সীমা

সীমা

‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মতো হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে’ – দাউদ হায়দার

মেয়েটার নাম সীমা। বয়স ১৯/২০ বছর। নামটা তার মায়ের দেয়া। কি কারনে মা তার নাম সীমা রেখেছিলেন কে জানে? ঐ নামেই সে সুইডেনের একটা বিদেশী পরিবারে বড় হচ্ছে সে। পরনে একটা নীল জিন্সের প্যান্ট, তার ওপরে একটা শার্ট, পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক। সাথে ইউরোপীয় এক বর্ষীয়সী দম্পতি এবং এক অনিন্দ্য সুন্দর ইউরোপীয় যুবক। যুবকটা মেয়েটার চেয়ে বড় না ছোট তা তার আকৃতি দেখে বোঝা মুশকিল। চার জনের পুরো দলের মধ্যে সীমার আকৃতিই সবচেয়ে খর্বাকৃতির। সে অন্য সবার কাঁধের নীচে পরে। তার মুখটার ভেতরে একটা অসহায়ত্ব অথবা নরম ভাব ভিড় করে আছে ! অনেকটা লাজুক বাঙ্গালী মেয়েদের মতন।

১৯৯২ সনের আগস্ট মাস। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন এবং কম্বোডিয়াতে সামরিক পর্যবেক্ষক হিশেবে কাজ করছি। ছুটিতে এসেছি দেশে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই আমি দেশ থেকে গিয়েছি এবং প্রথম ছুটিতেই নিজের দেশে ফিরে এসেছি।অদৃশ্য কোন মায়ার টানে। ঢাকায় আমাদের বাসা বা বাড়ি নেই। তাই ইউনিট অফিসার সাকলাইনের রুমে দুইদিন থাকার পর ছুটছি গ্রামের বাড়ি জামাল্পুরে।এয়ারপোর্ট স্টেশনে সম্ভবত ‘একতা’ ট্রেনের চেয়ার কোচে জানালার ধারে বসে আছি। একটু পরেই ময়মনসিং এর উদ্দেশ্যে ট্রেন ছাড়বে। আমার সামনে একটা ছোট টেবিল, যে কোন ট্রেনের চেয়ার কোচে যা থাকে। আমার সামনের চেয়ারে এসে বসলো সেই ইউরোপীয় দম্পত্তি যারা সাইজে ব্রিটিশদের চেয়েও বড়! আর আমার পাশে এসে বসেছে ছোট সাইজের মেয়েটি! যুবকটা বসেছে দূরের একটা চেয়ার কোচে।

ট্রেন ছাড়ার পর ইউরোপীয় মহিলাই আমার সাথে প্রথম সম্ভাষণ করলেন আমাকে ‘হ্যালো’ বলে। জাতিসঙ্ঘ মিশনে কয়েকমাস কাজ করার পর আমার ভেতরে বিদেশীদের নিয়ে জড়তা কেটে গেছে।কারন আমার টিমে আমি ছাড়া আর সকলেই বিদেশি – একজন মালয়েশিয়ান, একজন আইরিশ, একজন ব্রিটিশ, একজন ফ্রেঞ্চ এবং একজন চায়নিজ। কাজেই আলাপ জমতে সময় নিলনা। আমি জিজ্ঞেস করতেই মহিলা বললেন, “আমরা সুইডেন থেকে এসেছি। এটা আমাদের দত্তক মেয়ে সীমা। আর ওটা আমাদের ছেলে। আমরা গিয়েছিলাম কুমিল্লার নিকটবর্তী বরুয়ায় সীমার মায়ের খোঁজে। ১৯৭২ সালে আমরা সীমাকে দত্তক হিশেবে গ্রহন করে নিয়ে গিয়েছিলাম। এর পর বাংলাদেশে আর আসিনি। সীমা তার মাকে দেখতে চেয়েছে বলেই আসা”। আমি সীমার মায়ের খোঁজ পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে তারা জানালো যে, অনেক খুঁজেছে তারা, কিন্তু কেউই তার সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছেনা। সে কারনেই তারা এখন যাচ্ছে ময়মন সিংহ হয়ে ঈশ্বরগঞ্জের এক মিশনারিতে, যদি তারা তাদের হেল্প করতে পারে। তিনি তার পকেট থেকে সীমার পাসপোর্ট সাইজের একটা পুরনো ছবি বের করলেন। হয়তোবা দত্তক নেওয়ার সময়ে তোলা। বসতে শিখেছে এমন একটা শিশুর ছবি! কৃমির কারনে পেটটা ফুলে আছে আমাদের দেশের যে কোন গরীব শিশুর মতন। কপালের একপাশে বড় কাজলের টিপ।বললেন, “ইজ নট শি কিউট?” আমি বললাম, “খুব সুন্দর!”

আমি সীমার সাথে কথা বলি।বাংলাদেশে সে এর আগে আসেনি। তবে বাংলাদেশ তার খুব ভাল লেগেছে। ল্যাঙ্গুয়েজ, মিউজিক এবং আরও কি কি সাবজেক্টে নরওয়েতে পড়াশুনা করে। আমার কাছে একটা বাংলা গানের সি ডি ছিল। আমি তাকে দিতেই সে তার সি ডি প্লেয়ারে ঢুকিয়ে ইয়ার ফোন দিয়ে কিছুক্ষন শুনল। তারপর আমকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল যে ল্যাঙ্গুয়েজটা সে বুঝেনি, তবে সুরটা খুব মেলোডিয়াস ! আমি তাকে সিডিটা দিয়ে দিতে চাইলে সে ভীষণ খুশি হল এবং তার ব্যাকপ্যাক খুলে আমাকে চিনামাটির তৈরি একটা ছোট্ট জুতা আমাকে গিফট করল। জানালা দিয়ে কিছুক্ষন বাইরে তাকিয়ে থাকার পর তার দত্তক বাবা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “ তোমাদের দেশটা এত সুন্দর যে, আমার মনে হচ্ছে আমি আমার চশমার ওপরে আর একজোড়া চশমা লাগিয়েছি !” আমিও জানালা দিয়ে বাইরের দ্রুত অপসৃয়মান দৃশ্যাবলির দিকে দৃষ্টি ফেলতেই দেখলাম যে, আমাদের দেশটা আসলেই খুব সুন্দর। অথচ এই দেশের জন্ম প্রক্রিয়াটা কি রক্তাক্তই না ছিল! আমার পাশে বসা এই মেয়েটা এই রক্তাক্ত জন্ম প্রক্রিয়ারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যাকে জন্মের পর পরই, কিছু বুঝতে শেখার আগেই মাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে অন্য দেশে চলে যেতে হয়েছে আমাদেরকে শুদ্ধতা দেবার জন্যে ! অথচ সেই শুদ্ধতা কি আমরা অর্জন করতে বা ধরে রাখতে পেরেছি? আমার মনে পরে গেলো যুদ্ধের পর আমাদের গ্রামের বারি কাকা এক শহুরে মহিলাকে বিয়ে করে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ডাকে। সেই মহিলাও একদিন সবার অলক্ষ্যে চলে গিয়েছিলেন আমাদের এলাকা থেকে এবং আর কোনদিনই ফিরে আসেননি !

সীমা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চারপাশের দৃশ্যাবলী তাকে খুব একটা আনন্দ দিচ্ছে বলে আমার মনে হলনা। একজন শিকড় বিহীন মানবী বা বৃক্ষ কতক্ষণই বা হাওয়ায় দুলবে? সামনেই ময়মন সিংহ স্টেশন ! এখানেই নেমে যাবে ওরা ।

( স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর অবশেষে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের হাতে নির্যাতিত ৪১ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গতকাল সোমবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে । পর্যায়ক্রমে আরও স্বীকৃতি দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪১ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। পর্যায়ক্রমে আরও বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হবে। গেজেট অনুসারে বীরাঙ্গনাদের মধ্যে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন ময়মনসিংহের ফতেহপুর গ্রামের ময়মনা খাতুন। আমার অনেক আগের এই লেখাটা ‘৭১ এর সকল ‘যুদ্ধ শিশু’দের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলাম। আজ আবার উৎসর্গ করলাম তাদের বীর মায়েদের উদ্দেশ্যে)

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৩ অক্টোবর ২০১৫

১,২৯৩ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “সীমা”

  1. মুজিব (১৯৮৬-৯২)

    অসংখ্য ধন্যবাদ আসাদ ভাই।
    এরকম লেখা আরো চাই।
    ::salute::


    গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।