‘আজন্ম সলজ্জ সাধ – একদিন আকাশে কিছু ফানুশ উড়াই…’

‘আজন্ম সলজ্জ সাধ – একদিন আকাশে কিছু ফানুশ উড়াই…’

আমার দুই মেয়েরই খুব পছন্দ বারবি ডল। প্রায় দুই দশক সময়কাল ধরে এই বারবি ডলগুলো আমার বাসায় সঞ্চিত হচ্ছে। প্রথম দশ বছর জমিয়েছে আমার বড় মেয়ে এবং পরের দশ বছর জমিয়েছে আমার ছোট মেয়ে। সংখ্যায় এরা দুই ডজনের মত। গত দুই দশকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এই বারবি গুলোর ফ্যাশনে পরিবর্তন লক্ষণীয়। তবে মজার ব্যাপার হল দুইজনের ভেতরে বয়সের পার্থক্য প্রায় এক দশক হলেও এবং একজন ইউনিভার্সিটিতে ও অন্যজন ক্লাস ফোরে পড়লেও এখনো প্রায়শই দুই বোনের মধ্যে পুতুলগুলোর মালিকানা, কোন সময়ের পুতুলগুলো বেশি স্মার্ট ইত্যাদি নিয়ে খুনসুটি চলে !

শৈশব উত্তীর্ণ না হওয়া মেয়েটার নাম আঙ্গুরি। বাবার নাম মজিবর। আমরা ডাকি মজিবর ভাই। আমাদের বাড়ীতে দিনমজুরের কাজ করে। তার মা আমাদের বাড়ীতে ধানের মৌসুমে ধান ভানে। আর আঙ্গুরি সারাদিন পুতুলের মতন আমাদের উঠোনে সারাদিনময় ঘুরে বেড়ায়। কি এক অজানা কারনে আমাদের সকল ভাইদের সে ‘মামা’ এবং সকল বোনদের সে ‘খালা’ বলে ডাকে!

প্রতি ঈদে আমাদের তেঘরিয়া বাজারে ঈদের মেলা বসে। বালিজুরির কাছে একটা কুমোর পাড়া আছে। এই কুমোরেরা শত বছর ধরে হাতে টেপা মাটির পুতুল তৈরি করে। পুতুলগুলো দেখতে অদ্ভুত ধরনের। নাক মুখ সবই চ্যাপ্টা। কোন ছাঁচ ব্যবহার না করে শুধুমাত্র হাতে তৈরি করার কারনে এদের মুখের ভাষা এবং অবয়ব দুইই বিস্ময়করভাবে প্রতীকী। মনে হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ এর মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পার পুতুলেরা সব ঘুরতে ঘুরতে আমাদের জামালপুর, ময়মন সিংহ এলাকায় চলে এসেছে!

সে বছর ভাল ধান ফলেনি। তবুও প্রতিবছরের মতন ঈদের মেলা বসেছে। বাড়ীর সব শিশুদেরকেই তাদের বাবা মায়েরা মেলা থেকে মাটির পুতুল কিনে দিয়েছে। আমাদের উঠোনে কিনে আনা চ্যাপ্টা নাক ঠোঁটের কিশোরী পুতুল, সন্তান কোলে যুবতী পুতুল, গৃহপালিত গরু পুতুলদের মিলন মেলা বসেছে। এই পুতুলদের চারপাশ ঘিরে রেখেছে বাড়ীর সকল শিশু, কিশোরী এমন কি কিশোরেরাও। যার মধ্যে আমিও একজন! পুতুলদের বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং এটা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে প্রবল বিতণ্ডা চলছে। আঙ্গুরি বিমর্ষ! তার বাবা তাকে কোন পুতুল কিনে দিতে পারেনি। বরং ক্ষেপে যেয়ে বলেছে যে, সারাদিনের গতর খাটা টাকা দিয়ে তার পক্ষে চাল, ডালই কেনা সম্ভব না, সে কি করে তাকে পুতুল কিনে দেবে? এর পর আঙ্গুরি আর কোনোদিন তার বাবাকে পুতুলের কথা বলতে পারেনি, কারন সে বছরই এক মহা দুর্ভিক্ষ এসে তার বাবাকে চিরদিনের মতন ছিনিয়ে নিয়ে গেছে!

আঙ্গুরির এখন আর আপাতত পুতুল খেলার অবকাশ নেই। সে এখন রক্ত মাংশের পুতুলদের সেবা শুশ্রূষায় ব্যস্ত। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের বাড়ীতে আমার মেঝো চাচার সংসারে স্থায়ী কাজের বুয়া হিশেবে স্থান পেয়েছে সে। আমার চাচী খুব অলস প্রকৃতির। সন্তান জন্ম দেয়া ছাড়া আর কোন দায়িত্ব গ্রহন করতে তিনি রাজি নন। কাজেই খুব সকালে উঠে সবার সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার তৈরি করা, প্রতিবছর একটা করে জন্ম নেয়া চাচীর প্রায় এক ডজন শিশু থেকে কিশোর/কিশোরীদের কোলে পিঠে করে মানুষ করা, লোহার কড়াইতে ধান সিদ্ধ করা, ঢেঁকীতে মধ্যরাত পর্যন্ত ধান ভানা শেষ করে শুধুমাত্র বাড়ীর কুকুরগুলোরও পরে যখন সে ঘুমাতে যায় তখন তার স্বপ্নের ভেতরে পুতুলেরা আসে!

অবশেষে একদিন তার বিয়ে হয় আমাদের পাশের বাড়ীর এক দিন মজুরের সাথে। বিয়ের কয়েকদিন পরই স্বামীকে কথাটা পাড়ে। স্বামী রেগে অস্থির। বাবার কথার পুনরাবৃত্তি করে বলে, “ সারাদিন অন্যের ক্ষেতে লাঙ্গল চালিয়ে যা জোটে তাতে এক কেজি চালই কেনা সম্ভব হয় না , আবার পুতুল? তোমার কি পুতুল খেলার বয়স আছে নাকি?”

আমি সেনাবাহিনিতে চাকুরি পেয়েছি। ছুটিতে বাড়ি গিয়েছি। আঙ্গুরিদের কুঁড়েঘর আমাদের বাড়ীর পাশেই। ছুটিতে বাড়ীতে যেয়ে আশেপাশের কয়েক বাড়ীর আত্মীয় স্বজন, এমনকি গ্রামের পরিচিতদের সাথে দেখা করে আসা আমার ক্যাডেট কলেজে ভর্তির পর থেকে অভ্যাস! আঙ্গুরির সাথে দেখা হবার কিছুক্ষন পরই সে আমাকে বলে বসলো, “মামা, আমাকে একটা পুতুল কিনে দিবা?” আমি আঙ্গুরির পুতুল প্রীতির কথা ছোটবেলা থেকেই জানি। আমি হাসতেই সলজ্জ্যভাবে সে আবার বলল, “আমার জন্যে না, আমার মেয়ের জন্যে!”

– মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

৪,১৪৯ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “‘আজন্ম সলজ্জ সাধ – একদিন আকাশে কিছু ফানুশ উড়াই…’”

  1. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    একবার গোটা চারেক বারবি নিয়ে দেশে এসেছিলাম, পুতুল খেলার বয়েসের জনা চারেক কাজিন কে দেব বলে, একটা ছিল মেক্সিকান বারবি, যার গায়ের রঙ কিছুটা শ্যামলা। ওটা যার ভাগে পড়ে সে বেশ ব্যাজার হয়েছিল।

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    জীবনের রঙগুলো এমনই কি!
    কোথাও উজ্জ্বল জ্বলজ্বলে কোথাও ঝলমলে কোথাও ধূসর হয়ে কথা বলে। তবু সবই রঙ।
    কোথাও নাটুকে। কোথাও গল্পের মতো। কোথাও রূপোলী পর্দা রাঙা। কোথাও গায়ে তার একটুও থাকে না ঢঙ...

    :boss: :boss:

    জবাব দিন
  3. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    তোমার গল্পের যতগুলো পড়েছি, সবগুলোই মনে গভীর রেখাপাত করে যায়, আসাদ। এই ছোট্ট গল্পটাও ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে গেল। গল্প শেষ করে আবার স্ক্রল আপ করে শিরোনামটা পড়ি, আর ভারাক্রান্ত হই।
    অসাধারণ হয়েছে। :hatsoff:

    জবাব দিন
  4. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    কত কত সাধই না অপুর্ন রয়ে যায় সারাটা জীবন ধরে...

    বাহাত্তর থেকে পচাত্তর পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি ল্যাবে পড়েছি।
    সহপাঠিদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন থাকতো বিদেশ বিভুই-এ। দেশে আসার সময় তাঁরা ওদের জন্য ম্যাচবক্স নিয়ে আসতো।
    সেগুলো ক্লাসে এনে টিফিন টাইমে রেস হতো মেঝেতে বা টেবিলে।
    ম্যাচবক্সের কার-রেস।
    আমার যেহেতু বিদেশে কেউ ছিল না, ম্যাচবক্স পাওয়া হয় নাই কখনো।
    ক্লাস থ্রীতে ফার্স্ট হলাম। আব্বা সাথে করে অনেক কিছুই কিনে দিলেন উপহার হিসাবে।
    সেই উল্লাসে একবার নিউমার্কেটে দোকানে একখানা ঝা-চকচকে ম্যাচবক্স কেনারও আবদার করে ফেললাম।
    কিন্তু চুয়াত্তর সালটা যে বড়ই বেয়াড়া ছিল, তখন বুঝি নাই।
    এখন বুঝি।
    আর তাই সেদিন ৬৪ টাকায় ঐ দু'ইঞ্চি গাড়িটা আর কেনা হয় নাই।
    ৪০ টাকার এক মন চাল কেনা যেতো যে সময়ে, একটা ম্যাচ বক্সের জন্য ৬৪ টাকা তো সেসময়ে অনেক টাকাই, তাই না?

    আমার আর কখনো ম্যাচবক্স কেনা হয় নাই।
    কন্যাদের একবার কিনে দিলাম খান কতক।
    কিন্তু কি যে অবহেলায় পরে থাকতো তা দেখে ভাল লাগে নাই।
    একেতো এত্তোটুকুন খেলনা, তার উপরে নিজে নিজে চলে না - পছন্দ হবে কিভাবে?
    ওদের তো আর একে ভাল লাগার পিছনে অন্য কোনো গল্প নাই......

    আঙ্গুরির কন্যারাও হয়তো এমনই অবহেলায় ফেলে রাখতো পুতুলগুলো আর তা দেখে মন ভেঙ্গে যেত তাঁর...
    কী জানি??? (সম্পাদিত)


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আসাদ (৭৭-৮৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।