মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া

মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া

ক্যাডেট কলেজে ক্লাস ইলেভেনে উঠেছি। সেনাবাহিনীর ধাঁচে ‘ইন্টার হাউজ ডেমন্সট্রেশন প্রতিযোগিতা’ অথবা এই ধরনের নামের একটা কো-কারিকুলাম প্রতিযোগিতা সুচিত হয়েছে সে বছরেই। এই প্রতিযোগিতার ব্যাকষ্টেজের জন্যে প্রেসিডেন্ট রোনালড রিগ্যান এবং আরও কয়েকজন বিখ্যাত ব্যাক্তিদের এনলারজড পোট্রেট আঁকতে হবে। আমাদের ধর্ম শিক্ষক সাদিক স্যার আমাদের হাউজ মাস্টার। তিনি আমাকে তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে ছবিগুলো আঁকতে বললেন। আমরা ছবি নকল করতে ওস্তাদ। আমার মনে আছে ‘ইন্টার হাউজ আর্ট কম্পিটিশন’ হচ্ছে। বিখ্যাত কার্টুন শিল্পী রফিকুন নবীকে বিচারক হিশেবে আনা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দি হাউজের কমনরুমের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নান্দনিক সব শিল্পকর্ম- সবই ক্যাডেটদের হস্তে আঁকা। একটা অনিন্দ্য সুন্দর আঁকা স্কেচের সামনে গিয়ে তিনি থমকে দাঁড়ালেন! তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, “এই ছেলেতো দেখি আমার চেয়েও সুন্দর এঁকেছে!” উল্লেখ্য, আঁকা ছবিটা ছিল তারই আঁকা কোন স্কেচের নকল! আমি নকল ছবি আঁকা পছন্দ করিনা। আমি মৃদুভাবে সাদিক স্যারকে বললাম, “ স্যার, ইসলামে তো মানুষ অথবা জীব জন্তুর ছবি আঁকা হারাম। এই ছবি আঁকলে আমার যে পাপ হবে, সেই পাপের বোঝা যদি আপনি গ্রহন করেন, তাহলে আমি ছবিগুলো আঁকতে পারি!” সাদিক স্যার অবাক। বললেন, “তোমার পাপের দায়িত্বভার আমি নিতে যাব কেন? আমি আগেই বুঝেছিলাম তুমি ভেতরে ভেতরে একটা মিনচে শয়তান; যাও তোমাকে ছবি আঁকতে হবেনা!” আমি মুক্ত। কিন্তু একটা বিষয় জীবনে প্রথমবারের মত বুঝলাম, সেটা হল সব জায়গাতে সত্য বলা উচিত নয়!

সেনাবাহিনিতে কমিশন পাবার পর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিশেবে আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ৫ সিগন্যাল ব্যাটালিয়নে। ইউনিটের ভেতরে আমার পোস্টিং দেখানো হয়েছে কাপ্তাই এর ব্রিগেড সিগন্যাল কোম্পানিতে। কিন্তু আমাকে সেখানে যেতে দেয়া হয়না, চট্টগ্রাম সেনানিবাসেই আমি ফাই-ফরমাশ খেঁটে মরি। অবশেষে একদিন সেই শুভদিন এলো। আমাকে বলা হল দুই দিনের জন্যে কাপ্তাইতে গিয়ে একটা ‘কোর্ট অফ ইঙ্কুয়ারি’র মেম্বার হিশেবে কাজ করতে। মশিয়ুর স্যার কাপ্তাই ব্রিগেড সিগন্যাল কোম্পানির অধিনায়ক। তিনি আমার জন্যে এয়ার কন্ডিশন লাগানো পর্যটন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। অপরিচিত জায়গা। এমনিতেই গা ছম ছম করে। আমি তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ফুল স্পীডে এসি লাগিয়ে কম্বলের তলায় শুয়ে পরলাম। আমার বিছানার পাশেই আর একটা বেড, খালি কিন্তু সুন্দর করে চাদর,বালিশ লাগানো। রাত বারোটা। ঘুমে আমি সম্পূর্ণ অচেতন। এমন সময়ে একজন আমার রুমে ঢুকে শব্দ করে আমাকে জাগিয়ে তুললেন। বয়স ৩৫ এর মতন হবে। মাথার চুলগুলো সামরিক অফিসারদের মতন ছোট করে ছাঁটা নয়। আমাকে জাগিয়েই অবিরাম প্রশ্নমালার মাধ্যমে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন, “ আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? কোন ইউনিটের? অধিনায়কের নাম কি? আমার দেশের বাড়ী কোথায়? আমার বাবা কি করেন? আমরা ক’ভাই- বোন? তারা কি করেন?” – এধরনের হাজারো প্রশ্ন! আমিও গল গল করে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি। এ পর্যায়ে তিনি আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, “এখন বল, আমি কে?” আমার সরল স্বীকারোক্তি “আমি জানিনা”। তিনি বললেন, “আমার সম্পর্কে তুমি কিছুই জাননা, অথচ নিজের সম্পর্কে তুমি সব তথ্য দিয়ে দিলে কেন? বলেই তিনি আমাকে ‘বোকা’ হিশেবে এসটাব্লিশ করতে উঠে পরে লেগে গেলেন এবং আমাকে ‘তথ্য নিরাপত্তা’ সম্পর্কে হাজারো উপদেশ দিতে লাগলেন। ভদ্রলোক খুব ফুরফুরে মেজাজে আছেন। আমার মনে হল তিনি সারারাত ধরে আমার ওপরে টোটাল ডমিনেশন নিয়ে আলাপচারিতায় মগ্ন থাকেবেন। তিনি শেষবার যখন আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন যে তার পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে তার নিকট আমার নিজের সম্পর্কে এতো তথ্য দেয়া উচিত হয়েছে কিনা, তখন আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম কারন কাল সকালে ৭ টার ভেতরে মশিয়ুর স্যারের অফিসে উপস্থিত হতে হবে। আমি তাকে বললাম, “আমি আমার সম্পর্কে যে তথ্যগুলো দিয়েছি, সেগুলো যে সত্য তা আপনি নিশ্চিত কি করে হলেন? আসলে আমি সেনাবাহিনির কোন অফিসার না! আমি মেজর মশিয়ুরের ভাগ্নে। তিনিই আমাকে বলে দিয়েছেন যে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে আমি যেন বলি যে আমি সেনাবাহিনির সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট! “আসলে আমি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। মামার কাছে বেড়াতে এসেছি!” – এই টুকু বলে থামতেই আমি খেয়াল করলাম পাশের বিছানাটি নিশ্চুপ হয়ে গেছে এবং কম্বল মুড়ি দিয়ে তিনি শুয়ে পরেছেন!

অনেক বছর পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম তিনি ছিলেন ‘স্কুল অফ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স’ এর একজন সামরিক প্রশিক্ষক অফিসার যিনি ‘ইন্টারোগেশন’ নামক একটা গোয়েন্দা অনুশীলনে ছাত্র অফিসারদের নিয়ে কাপ্তাইতে গিয়েছিলেন!

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৬ জুন ২০১৫

১,৬৪২ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া”

  1. ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

    এই কম্পিটিশনটার নামই পরে "কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে" (সংক্ষেপে সিএডি) হয়েছিল বোধহয়।
    আমাদের আঁকতে হয়েছিল ওসামা বিন লাদেন আর বুশ জুনিয়রের ছবি, সঙ্গে গাদাখানেক মানচিত্র।



     

    এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

    জবাব দিন
  2. মুজিব (১৯৮৬-৯২)

    :)) :)) :))

    খুবই কৌতুহল হচ্ছে, সেই ইন্টারোগেটর ভদ্রলোক ক্লাস টুয়েলভের ক্যাডেট আসাদের নামে ১২টা ইডি রেকমেন্ড করে এমসিসির প্রিন্সিপ্যালকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন কি না?


    গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জিহাদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।