বিনিময়

বিনিময়

টাকাটা আমার প্রয়োজন ছিল, তবে বিনিময়টা যে এধরনের হবে সেটা আমার ধারনার ভেতরেও ছিলনা!

একটা ‘যা ইচ্ছে তাই’ ধরনের স্বাধীন শৈশব আমি পেয়েছিলাম। আমি সাঁতার শিখেছিলাম সবার অজান্তে এক বিশাল বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে বয়ে যাওয়া সদ্য আসা বানের পানির প্রবল স্রোতের ভেতরে এক দঙ্গল পিঁপড়ের সাথে ঘোলা পানি খেতে খেতে! আগের দিন সারাদিন ধরে আমি এবং আমার বন্ধুরা সবাই মিলে ঝাড়কাটা নদী থেকে এই বানের পানিকে আমন্ত্রন করে এখানে ডেকে এনেছিলাম। একটু উঁচু ধরনের এই জায়গাটার নাম ‘কামারের ভিটা’। আমাদের বাড়ী থেকে উত্তর দিকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে। এই ভিটাতে আছে শুধুমাত্র একটা বাঁশঝাড় যা দুপুরের সময়েও মাটির দিকে বেঁকে এসে দিনকে সন্ধ্যের মতন প্রায়ান্ধকার করে রাখে; একটা বিশাল কড়ইগাছ চৈত্রে যার মাথা থেকে অজস্র গরুর গলার ঘুঙুর বাজতে থাকে; একটা মান্দার গাছ যার শরীর থেকে সারা বছর ধরে ঝরে পরে অনিন্দ্য সুন্দর সব রক্তের মতন লাল রঙের ফুলের পাপড়ি বৃষ্টির মতন ঝরে এবং একটা বিশাল আকারের শিমুল গাছ যা চৈত্রের সময়ে কিংশুকদের মতন লাল হয়ে বেদনার্ত করে তোলে পাশের প্রান্তর।এই ভিটাতে আর ছিল একটা বারোমাসি বিশাল সবুজ আমের গাছ যা সকল ঋতুতে ঋতুমতী হয় এবং তেতুলের চেয়েও টক অসংখ্য আম্র সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে। আমি এই আম গাছের শাখাগুলোতেই শাখামৃগদের মতন সারা দিনমান ধরে বিচরন করি। মূল আকর্ষণ এই কাঁচা আমগুলো। দুপুরের খাবার আমি খেয়েছি কিনা সে বিষয়েও কারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। শুধুমাত্র গোধূলির আলো নিভে এলেই মাত্র বাড়ী হতে আমার খোঁজ পরে!

প্রায়ন্ধকার এই বাঁশঝাড়ের নীচেই ছন, বাঁশ আর খড়কুটো দিয়ে তৈরি কাকের বাসার মতন বাসার মতন একটা আশ্রয় তৈরি করে নিয়েছে এক যুগল কামার দম্পত্তি –স্বামী ও স্ত্রী।পাশেই তাদের দোকান।শীতের মৌসুমে সূর্য ওঠার আগেই আমি এখানে পৌঁছে যাই হাঁপরের বাতাসে শরীর গরম করে নেবার জন্যে আর দেখার জন্যে যে কিভাবে আমার চোখের সামনে লোহার দণ্ডগুলো লাল টুকটুকে বর্ণ ধারন করে সকালের রক্তিম সূর্যের মতন। কিছুক্ষন পর যখন তারা রূপান্তরিত হয় রুপালী চাঁদের মতন কাস্তেতে আমার আনন্দ আর ধরেনা। পূর্বে এই ভিটাতে কয়েকটা কামার পরিবার একসময়ে বাস করতো। কিন্তু যুদ্ধের পর অজানা কোন কারনে এরা মেলান্দহ বাজার, ভারত বা অন্য কোথাও চলে যেতে থাকে! এবিষয়ে অবশ্য এলাকার কারুরই কোন আগ্রহ ছিলনা।ফড়িং-দোয়েলদের জীবন নিয়ে কারই বা আগ্রহ থাকে? কাজেই আমার শিশুকালে শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল শুধুমাত্র এই যুগল দম্পত্তি।

শুধুমাত্র যে উত্তাপ পোহানোর জন্যে বা লোহার রডের রঙ লাল হয়ে যাওয়া দেখতে আমি এই কামার পরিবারে বা তাদের দোকানে যাতায়াত করতাম তা নয়! আমার এই যাতায়াতের পেছনে আর একটা ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। আগের বছরের মেলাতে আমার চাচাকে আমি বলেছিলাম কাঁচা আম কাটার জন্যে আমাকে একটা ছুরি কিনে দিতে। তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এই বলে যে, আমার মতন শিশুর জন্যে এই ধরনের সরঞ্জামাদি নিরাপদ নয়। কাজেই কামারের ভিটার একমাত্র উত্তরাধিকারী নিতাই কামারই ছিল আমার শেষ গন্তব্য যার কাছ থেকে আমি বিনা পয়সায় একটা ছুরি তৈরি করিয়ে নিতে পারি। একারনে আমি কয়েকদিন তার কামারের দোকানের হাঁপরের রশিও ফ্রি টেনে দিয়েছি! অবশেষে তিনি একদিন তার কাছে থাকা অতিরিক্ত লোহার রড দিয়ে চমৎকার একটা ছুরি বানিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। দেখতে অনেকটা হুজুরদের কর্তৃক কোরবানির গরু জবাইয়ে ব্যবহৃত ছুরির ক্ষুদ্র সংস্করন। অস্ত্রটা হাতে পেয়েই আমার মনের বল বেড়ে গেল প্রবলভাবে। এটা দিয়ে আমার তখন আর শুধু আম কাটতে ভাল লাগেনা! আমাদের পিছনের বাড়ীর ছেলেদের সাথে আমার আজন্ম শত্রুতা। ওরা পঞ্চাশজন আর আমি একা। কাজেই একদিন সুযোগ বুঝে তাদেরকে আমি আমার ছুরিটি দেখিয়ে দিলাম। আমার হাতের ভেতরে ছুরিটা রুপালী ইলিশের মতন তার চকচকে গ্রীবা নাড়াতেই সবাই ভোঁ ভোঁ করে দৌড় দিল। এরপর কোনোদিনই তারা আর আমার সাথে লাগতে আসেনি! আমি ক্যাডেট কলেজে চলে আসার বছরে নিতাই কামারও তার স্ত্রীকে নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল। আর কখনই ফিরে আসেনি। সেনাবাহিনিতে আসার পর আমি কামারের ভিটাকে ভুলেই গিয়েছিলাম।

মাত্র কিছুদিন আগে আমার পারিবারিক একটা প্রয়োজন মিটানোর জন্যে আমার কিছু অতিরিক্ত টাকার দরকার হয়ে পরল। ব্যাংকের ঋণ আমি সহ্য করতে পারিনা। ক্যাপ্টেন অবস্থায় ব্যাংকের ও ডি (ওভার ড্রাফট) শোধ করার জন্যে আমি একসময়ে আমার প্রিয় বাহন ‘এইচ-১০০ এস’ বিক্রি করে দিয়েছিলাম। আমার বাবার সম্পদেও এখন পর্যন্ত আমাদের বিক্রি করার অধিকার জন্মায়নি। কাজেই ১৯৯৪ সনে আমার টাকা দিয়ে আব্বা আমাকে যে একবিঘা জমি কিনে দিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের পাশে সেটাকেই বিক্রি করার জন্যে মনস্থির করলাম। এই ভুমিসম্পদ সম্পর্কে আমার এত বছর কোন আগ্রহই ছিলনা। এর দাগ-দুঃখ কোনটাই আমাকে কখনই স্পর্শ করেনি। কাজেই নামমাত্র মুল্যে আমার সিংগাপুর প্রবাসী নির্মাণ শ্রমিক আমার এক চাচাতো ভাই যখন জমিটা কিনে নিতে চাইলো তখন আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
মোবাইল ফোনে অনেক সমন্বয় করার পর গত সপ্তাহে আমি আমার বাড়ীতে গিয়েছিলাম জমিটা আমার সেই ভাইয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দিতে। রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই জমিটার সরকারী দামও এতো কম কেন?” সে আনন্দিতভাবে আমাকে জানালো এটা একটা পতিত জমি। আগে এখানে একটা বাঁশঝাড় ছিল এবং কয়েকটা গাছ ছিল। ফসল হয়না বলে এটাকে নিম্নভূমি এবং বাঁশঝাড় হিশেবে দেখানো হয়েছে সরকারী নথিপত্রে। তার ইচ্ছে এখানে সে ‘ফিশ ব্রিডিং’ এর জন্যে একটা পুকুর খনন করবে! তারপর সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “আপনি কামারের ভিটা চিনতেন না? এটা সেই কামারের ভিটা!”

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২৫ অক্টোবর ২০১৫

১,৪৪৬ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “বিনিময়”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :clap: :clap:

    আসাদ ভাই, আপনার কামার বাড়ির গল্পটি বেড়ে লাগলো। অপরের স্মৃতিচারণ পড়তে পড়তে তার অংশ হয়ে উঠতে পারা সহজসাধ্য কিছু নয়। লেখকের কৃতিত্ব সেখানে ষোল আনা বৈকি!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।