প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন

“জঙ্গলে যাবার কোনো দিনক্ষণ নির্ধারিত নেই,
যে-কোনো সময়ে তুমি জঙ্গলের মধ্যে যেতে পারো”।—শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ফেলে আসা দৃশ্যাবলী কত স্পষ্ট!

আমার সাথে কখনই তাঁর সামনাসামনি দেখাসাক্ষাৎ হয়নি।কয়েকদিন মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে মাত্র। আমি ক্যাডেট কলেজে ঢোকার অনেক আগেই তিনি কলেজ থেকে পাশ করে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন! তার সাথে আমার পরিচয়ও ভার্চুয়াল। ফেসবুকে আমিই তাকে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠিয়েছিলাম এবং তিনি তা গ্রহন করেছিলেন তার ফ্রেন্ডলিস্টের অনেকের সাথেই আমার পরিচয় আছে দেখে। অথচ এর মধ্যেই তিনি শুধু আমার ফেসবুকের বন্ধু নয়, বাস্তব জীবনেও আমার একজন অভিভাবক হয়ে গেছেন! কয়েকদিন আগে তিনি আমাকে রিং করে বললেন, “আসাদ, তুমি কি কলেজের পুনর্মিলনইতে যাচ্ছ?” আমি শুধুমাত্র একদিন অর্থাৎ শুক্রবারে যেতে পারি জানাতেই তিনি আমাকে বললেন,“দুপুরের লাঞ্চের পর তুমি আমাকে ডাইনিং হলের সামনে থেকে একটা রিং দিও; আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো!” জিনিসটা কি জানার জন্যে প্রবল ইচ্ছে জাগলেও আমি ইচ্ছেটাকে চেপে রাখলাম এবং তাকে বললাম, “ঠিক আছে ভাইয়া”!

জাহেদ, ফয়সল, মাওলা, শাহরিয়ার, মনজুর আলম আর আমি এক সাথে যাচ্ছি। সবারই পরিবার সাথে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই অদ্ভুত কোন কারনে আমাদের পরিবারকে নিবৃত করেছি আমাদের সঙ্গী হতে!ফয়সল চেয়েছিল কলেজে যেয়ে সকালের নাস্তা করতে। আমি বাঁধা দিলাম; আমার পক্ষে সকাল নয়টা/দশটা পর্যন্ত না খেয়ে থাকা সম্ভব নয়। এখন থেকে ৩৯ বছর আগে আমার প্রাথমিক কৈশোরে সকাল সাড়ে সাতটার ভেতরে নাস্তা করার অভ্যেস আমার বিদ্যাপীঠ আমার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে! কাজেই পথিমধ্যের রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্ট থেকেই যথাসময়ে নাস্তা সেরে আমরা কলেজে গমন সম্পন্ন করলাম।

পরিচিত প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতেই গার্ড আমাদেরকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানালো, অথচ এই গার্ডের দৃষ্টিকেই এড়িয়ে কলেজের বাইরে চলে যাবার জন্যে কি প্রানান্তকর প্রয়াশই না আমাদের ছিল ! ভেতরে ঢুকতেই মুহূর্তের মধ্যে অনুভব করলাম আমার খুব কাছের জায়গায় চলে এসেছি। এখানকার রাস্তাঘাটগুলো আমার নখদর্পণে, এখানকার মেরুন রঙের গাছপালাগুলোর সাথে আমি নিবিড় পরিচিত, ঝকঝক করতে থাকা বয়স্ক একাডেমীক ব্লক, ফজলুল হক হাউজ, ডাইনিং হল, সোহরাউয়ার্দি হাউজ, দূরে পেয়ারা বাগানের সামনে আমার নজরুল হাউজ, এমনকি কলেজের মাঠে রেজিস্ট্রেশন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর সাথেও! শুধুমাত্র শারীরিকভাবেই এদের সবার বয়স বেড়েছে -মুখের ভাব, চোখের দৃষ্টি সকলই আঁটকে আছে অতীতের সবুজ কোন উপতক্যায়! রফিক ভাই এসেছেন সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে সাথে রফিক কায়সার স্যার। পাশাপাশি দুজনের ভেতরে কে বয়োজ্যেষ্ঠ সেটাও বুঝা মুশকিল!স্বপন আর মুন্না ভাইয়ের মাথায় শ্বেতশুভ্র চুল, কিন্তু মুখের হাসিটা রয়ে গেছে ঠিক আগের মতন। স্বপন ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে মুহূর্ত পরেই তিনি আমাদেরকে গরু, ছাগল, ভেড়া তার ইত্যাদি প্রিয়নামে ডাকা শুরু করবেন!

পুনর্মিলনইর জন্যে কলেজ নয়নাভিরাম সাজে সেজেছে। এই সাজগুলোকে অতিক্রম করে আমি নজরুল হাউজের সামনের বাগানের ভেতরে ঢুকে পরি। সেই গাঁদা, সূর্যমুখী আর ডালিয়া ফুলের মেলা। এই ফুলের বাগানেই আমি ছবি আঁকা শিখেছি। বাগানের ঠিক মাঝখানে সেঞ্চুরি ফ্লাওয়ারের গাছটায় এখনো ফুল ফুটে নাই। আমার মৃত্যুর আরও অনেক বছর পরে হয়তো এতে ফুল ফুটবে। এক শতাব্দী সময়ত তো কম নয়। গত পুনর্মিলনইর পূর্বের পুনর্মিলনইতে আমি আর সাহেল এই বাগানের ভেতরেই দাঁড়িয়েছিলাম। সাহেল বলছিল, “এখানে আসলে মনটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয় একারনে যে, একমাত্র এখানেই আমাদের পরিপার্শ্ব অতোটা পরিবর্তিত হয়নি, যেঁটা হয়েছে আমাদের পরিচিত অন্য জায়গাগুলোতে!”

দুপুরের পর আমি ভাইয়াকে রিং করলাম। আমার অবস্থান জানাতেই একটু পরে তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমরা দুজন হয়তো এতক্ষণ প্যান্ডেলের নীচে প্রায় পাশাপাশিই বসে ছিলাম। আমাদের দুজনের ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার বয়সে আমাদের চেয়ে নবীন, যেখানে আমরা দুজনেই আমাদের যৌবন অথবা যৌবন উত্তর কোন সময়কে ধরে রাখতে চেয়েছি! তিনি আঙুল দিয়ে ফজলুল হক হাউজের পশ্চিম-উত্তর কোণার দিকে নির্দেশ করে বললেন,
-“আমাদের সময়ে এখানে একটা ছোট ধরনের কাঁঠাল গাছ ছিল”। এইটুকু বলে তিনি একটু থামলেন। আমারও ঠিক মনে আছে এখানে মাঝারী আকৃতির একটা কাঁঠাল গাছ ছিল, যার নীচে কাফি, সোহেল শাহরিয়ার, আব্দুল্লাহ, বাহাদুর আর আমি বিউগল বাজানো শিখেছিলাম। তিনি পুনরায় শুরু করলেন,
– “আমরা কলেজ থেকে চলে যাবার দিনে বাসে ওঠার জন্যে আমাদের ব্যাচের সবাই এখানে দাঁড়িয়েছি। কলেজ থেকে চলে যাবার বিষয়টা এখনো আমাদেরকে তাড়া করছেনা। বরং সবার ভেতরেই একটা আনন্দময় কৌতুকভাব কাজ করছে। আমি ক্লাসমেটদেরকে বললাম, আমি প্রিন্সিপালকে পা ধরে সালাম করতে পারব! আমার কথা শুনে একজন বলল, তুই সালাম করতে পারলে আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে পারব। কাজেই প্রিন্সিপাল আসতেই আমি যেয়ে তার পায়ে কদমবুচি করলাম। মুহূর্তের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। তারপরে সবাই আমাকে অনুসরন করে একে একে অধ্যক্ষকে কদমবুচি করে ফেলেছে! এরপর আমার বন্ধুর পালা। এবারে তাকে কাঁদতে হবে। আমরা নিশ্চিত যে সে কাঁদতে পারবেনা, হেসে দেবে। কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে সত্যি সত্যিই কেঁদে দিল। তার কান্না শুনে আমরা সবাই একযোগে হেসে উঠলাম। কিন্তু কি একটা অদ্ভুতকারনে আমাদের হাসিটাকে কান্নার মতন শোনাচ্ছে! এর পর বাসের ভেতরে শুরু হল আমাদের পর্যায়ক্রমে কান্না। যে মুহূর্তে আমরা ঢাকায় পৌঁছলাম, তখন আমাদের সবার চোখে জল!”

আপনি যখন এধরণের স্মৃতিচারণের মুখোমুখি হবেন তখন অভাবনীয়ভাবে আপনিও তখন একই ধরনের স্মৃতি দ্বারা আক্রান্ত হবেন। আমার স্মৃতিতে তখন ভিড় করছে কলেজে আমাদের শেষদিনের স্মৃতি! ক্রমশ আক্রান্ত হবার আগেই আমি উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বন্ধুদের ভিড়ে মিশে গেলাম। আয়োজকদের পক্ষ থেকে তখন মহিলাদেরকে ‘পিলো পাসিং’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের জন্যে আমন্ত্রন জানানো হচ্ছে।

সন্ধার পর আতশবাজি ফোটানোর মাধ্যমে সবাই পুনরুজ্জীবিত। কুমার বিশ্বজিতের গান শুরু হবে। আমাদের কৈশোর থেকে আমাদের সন্তানদের কৈশোর পর্যন্ত সবাইকে এই মহান গায়ক একইভাবে আন্দোলিত করতে সক্ষম! সবাই মিলে চিৎকার করছে ‘ও ডাক্তার, ও ডাক্তার…’ বলে। কিন্তু আমাদের কয়েকজনের ফিরে যাবার সময় হয়ে এসেছে। ডাক্তার বাহাদুরকে নিয়ে আমি, ফয়সল, মনজুর এবং মাওলা ফিরে যাচ্ছি। আগামিকাল ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সাভার ক্যাম্পাসে আমার বড় মেয়ের প্যারেন্টস ডে’তে আমাকে উপস্থিত হতে হবে। জাহেদ, কাফি, মুরশেদ আনাম, আখতার –এরা কলেজেই রয়ে গেল। এরা তিন দশক আগের কলেজের রাতের পৃথিবীকে পুনরাবিস্কার করতে চায়!

মনজুর আমাদের গাড়ীর চালক। তার গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে বাজছে কোক স্টুডিও’র রবীন্দ্রসঙ্গীত, গজল এবং লালনগীতি। আমাদের মধ্যে বাহাদুরই দেখলাম সঙ্গীতের বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী। সে অবলীলায় শুধু মিউজিক শুনে গানটা কোন সঙ্গীত এবং গানের প্রথম কলি কি হবে তা বলে দিচ্ছে। রাত একটার দিকে বাহাদুরকে তার সেগুনবাগিচার বাসায় নামিয়ে দিয়ে মহাখালী ডি ও এইচ এস এর দিকে আসতেই মনজুর দরাজ গলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতা আবৃত্তি শুরু করে দিল। কলেজে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের জন্যে শেখা পুরো কবিতাটাই তার এখনো মনে আছে! এত রাতে রাস্তায় গাড়ী নেই বললেই চলে। চারপাশটা নিস্তব্ধ। আমি খেয়াল করলাম মনজুরের আবৃতির সাথে সাথে আমাদের চারপাশের প্রকৃতিও ক্রমশ জেগে উঠছে। এখন রাত পৌনে দুটো। কিন্তু আকাশের ভেতরে একটা ফিকে ভাব বিরাজ করছে! ফয়সল আর আমি বিমোহিত। (ছবি মাহমুদ ভাই)

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৭ জানুয়ারি ২০১৬

৩,৫৪৬ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “প্রত্যাবর্তন”

  1. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    একটানে পড়ে ফেললাম ভাইয়া। স্মৃতির ভেলায়ও চড়া হলো কিছুটা সময়....যদিও স্থান,কাল,পাত্র ভিন্ন তবুও সুরটা একই.....নস্টালজিয়া!!!
    দারুণ!!!


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    অনেক কিছুই খোলাসা করলেন না।
    না বললেও মনে হচ্ছে, এটার আর একটা ফলো আপ পাবো...
    অপেক্ষায় থাকলাম!!!

    যথারীতি সুখপাঠ্য ও গতিময়, আমার জন্য যেটা খুবই গুরুত্বপুর্ন.........
    😀 😀 😀 😀 😀


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ট্যাগে দিনলিপি আর রিইউনিয়ন দিয়ে দিয়েন।
    ভালো লেগেছে।

    আমাদের ক্লাসে কান্না শুরু করেছিলাম আমি।
    আমাদের তো তিন হাইজ একত্রে।
    আমার হাউস মাঝের শেরে বাংলা।নিচে শরীয়তুল্লাহ য় নেমেই মনে হলো এখানে আর আসা হবে না। সাথে সাথে চোখ বেয়ে পানি নামা শুরু হলো।
    পরে অবশ্য অনেকে কেঁদেছে। বাসে উঠে তো মোস্তাক ভেউ ভেউ করে কাদা শুরু করলো।
    আর জুনিয়র অনেকে এমনকি কোন কোন স্যার ও কেঁদেছিলেন।
    আসলেই ক্যাডেট কলেজ মানে আমাদের কাছে অনেক কিছু। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় হয়তো।
    আসলে কচি বয়স ছিলো বলেই হয়তো এমন।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ক্যাডেট কলেজের প্রথম দিন টিপ টিপ বৃষ্টির ভেতর বিশাল নতুন এক প্রাঙ্গণ যখন তার সমস্ত চমক নিয়ে ক্ষুদে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিলো সেই সময়টাতেই অপার বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম ইয়া বড় বড় কতোগুলো মানুষের ভেউ ভেউ করে কান্নার দৃশ্য।
    আমাদের শুরু আর তাঁদের সেদিন বিদায়ের পালা...

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আসাদ (৭৭-৮৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।