অন্য জীবন!

অন্য জীবন!

“Xavier didn’t merely live a single life that extended from birth to death like a long, filthy string; he didn’t live his life, he slept it; in this life-sleep he leaped from dream to dream; he dreamed, fell asleep while dreaming, and dreamed another dream, so that his sleep was like a box into which another box is fitted, and in that one still another box, and in this one another still, and so on.” – Life is elsewhere (Milan Kundera)

আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়ীতে নূর মোহাম্মদ নামে আমাদের ঝাড় কাটা স্কুলের ক্লাস নাইনের এক ছাত্র লজিং থাকতো। আমার আব্বা নাকি বালিজুরি স্কুলে পড়ার সময়ে তাদের বাড়ীতে লজিং থাকতেন। নূর মোহাম্মদের বাবা আমার আব্বাকে পড়াশুনার জন্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন, আব্বা এখন তার ছেলেকে লজিং রেখেছেন। অর্থাৎ এক ধরনের পারস্পারিক ঋণ পরিশোধ!

অত্যন্ত শান্ত শিষ্ট স্বভাবের সদ্য কৈশোর অতিক্রমকারী যুবক নূর মোহাম্মদ। পড়াশুনার বাইরে আমার আম্মার সকল ফাই-ফরমাশ খাটে, আমাদের দৈনন্দিন বাজার সদাই করে দেয় আর আমাকে রাতে অংক করায়। নূর মোহাম্মদ মানবিক বিভাগের ছাত্র। অংকে তার আদৌ কোন ইন্টারেস্ট নেই, যেমন ছিলনা আমারও কখনই! কাজেই আমার প্রতি তার যে দায়িত্ব তা শুধুই একটা ফরমাল দায়িত্ব; এই দায়িত্ব তাকে কখনই পালন করতে হয়না।আমি শুধু তার সাথে স্কুলে এবং বিকেলে খেলার মাঠে যাই। আমার বড় চাচার মেয়ে মরিয়ম নূর মোহাম্মদের সাথে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়াশুনা করে।তার চেহারা আদৌ এমন আহামরি নয় যে স্কুলের যুবকেরা তার পেছনে ঘুর ঘুর করবে! তবুও আমাদের যৌথ পরিবারের সদস্য হবার সুবাদে আমার বড় চাচী তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন হাইস্কুলে তার ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ের দিকে কেউ তির্যক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে কিনা তা খেয়াল করে তাকে জানাতে।নূর মোহাম্মদ এধরনের গোয়েন্দাগিরি ধরনের কাজ একদম পছন্দ করেনা। তবুও সে প্রতিনিয়ত চোখ ট্যাড়া যুবক বা কিশোরদেরকে সনাক্ত করে আমার চাচীর নিকট রিপোর্ট করে। ফলাফল যেটা হল কিছুদিন পর থেকেই ক্লাসের অন্যান্য যুবকেরা তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল এবং আমিই রইলাম তার একমাত্র সঙ্গী!

নুর মোহাম্মদ গ্রীষ্মকালের ছুটিতে আম-কাঁঠাল খেতে আমাদের বাড়ী থেকে মাত্র ৩ মাইল দূরে অবস্থিত নিজের বাড়ীতে বেড়াতে গেছে। আমাদের বাড়ীর কাচারিঘরের টেবিলের ড্রয়ারে একদিন আমি তার হাতের লেখা একটা ডায়রি খুঁজে পেলাম।নুর মোহাম্মদ যে ডায়রি লেখে তা আমরা কেউই জানতাম না। হয়ত বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে লিখে!ডায়রিটার ভেতরে দৈনন্দিন জীবনের কোন বর্ণনা নেই। আছে অদ্ভুত ধরনের সুন্দর হাতের লেখায় লেখা দুইটা গল্প। প্রথম গল্পটা জামালপুর থেকে মেলান্দহ বাজার পর্যন্ত ট্রেন ভ্রমন কাহিনী, যেখানে লেখা আছে এক ঝড় বাদলের রাতে ট্রেনটা যখন ‘ঝিনাই ব্রিজ’ অতিক্রম করছিল তখন সে কিভাবে ট্রেনের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে নদীতে পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতন নদী সাঁতরে পাড়ে উঠেছিলো! পরের গল্পটার ঘটনাস্থল আমাদের বাড়ী। আমাদের বাড়ীতে আগুন লেগেছে। মরিয়ম আটকা পরেছে দোতলার একটা ঘরে! আমাদের বাড়ীর তথা স্কুলের কোন যুবকেরই সাহস নেই দোতলা থেকে মরিয়মকে উদ্ধার করে আনে! নূর মোহাম্মদ সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা দড়ির সাহায্যে টারজানের মতন দোতলায় উঠে গেল এবং ধোঁয়ায় ঢাকা কক্ষের ভেতর থেকে মরিয়মকে কোলে নিয়ে বিনা আয়াসে দোতলা থেকে লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে আসলো। আমার বড় চাচীর হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত! মজার ব্যাপার হল আমাদের বাড়ীতে কোন দোতলা ঘরই নেই! আমি নুর মোহাম্মদের অন্তর্গত চিন্তা এবং স্বভাবের প্রকৃতি দেখে চমৎকৃত!

আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাবার পর নূর মোহাম্মদের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো ১৯৯৫ সনে। আমি সেনাবাহিনিতে মেজর। নূর মোহাম্মদ সেনাবাহিনিতে হাবিলদার হিসেবে চাকুরি করে। চাকুরিতে আমাদের কখনই দেখা হয়নি। ছুটিতে এসে আমার আব্বার সাথে দেখা করতে এসেছিল। আমাকে দেখে অনেকটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল। আমি তাকে নুর মহাম্মদ ভাই বলে ডাকতেই সে সহজ হয়ে গেল। সেনাবাহিনীর একটা গোয়েন্দা সংস্থায় চাকুরি করছে। আমি তাকে বললাম, “আপনাকে টিকটিকি বলে ডাকে না?” নূর মোহাম্মদ হেসে দিলো। আমি যে নূর মোহাম্মদের অতীত গোয়েন্দা কর্ম জানি সেটা সে জানে, কিন্তু আমি যে তার ডায়রি পড়েছি তা সে জানেনা!

নূর মোহাম্মদের কথা আমার মনে পরতনা। মনে পরে গেল চেক রিপাবলিকের বিখ্যাত লেখক মিলান কুন্দেরার উপন্যাস ‘লাইফ ইসএলস হয়ার’ নামের উপন্যাসটা পড়ার পর এবং আজ সকালে একটা পোস্টে মিলান কুন্দেরার বিষয়ে সুন্দর একটা লেখা দেখার পর। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ‘জেরমিল’ নামের এক উঠতি কবি যে মৃত্যুর মুখেও তার ব্যাক্তিগত সকল অসামর্থ্যকে ঢেকে রাখতে তার মনন জগতে ‘জেভিয়ার’ নামের নিজেরই এক ‘অলটার ইগো’ চরিত্র সৃষ্টি করে, যে চরিত্রের পক্ষে যে কোন অসাধ্য সাধনই সম্ভব!

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২৫ জুলাই ২০১৫

৩,১১৯ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “অন্য জীবন!”

মওন্তব্য করুন : ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।