অলৌকিক ভালবাসা!

অলৌকিক ভালবাসা!

‘‘ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়
আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে
সেই নারী এসে আমার হৃদয়ে তোলপাড় করে যায়’’- কবি মজিদ মাহমুদ

ঝাড় কাটা হাইস্কুল নামক একটা কো-এডুকেশন স্কুলে আমি দুই বছর পড়াশুনা করেছি। ক্লাস সিক্স এবং সেভেন। তারপর ক্যাডেট কলেজ। আমাদের ক্লাসরুমটার ছাদ আর দেয়াল ছিল এসবেসট এর সিমেন্টএর তৈরি। পায়ের নিচে শক্ত এঁটেল মাটীর মেঝে। ক্লাসে মেয়েদের জন্যে একটা লম্বা সরু টেবিলওয়ালা বেঞ্চ ছিল যেখানে ছাত্রীরা স্যারের পিছন পিছন এসে বসতো। ক্লাস শেষ হলেই আবার শূর শূর করে স্যারের পিছনে লম্বা লাইন দিয়ে স্টাফ রুমে চলে যেতো, যেখানটাই ছিল তাদের আসল বসতি। কাজেই ক্লাসের ছাত্রদের সাথে ভাব বিনিময় অথবা কথোপকথনের সময় ছিল শুধুমাত্র এই যাওয়া আসার সময়টুকুতে। মোট ৫ জন ছাত্রীর ভেতরে নার্গিসকে আমরা ডাকতাম ‘দারোগা’ বলে তার ব্যাক্তিত্তের কারনে। সে মূলত দশম শ্রেণির ছাত্রীই হবার কথা, কিন্তু বারংবার ফেল করে আদু ভাইয়ের মতন সে ক্লাস সিক্সেই রয়ে গিয়েছিল! স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে বারংবার ফেল করার কারনে স্কুল থেকে বের করে দেবার চিন্তা করলেও মানবিক কারনে তাকে বের করে দিতে পারেনি। কারন তার বাবা-মা নেই। ভাই-ভাবির আশ্রয়ে থাকে।স্কুল থেকে বের করে দিলে তার ছাত্রী নাম ঘুচে যাবার কারনে তার কোনদিন বিয়েই হবেনা।

বর্ষার এক অশ্রান্ত শ্রাবণের দিন! ভাঙা এসবেসট এর ছাদ থেকে চুয়ে চুয়ে বৃষ্টির ফোঁটা বেঞ্চের ওপরে রাখা রাফখাতার কাগজের পৃষ্ঠায় আঁকা ফাউনটেন পেনের কালিকে অতিরঞ্জন করে গোলাপফুলটাকে ত্রিমাতৃক রুপ দিয়েছে। ভূগোলের ক্লাস। আমাদের টিচারের নাম খয়ের স্যার। তিনি গেছেন বর্ষার পানিতে ভেঙে যাওয়া তার ক্ষেতের আল ঠিক করতে। সকালে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ভেতরে তিনি যদি অনুগ্রহ করে ফিরেন, তবেই আমাদের ক্লাস অলীক ভালবাসার কাকলীতে মুখরিত হতে পারে, কিন্তু তিনি আসবেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “স্যার, পৃথিবীর আকৃতি কি ধরনের?” স্যার সচ্ছন্দভাবে উত্তর দিয়েছেন, “পিরথিবির আকৃতি পিরথিবির মতন!” খয়ের স্যার র-ফলা উচ্চারন করতে পারেননা। অন্যান্য শব্দ উচ্চারনেও তার প্রচুর সমস্যা আছে!কয়েকদিন আগে আমরা হেডস্যারের কাছে তার উচ্চারন এবং ক্লাসে অনিয়মিত আসা যাওয়ার বিষয়ে কমপ্লেইন করেছিলাম। তিনি নিরুত্তর ছিলেন। কারন খয়ের স্যার স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান সাবেত চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই!

খয়ের স্যারের ক্লাস সময়ের মাঝামাঝিতে শ্মশ্রুমণ্ডিত এন পূর্ণযুবক আমাদের ক্লাসে উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে যেয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করলাম। নিশ্চয়ই আমাদের কমপ্লেইনে কাজ হয়েছে! আমাদের নতুন ভূগোল টিচার এসেছেন। এর মাঝেই ইউসুফ যেয়ে স্টাফরুম থেকে মেয়েদেরকে ডেকে এনেছে ক্লাসে নতুন টিচার এসেছে জানিয়ে। নতুন স্যার আমাদেরকে দাঁড়াতে দেখে স্তম্ভিত! নিজেকে ইনট্রডিউস করলেন তিনি। নাম নজরুল ইসলাম। নদীর ওপারে মাহমুদ পুরে বাড়ী।ছোটবেলায় হাফেজি মাদ্রাসায় পড়েছেন। কোরআনে হাফিজ হবার পর একটা মাদ্রাসাতে টিচার হিশেবেও ছিলেন কয়েকবছর। বর্তমানে তার ইচ্ছে হয়েছে স্কুলে পড়ার! এটাও জানালেন যে, আমরা যদি তাকে সহজভাবে নেই এবং সহায়তা করি তাহলেই তার স্কুলে পড়া সম্ভব।আমরা সবাই উল্লসিতভাবে তাকে গ্রহন করলাম। ওপরের ক্লাসের ভাইদের সাথে ডিল করার জন্যে আমাদের এধরনেরই একজন অভিভাবক ক্লাসমেট দরকার ছিল! মেয়েরাও খুব খুশি! বিশেষভাবে খুশি হতে দেখলাম নার্গিসকে!সে অকারনে খিল খিল করে হাসছে!

নজরুল আমাদের ক্লাসমেট হয়ে গেলো! দুখু মিয়ার মতন আমাদের কোন দুঃখই রইলনা! আমাদের বাড়ীতে মিয়ারুদ্দিন চাচার ঘরে তিনি লজিং থাকে। মিয়ারুদ্দিন কাকা ক্লাস টেনে পড়েন। বয়স অনুযায়ী তার সাথেই নজরুলের বন্ধুত্ব হবার কথা, কিন্তু অজানা কোন কারনে আমার সাথেই তার সখ্যতা বেশী!প্রবল ধার্মিক ধরনের ছেলে নজরুল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মসজিদে। প্রতিদিন সকালে এক ঘণ্টা সময় তার মুখস্ত কোরআনের পারাগুলো ঝালিয়ে নেয়। রমজানের শেষ দশদিনে আমি তার সাথে ‘এহতেকাফে’ও বসেছিলাম এবং যুগ্মভাবে আমাদের মহানবীকে প্রায় স্বপ্নে দেখে ফেলেছিলাম!

নজরুল আসার কয়েকমাস পরেই আমি আর ইউসুফ নজরুলকে বিষয়টা বলেছিলাম। বলেছিলাম যে, নার্গিস তাকে পছন্দ করে। লজ্জায় তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছিলো। আমার আর ইউসুফের মধ্যস্ততাতেই শেষ পর্যন্ত নজরুল আর নার্গিসের বিয়ে হয়েছিল ক্লাস সিক্স এর ফাইনাল পরীক্ষার পর। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নার্গিস ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস সেভেনে উঠেছিল সেবার! এর পর থেকে নার্গিস আর কখনই পরীক্ষায় ফেল করেনি!আমি স্কুল থেকে ক্যাডেট কলেজে চলে যাবার সময়ে নজরুলই সবচেয়ে খুশী হয়েছিল এবং সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করেছিল।

ছুটিতে গেলে নজরুলের সাথে এখনো আমার দেখা হয়। নার্গিস আর নজরুল দুজনেই খুব সুখে আছে। দুইজনেরই প্রবল অলৌকিক ভালবাসা পররস্পরের প্রতি! নজরুল স্থানীয় স্কুলে বি এস সি টিচার হিসেবে চাকুরি করে। তার মেয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে ঢাকায় একটি এনজিওতে চাকুরি করে!শুধু বয়স হয়ে গেছে দুজনেরই! এই যা পার্থক্য!

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১১ আগস্ট ২০১৫

১,৭৬৪ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “অলৌকিক ভালবাসা!”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    স্যার সচ্ছন্দভাবে উত্তর দিয়েছেন, “পিরথিবির আকৃতি পিরথিবির মতন

    আসাদ, তুমি ছাড়া এই সব আর কেউ পারেনা


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আসাদ ভাই,
    গল্পটা খুব ভালো লেগেছে। আরও ভালো লেগেছে গল্পের পটভূমি। ঝাড়কাটা আর মাহমুদপুর দুটোই আমার চেনা। আমার এক চাচার বাড়ি কাজলা গ্রামে। 🙂 (সম্পাদিত)


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    দারুণ লাগল।
    বিশেষ করে হ্যাপি এন্ডিংটা...
    বাস্তব জীবনেও সিনেমার মতন হ্যাপি এন্ডিং হতেই পারে... 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "বিশেষভাবে খুশি হতে দেখলাম নার্গিসকে!সে অকারনে খিল খিল করে হাসছে" - তোমাদের কাছে অকারণে মনে হলেও তার তো নিশ্চয়ই কারণ ছিল, যা বোঝা গেল গল্পের শেষে এসে।
    "শুধু বয়স হয়ে গেছে দুজনেরই! এই যা পার্থক্য!" - চমৎকার! মধুরনেণ সমাপয়েৎ!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইদুল (৭৬-৮২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।