বইচুরি

বইচুরি

প্রত্যেকেরই শৈশব, কৈশোর বা নিদেনপক্ষে যৌবনে চুরির হিস্ট্রি থাকে বলে আমার ধারনা! বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের কিশোরী দুর্গার বিরুদ্ধে একবার প্রতিবেশিরা পুঁতির মালা চুরির অভিযোগ আনে এবং দুর্গা যথারীতি সেই অভিযোগকে অস্বীকার করে বসে। দুর্গা মারা জাবার পর কাশী যাওয়ার আগে গোছগাছ করার মুহূর্তে অপু দুর্গার একান্ত সংগ্রহের ঝাঁপিতে চুরি করা গলার মালাটিকে আবিষ্কার করে এবং দুর্গার লজ্জাকে ঢাকার জন্যে অপু মালাটিকে ছুড়ে ফেলে পুকুরের পানায় – “ মালার আঘাতে পানা সরে যায় বৃত্তাকারে, আবার বুজে যায়—বিস্মৃতির অতলে ডুবে যায় দুর্গা”।

অত্যন্ত মুসুল্লি ধরনের পরিবারে জন্ম এবং অতি ধার্মিক পরিসরে কঠিন অনুশাসনে বড় হবার পরেও আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ সংক্রান্ত অন্তত হিস্ট্রির অধিকারী আমি!

‘পথের পাঁচালী’ , ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, জুল্ভার্নের ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ’, চার্লস ডিকেন্সের ‘গ্রেট এক্সপেকটেশনস’, তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ এবং হারম্যান মেল্ভিলের ‘মবি ডিক’ সবগুলো উপন্যাসই আমি পড়েছি প্রথমে সিনেমা দেখার পরে।

সময়কাল ১৯৮৩। আমাদের ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার প্রবল প্রস্তুতি চলছে। এর পরেও ‘স্যাটারডে নাইট মুভি’র কোনটাই মিস করিনা আমি, সাহেল আর ডিউক! আমাদের ভেতরে ডিয়ুক ইংরেজি মুভির শব্দমালার সবকিছুই বোঝে, তারপর সাহেল এবং তারপর আমি। ক্যাডেট কলেজের বাইরে ডিউক ঢাকার ছেলে, সাহেল কিশোরগঞ্জের এবং আমি জামালপুরের মাদারগঞ্জের! বোঝার পার্থক্যের কারন সম্ভবত এটাই! গত ছয় বছরের একত্রে বসবাসও আমাদের জন্মস্থানের পার্থক্যকে ঘুচিয়ে দিতে পারেনি। কাজেই পরীক্ষার আগেরদিন রাতে যখন আমরা তিনজন হারম্যান মেল্ভিলের ‘মবি ডিক’ সিনেমাটা দেখতে বসলাম, তখন গ্রেগরিপেকের অসাধারন উচ্চারনের অনেককিছুই আমার বোঝার বাইরে থেকে গেল! তাই ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার শেষ দিনেই আমি কলেজ লাইব্রেরীতে চলে গেলাম এবং খুঁজে খুঁজে বইটা বের করলাম। ১৮৫১ সনে প্রকাশিত এই বইটি শতাব্দী পুরনো। শেষের দিকে অনেকগুলো পাতাই ছেড়া আর বিবর্ণ। কিন্তু তারপরেও বইয়ের প্রথম বাক্য “কল মি ইসমায়েল” আমাকে সম্মোহনীর মতন আকর্ষণ করে বসলো। আমার কাছে মনে হল উপন্যাসের শুরু হিশেবে পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাক্য এইটি! আমার ভেত্ররে জেদ চেপে বসল যে বইটা আমাকে পড়তেই হবে।কিন্তু মাত্র কয়েকদিন পরেই প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষে সবাই চিরদিনের মতন ক্যাডেট কলেজ ছেড়ে চলে যাব। কাজেই একমাত্র উপায় বইটা চুরি করা। অতএব শেষ পর্যন্ত আমার শৈশব এবং কৈশোরের সমস্ত পবিত্রতা বিসর্জন দিয়ে আমি বইটা চুরি করলাম!

হাউজে ফিরে যাবার পর রাতে সাহেল আর ডিউককে বইটা দেখালাম। দুজনেই আমার পারফর্মেন্সে মনে মনে খুশি। কিন্তু দুজনেই বইটা আমার আগে পড়বে বলে দাবী করে বসলো, নতুবা আমার চুরির কথা সবাইকে জানিয়ে দেবে! অগত্যা সিদ্ধান্ত হল ডিউক কলেজ থেকে যাবার আগেই বইটা পড়ে শেষ করবে, কারন সেই সবচেয়ে দ্রুত পড়তে পারে! তারপর বইটা নিয়ে বাড়ীতে যাবো আমি। তিনমাস কালের মধ্যে বইটা পড়ে শেষ করার পর সাহেলের কাছে পাঠাবো আমি!

সাহেলকে আমি বইটা পড়তে দিয়েছিলাম কিনা তা আমার খেয়াল নেই। তবে বইটা আমার কাছে অনেক বছর ছিল। ‘সিটোলজি’ নামে একটা চ্যাপ্টার আছে এই বইতে (যেখানে বিভিন্ন ধরনের তিমি মাছের ভ্রুন এবং প্রকার নিয়ে বিজ্ঞান তথা ধর্মের বইতে যে সকল বর্ণনা দেয়া আছে সেগুলোর উল্লেখ আছে) সেই পর্যন্ত পড়েই ক্লান্ত হয়ে গেছি। অবশেষে আমি ১৯৯৩ সনে বইটা হারিয়ে ফেলি। সম্পূর্ণ পুরুষালী ধাঁচের রমণী হীন এই উপন্যাসটি মেল্ভিলের জীবদ্দশাতেও তার জন্যে হয়রানীর কারন হয়েছিলো। পাঠকরা রমণীর ভালবাসা হীন এই উপন্যাসকে মুল্য দেয়নি এবং মেল্ভিল্কে উপন্যাস লেখা থেকে কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করতে হয়েছিলো যে কবিতাগুলোরও পাঠক পাওয়া যায়নি। অথচ মেল্ভিল নিজেও জানতেন তার লেখাগুলোর ভেতরে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখা এটাই! শুধুমাত্র গত শতাব্দীর শেষের দিকেই স্বীকৃত হয় যে ‘মবি ডিক’ শুধুমাত্র হারম্যান মেল্ভিলের নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি! এটা রোমান্টিসিজম এবং আমেরিকান রেনেসাঁর প্রতীক! উপন্যাসটি মূলত মবি ডিক দ্বারা আক্রান্ত জাহাজের ইসমায়েল নামের এক নাবিকের সমুদ্র ভ্রমনের কাহিনি যেখানে তার জাহাজের ক্যাপ্টেন আহাব এক প্রকাণ্ডদেহী এক সাদা তিমির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেশায় আক্রান্ত হয়ে নিজের ও জাহাজের অন্যান্যদের জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় আর তিমিটা যেখানে ভাবে যে নাবিকদের বহনকারী জাহাজটাই তার শত্রু !

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৩ জুলাই ২০১৫

১,৫১৯ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “বইচুরি”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    আমার চুরি করা বইটির নাম মধুসূদন নাট্য গ্রন্থাবলী। সেই চুরিতে পড়ার ইচ্ছের চেয়ে বাহাদুরির আনন্দ বেশি ছিলো।
    তোমার চমতকার লেখা পড়ে আবার মনে পড়ে গেলো


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    ইউজিন ওনিলের "মোর্নিং বিকামস ইলেক্ট্রা", আর্থার মিলারের "ডেথ অব আ সেলস ম্যান" সহ মোট চারটি আধুনিক আমেরিকান নাটক সম্বলিত বিশাল মোটা এক অনুবাদ গ্রন্থ পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি ক্লাস টেনে।
    লাইব্রেরিয়ান কে বললাম, বই হারিয়ে গেছে।
    উনি রেকর্ড ঘেটে বললেন, বই-এর দাম সোয়া ছয় টাকা।
    জরিমানাসহ সাড়ে বারোটা কাটা হবে বই না দিতে পারলে।
    আমিতো মহা খুশিতে রাজি।
    বহু কশরত করে বইটা বের করি কলেজ থেকে।
    কিছুদিন আগেও বইটা মায়ের সেলফে ছিল।
    আম্মা জানতে চাইলেন, ওটা আর লাগবে কিনা?
    বললাম, লাগবে না।
    উনি অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় বইগুলোর সাথে ওটাও তার কলেজে দিয়ে এলেন।
    সোয়া ছয় টাকা দামের বইটা ঝিনাইদহ থেকে যাত্রা শুরু করে শেষ পর্যন্ত ঢাকার এক কলেজে এসে থিতু হলো...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    আমি জামালপুরের মাদারগঞ্জের!

    :tuski: :awesome:

    ভাইয়া, আমিও তবে খানিকটা উজানে।

    (আমার এই এলাকাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার জন্য আমিই দায়ী 😛 )


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    আহা কতো বই! কতো স্মৃতি!
    উসকে উঠলো মনের বারান্দায় এই লেখাটা পড়ে।
    কতো বইকে ঘিরে কতো রকমের স্মৃতি।
    কারো আমূল্য সংগ্রহের বই এখনো আছে শেলফে, ফেরত দেবার মানসে। আবার কারো কাছে থেকে যাওয়া বা কারো রেখে দেয়া বইয়ের স্মৃতি। আবার আছে কিছু বই, কাকে যে দিলাম, কে যে নিলো তা বেমালুম স্মৃতিকোষ থেকে লোপাট। কতো স্মৃতি নাড়া পরলো নিউওরণের ভাঁজ চাপা দেরাজ থেকে।
    লেখাটার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই।

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "অতএব শেষ পর্যন্ত আমার শৈশব এবং কৈশোরের সমস্ত পবিত্রতা বিসর্জন দিয়ে আমি বইটা চুরি করলাম" - এখন কলেজের লাইব্রেরীতে কিছু একই মানের বই দান করে ঘটনাত্তোর প্রায়শ্চিত্ত করে ফেলো জলদি জলদি।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।