জুলিয়েটের ঝুল বারান্দায়

জুলিয়েটের ঝুল বারান্দায়

অনেক সময়ে কাল্পনিক চরিত্ররাও বাস্তব মানুষের চেয়ে বেশি জীবন্ত এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী হয়ে উঠতে পারে! যেমন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’! ১৯১৭ সালের প্রকাশিত হবার পর থেকে দেবদাসের ক্রমাগত মৃত্যু দৃশ্যের বর্ণনা বা মৃত্যুদৃশ্যের অবলোকন চোখের কোণায় অন্তত জল টেনে আনেনি এমন পাষাণ হৃদয়ের বাঙালি আদৌ আছে/ছিল কিনা সে সম্পর্কে আমার ধারনা নেই। ১৯৩৫ সনে প্রমথনাথ বড়ুয়া নির্মিত এবং অভিনীত দেবদাস থেকে শুরু করে ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শাহরুখ খানের আধুনিক ‘দেবদাস’ সকলেই শুধুমাত্র বাংলা ভাষাভাষীদের নয়, পুরো উপমহাদেশের লোকজনদেরই নীরব অশ্রুপাতের কারন হয়েছে। শাহরুখ খান অভিনীত দেবদাসের কারনে সারা দুনিয়া জুড়ে দেবদাস এখন এক অপরিনামদর্শী যুবকের ভালবাসা আর স্বেচ্ছাচারিতার চরম নিদর্শন হয়ে উজ্জ্বল স্ফটিকের মতন ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। অনেকেই দেবদাস হিশেবে শাহরুখ খানের অভিনয়কে বর্তমান পর্যন্ত সর্বোত্তম বলেও বিবেচনা করে থাকেন। এই ছবিটি হিন্দি ছাড়াও ছয়টি বৈকল্পিক ভাষায় সংস্করণ করে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল: ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, মান্দারিন, থাই, এবং পাঞ্জাবী!শুধুমাত্র দেবদাস নয় বাংলা সাহিত্যেই এ ধরনের অলীক কিন্তু বাস্তবের চেয়েই বেশী প্রভাব সৃষ্টিকারী চরিত্র অনেকই আছে! যেমন সুনীলের ‘সেই সময়’ এর নবীন কুমার!

২০১০ সালের গ্রীষ্মকাল। আমার ইটালির ভেরোনা শহরে আসার বৃত্তান্ত অন্যত্র লিখব! তবে এই শহর ছোটবেলা থেকেই আমার খুব পরিচিত ! আমরা ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে আমাদের ইংরেজির শিক্ষক ওয়ালিউল্লাহ স্যার দ্রুত পঠনের অংশ হিশেবে শেক্সপিয়ারের TAMING OF THE SHREW (মুখরা রমণী বশীকরণ) পড়ানোর সময়ে আমরা প্রথম জানতে পেরেছিলাম যে এই ভেরোনা শহরের এক যুবকই ক্যাথারিন নামের সবচেয়ে মুখরা রমণীটিকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলো।‘ROMEO AND JULIET ‘ ছবিটাও আমি দেখেছি নীচের ক্লাসের দিকেই, যেটারও ঘটনাস্থল এই ভেরোনা শহর! এমনকি এই শহরের পার্শ্ববর্তী নিকটতম শহর ‘ভেনিস’ও আমাদের নিকটে অতিপরিচিত শুধুমাত্র জলের ওপরে ভাসমান শহর হিশেবে নয়!’DON’T LOOK NOW’ নামের অতিপ্রাকৃত ছবিতে আমি এর মনোহারী ও রহস্যময়ি রুপ দেখেছি।কাজেই ২০০১ অথবা ২০০২ সালের দিকে আমি যখন ১৯৯৯ সালে আমেরিকান চলচ্চিত্রকার জন মেডেন রোমিও-জুলিয়েটের ট্র্যাজেডির কাহিনীকে ভিত্তি করে রোমান্টিক কমেডি ড্রামা ‘SHAKESPEARE IN LOVE’ ছবিটা তৈরি করলেন এবং তা সাতটা একাডেমী পুরস্কার জিতে নিল তখনো আমি খুব একটা অবাক হয়নি। তবে অবাক হয়েছিলাম ছবিটার শেষ দৃশ্য দেখে। এই দৃশ্যে শেক্সপিয়ারের অন্য অনবদ্য সৃষ্টি ‘TWELFTH NIGHT’ এর প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করা হয়েছে চমৎকারভাবে।

উইলস বা উইলিয়াম শেক্সপিয়ার একজন যুবক বয়সী উঠতি কবি, নাট্যকার এবং অভিনেতা। তার ভালবাসার জীবন বিশীর্ণ হয়ে পরলে তার ভেতরে সৃষ্টিশীলতার অভাব ঘটে! এই সময়েই তার নাটকে অভিনয় করার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে ভিওলা (VIOLA) নামের এক অভিজাত বংশের যুবতী পুরুষের পোষাকে অডিশন দিতে আসে। কারন ওই সময়ে (১৫০৩ সালে) ইংল্যান্ডে আমাদের দেশের মতন ছেলেরাই নাটকে মেয়েদের ভুমিকায় অভিনয় করতো এবং মেয়েদের অভিনয় করার অনুমতি ছিলনা। ঘটনাক্রমে উইলস এর কাছে ভিওলার আসল পরিচয় উদঘাটিত হয়ে যায় এবং তারা পরস্পরের সাথে ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এই ভালবাসাই উইলস এর ভেতরে সৃষ্টিশীলতা ফিরিয়ে নিয়ে আসে। সে তার সমস্ত নান্দনিকতা দিয়ে সৃষ্টি করে তার নাটক ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’। কিন্তু তাদের ভালবাসা সার্থক হবার নয়। কারন ভিওলা এক অনুদার রাজপুত্র লর্ড ওয়েসেক্স (LORD WESSEX) এর বাগদত্তা। অতঃপর যা হবার তাই হয়। নাটকের প্রথম প্রদর্শনী শেষে রানী লর্ড ওয়েসেক্স এর সাথে ভিওলার বিবাহ অনুমোদন করেন এবং নির্ধারিত হয় যে বিয়ের পর নববিবাহিত দম্পতি জাহাজে করে আমেরিকায় তাদের তামাক চাষের ক্ষেত্রে চলে যাবেন। তবে ভিওলার ভালবাসা ইতিমধ্যেই উইলস এর সৃষ্টিশীলতাকে বিকশিত করেছে। ভিওলা চলে যাবার পর উইলস আবার কলম ধরে এবং ভিওলার প্রতি তার ভালবাসার অর্ঘ দিয়ে সৃষ্টি করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাস্টারপিস সমুহের অন্যতম ‘TWELFTH NIGHT’! ‘SHAKESPEARE IN LOVE’ ছবিটার শেষ দৃশ্যটিতে উইলস/ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার লিখতে লিখতে ভাবছেন, “My story starts at sea, a perilous voyage to an unknown land. A shipwreck. The wild waters roar and heave. The brave vessel is dashed all to pieces. And all the helpless souls within her drowned. All save one. A lady. Whose soul is greater than the ocean, and her spirit stronger than the sea’s embrace. Not for her a watery end, but a new life beginning on a stranger shore. It will be a love story. For she will be my heroine for all time. And her name will be Viola.” ততক্ষণে দৃশ্যপটে ভাসছে ডুবে যাওয়া এক জাহাজ থেকে সাঁতরে ভিওলা উঠছে এক নিবিড় সমুদ্র সৈকতে!

ছবিতে আর একটা দৃশ্য আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল তাহলো ভেরোনা শহরে জুলিয়েটের বাড়ীর ব্যালকনি বা ঝুলবারান্দা যেখানে উইলস এবং ভিওলা পরস্পরকে ভালবাসা নিবেদন করে। ইটালিতে এসে যখন শুনলাম ভেরোনাতে জুলিয়েটের বাড়ী আছে, তখন আমার এই ঝুলবারান্দা দেখার প্রবল লোভে পেয়ে বসলো।

জুলিয়েটের বাড়ীর সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই আপনার চোখে পরবে দুই পাশের দেয়ালের গায়ে বিকীর্ণ অসংখ্য হস্তলিখিত ভালোবাসার নোট! এদের ভেতর দিয়ে পেছনের দেয়ালকে দেখাই যায়না। এখানে আগত পর্যটকদের বিশ্বাস এই দেয়ালের গায়ে যদি তারা কোন ভালবাসার প্রতিজ্ঞার কথা লেখে তবে তা কোনদিনই ভঙ্গ হবেনা। ভেতরে ঢুকতেই উঠানের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ব্রোঞ্জের তৈরি জুলিয়েটের সোনালী রঙের মূর্তি। সবাই এর পাশে দাঁড়িয়ে এবং একে জড়িয়ে ছবি তুলছে! একে স্পর্শ করে দেখছে। জুলিয়েটের মূর্তির বামদিকে মাথার ওপরে সেই বিখ্যাত ঝুল বারান্দা যেখানে দাঁড়িয়ে রোমিও জুলিয়েটকে তার অন্তহীন ভালবাসার কথা বলেছিল!

জানা গেল জুলিয়েটের বাড়ীটি ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে বিদ্যমান ‘দাল ক্যাপেলো’ নামক পরিবারের মালিকানায়। ভেরোনা শহর কর্তৃপক্ষ ১৯০৫ সালে এই পরিবার থেকে এটা কিনে নেয়। বিখ্যাত ব্যালকনি বা ঝুলবারান্দাটাও বিংশ শতাব্দীর আগে এতে যোগ করা হয়নি! কিন্তু এতে কার কি আসে যায়? কাল্পনিক রোমিও এবং জুলিয়েট সেই কবে থেকে সত্যের চেয়েও বেশি ভালবাসার আলো বিকিরন করে যাচ্ছে সারা জগৎময়। সম্প্রতি শুনেছি জুলিয়েটের ঝুল বারান্দাটাও ইদানিং মুক্ত করে দেয়া হয়েছে পর্যটকদের জন্যে। তারা এখানে টাকার বিনিময়ে যুগল সেলফি তুলছে! “বিশ্বাসে মিলায় স্বর্গ, তর্কে বহুদুর”!

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

৩,৬৯৮ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “জুলিয়েটের ঝুল বারান্দায়”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    এই হস্তলিখিত নোটগুলোর ভেতরে আমার একখানা নোটও আছে, সেই দুহাজার চোদ্দতে লিখে এসেছিলাম। যার জন্যে লিখেছিলাম সে আজ বহুদূরে- আমাদের গল্পটা এক হবার কথা থেকেও হয়নি। তবুও, লেখাটা আছে, সেই সাথে আছে তালাও, ওর নামে লেখা।

    কত কথা মনে করিয়ে দিল লেখাটি!!!!

    জবাব দিন
  2. ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)
    আমরা ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে আমাদের ইংরেজির শিক্ষক ওয়ালিউল্লাহ স্যার দ্রুত পঠনের অংশ হিশেবে শেক্সপিয়ারের TAMING OF THE SHREW (মুখরা রমণী বশীকরণ) পড়ানোর সময়ে আমরা প্রথম জানতে পেরেছিলাম যে এই ভেরোনা শহরের এক যুবকই ক্যাথারিন নামের সবচেয়ে মুখরা রমণীটিকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলো।

    ইনি পরে পিসিসি'র অধ্যক্ষ ছিলেন সম্ভবতঃ



     

    এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এটাও খুব উপভোগ্য ছিল।
    ইওরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিন এশিয়া - কত কত জায়গাই না মনে মনে ঘোরা হচ্ছে এই লিখাগুলি পড়ে...
    অনেক ধন্যবাদ স্যার, লিখে শেয়ার করার জন্য!!!
    :boss: :boss: :boss:


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।