাড়ীর চারপাশ ‘বাংলা -বাংলা’ চীৎকারে মুখরিত হতে থাকে। মনে হয় ১৯৫২ সনের কোন মিছিলের ভেতরে পরেছি আমরা! তাই বলে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশও আমাদের টানে সমুদ্রের স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে কাটতে এতদূর চলে এসেছে? রান্নাকরা ইলিশ মাছ খেতে যেয়ে সবার আক্কেলগুড়ুম হবার জোগাড়! এগুলো ছিল আসলে সামুদ্রিক ‘সার্ডিন (SARDINE) মাছ’ যাদেরকে দেখতে প্রায় অবিকল ইলিশ মাছের মতন মনে হলেও এরা আসলে এক ধরনের সামুদ্রিক পোনা মাছ। এগুলো খেতে পানসে ধরনের, অন্তত আমাদের মতন বাঙালীদের রসনায়!

হাসিবকে নিয়ে আমি পরদিন সকালে জেলেপাড়ার দিকে ছুটলাম সকালের পিটির সময়ে। গডরিচ বীচের পাশ দিয়ে শহরতলীর মতন একটা জায়গা দিয়ে ধুলাবালির রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা একটা পথের শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। চারপাশের একতলা টিনের ছাঁদের ঘরগুলো খুব সুন্দর। যুদ্ধের আগে সম্ভবত এগুলো রিসোর্ট অথবা হোটেল হিশেবে ব্যবহৃত হতো। এখন স্থানীয় অধিবাসীরা এদেরকে নিজেদের বাসস্থান হিশেবে ব্যবহার করছে। রাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকে একটা গির্জা। গির্জার দেয়ালে মেরীর কোলে যিশুর প্রতিমূর্তির ভাস্কর্য। দুজনের রঙই কাল, এমনকি তাদেরকে ঘিরে ওপরে পরীর পাখা নিয়ে উড়তে থাকা দেবদূতদের রঙও। আমি জীবনে এই প্রথম কালো রঙের মেরী আর যীশুকে দেখলাম!

আফ্রিকা সম্পর্কে আমার অন্তর্গত চিন্তা এবং অনুভুতি ছোটবেলা থেকেই ভিন্ন ধরনের। ক্যাডেট কলেজে আমাদের হাউজের তানভীর ভাই যখন আন্তঃ কলেজ আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় দরাজ গলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করেছিলেন, “ উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে তার নতুন সৃষ্টিকে বার বার করছিলেন বিধ্বস্ত …” তখনই আমার মনে হয়েছিল ‘স্রষ্টার অসন্তোষ’ থেকে বাঁচাতে সমুদ্রই আফ্রিকাকে দূরে কোথাও রেখে এসেছে, যেখানে কস্মিঙ্কালেও আমার যাওয়া হবেনা! গডরিচ বীচের পার্শ্ববর্তী রাস্তাটা অতিক্রম করে আরও উত্তরে যেতেই সরু রাস্তা দিয়ে দিয়ে প্রথমে আপনাকে একটা প্রপাত বা খালের ওপরের সেতু পার হয়ে যেতে হবে। এই খালটা পুব দিকের পাহাড় থেকে নেমে এসে পেনিনসুলার রাস্তার ওপরের সাঁকোর নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এই কাঠের সেতুর নীচ দিয়ে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে যেয়ে মিলেছে। খালের কর্দমাক্ত পাড়ে দেখলাম কয়েকটা তরতাজা মাছ গুইসাপের মতন বুকের উপর ভর করে জলেস্থলে গমনাগমন করছে। এগুলো উভচর মাছ। আফ্রিকার এই অঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। আমি মুগ্ধ। জল থেকে আমাদের যাত্রা তাহলে এভাবেই শুরু হয়েছিল?

সেতু পেরিয়ে আমরা গ্রাম ধরনের বিবর্ণ একটা ক্ষুদ্র জনপদ অতিক্রম করে ঢালুতে নেমে পরলাম।এটাই গডরিচ জেলেপাড়া। সামনেই বিশাল সাগর। ছোটোখাটো উঠোনের মতন একটা বেলাভূমি আছে এখানে। এতে নোঙর বেঁধে সারি সারি রঙবেরঙের নৌকার বহর। সবগুলোই সাগরে যাবার জন্যে প্রস্তুত। এখানে দাঁড়ালে নিজেকে আপনা থেকেই ‘মবি ডিক’ সিনেমার ক্যাপ্টেন আহাদ অথবা নিদেনপক্ষে ‘ইসমায়েল’ বলে মনে হবে! সাগরের ভেতরে দুই তিন দিন মাছ ধরার পর এরা ফেরত আসে। আবার কখনো বা ক্রান্তীয় ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে আরও গভীর সমুদ্রে চলে যায়। সেখানেই তাদের সলিল সমাধি ঘটে। এই বীচের স্থানে স্থানে হাজারো ধরনের রঙবেরঙের কড়ি, ঝিনুক আর পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বীচের ওপরে মাছ বিক্রির কাজ চলছে। কোথাও বা ছেড়া জাল মেরামত করছে নারী বা কিশোরীরা। বারাকুডা, মকেরেল, বিশাল আকৃতির চিংড়ি, কাঁকড়া, অয়েসটার, সার্ডিন মাছ- সবই এখানে আছে! একটা ঝাঁকার ভেতরে অনেকগুলো সার্ডিনকে দেখলাম আমাদের দিকে বড় বড় চোখে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে! দেখতে অবিকল আমাদের পদ্মার ইলিশের মতন।

আমার সঙ্গী ক্যাপ্টেন হাসিবের চেহারা খুবই আনন্দমুখর। তার মাথার ভেতরে সারাক্ষণ কোন না কোন নতুন বুদ্ধি বা পরিকল্পনা খেলতে থাকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ স্যার, এটা তো জেলেপাড়ার ঘাট, সাগরের সৈকত নয়। আমরা নিশ্চয়ই এখানে প্রতিদিন আসতে পারব!” আমি মৃদু হেসে বললাম, “ঠিক”!

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

৩,৯৩৫ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “সমুদ্রপারে তাদের পাড়ায় পাড়ায়! (তৃতীয় পর্ব)”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ফ্রিতে বেশ ঘুরছি লেখার সাথে সাথে।
    আর হ্যা যীশুকে যে যার মতন আপন মবের মাদগুরী মিশিয়েই নিজের মতোন করে নিয়েছে। ইউরোপ আমেরিকায় যীশু দেখে মনে হবে নিশ্চিত যীশু ইউরোপীয় বা আমেরিকানই ছিল। আফ্রিকাতে আর অন্যথা কেন। অথচ এ সত্য প্রায় চাপা পড়ে গেছে বুঝি যে, যীশু একজন আরব ফিলিস্তিনী ছিলো।
    অবশ্য শ্বেতাংগ যীশুর আদল তৈরীতে যে ভাবনা ও অভিসন্ধি কাজ করেছে, কৃষ্ণাংগ যীশুর আদল তৈরীতে সেই অভিসন্ধি ও কারন কাজ করেনি।
    পরের পর্বের দিকে ধাবিত হলাম।

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    উপভোগ করছি।
    যদিও কষ্টের জীবন পড়ছি।
    টার্কি আসলেই খেতে তেমন একটা মজা না।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।