চুয়াল্লিশ বছর পরও

বছর দুয়েক আগের কথা । স্বাত্তিক স্কুল থেকে মুখ কালো করে বাসায় ফিরল। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলল, “পাপা, মালাউন মানে কি? এটা কি একটা খারাপ কথা?” মনের কোনায় ছিয়াত্তর বা সাতাত্তর সালের একটা ঘটনা মনে আসলো, অনেকটা ওয়ার্নিং বেলের মত। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মা’কে একই প্রশ্ন করলাম। কিন্তু শব্দটা ছিল ভিন্ন।

মা সেই শব্দটা না জানার ভান করে ব্যপারটা চেপে গেলেন। ছোট বয়সেও ব্যাপারটা চোখ এড়ায় নাই, কারণ বাবা বাসায় ফেরার পর তাদের আলাপে এই শব্দটা কানে আসলো। ঐ সপ্তাহেই মা একবার ক্লাস টিচারের সাথে কথা বললেন। তাদের এই পুরো ব্যপারটার ইম্প্যাক্ট হোল, ক্লাস টিচার পরে আমাকে ডেকে বললেন, স্কুলে আমাকে কেউ কিছু বললে সরাসরি উনাকে জানাতে তারপর মা বাবাকে বলতে। মিশনারি স্কুল ছিল দ্বিতীয় বার শুনতে হয় নাই ঐ শব্দ।

যে পাড়ায় বড় হচ্ছিলাম সেখানে সবাই বেশ উচ্চ শিক্ষিত সরকারী কর্মকর্তা। এমনি একদিন বাসার দরজার পাশে অতি বড় অক্ষরে আবার সেই শব্দ লেখা দেখে বাবা, মা চমকে গেলেও আমার বিশেষ কোন অনুভূতি হয়নি … বাসায় ফিসফাস হোল, লেখাটা মুছে দেয়া হোল কিন্তু দিন দুয়েকের ভিতর আবার সেটা দেয়ালে ফিরে এল। এবার মানে জানতে আমি সচেষ্ট। বড়দের আচরনে বুঝতে পারছিলাম ঐ শব্দটা অপমানজনক। শব্দটা আবারও মুছে দেয়া গেল। পাড়ার মুরুব্বি গোছের হস্তক্ষেপে সেটা আর দেয়ালে ফিরল না …  শুধু একটা অনুভূতি মাথার ভিতর থেকে গেল অপমানের … একটা দুই অক্ষরের শব্দ যার অর্থ পরিষ্কার না আমার কাছে, অনুভূতিতে অপমানবোধ তৈরী করতে পারে, উচ্চারন মাত্র। কিন্তু এটা একটা ওজনদার অপমান বুঝে নিলাম। শব্দটা ছিল “ডেডা”।

আজকে ছাব্বিশ মার্চ এই কথাটা কেন মনে হোল। ভারতের সাথে ক্রিকেট ম্যাচ চলছে … সবাই টেন্সড। ফেবুতে কলেজের এক বড় ভাইয়ের  এই স্ট্যাটাসে “মালাউন এর দল”  কথাটা পেয়ে  আশ্চর্য … তাতে বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল বন্ধুর লাইক দেখে আমি আরও চমৎকৃত। বলতেই পারে ভারত বলে কথা, তার উপর যা করল ওরা বাংলাদেশের সাথে ম্যাচে  … আমি কেন ঝোল নিজের গায়ে টেনে নেব ?  আমার ছেলেটার কথা মনে হোল, ওর কাছে ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ওকে কেউ কেন মালাউন বলবে। যখনি কোথাও কেউ কাউকে মালাউন বলবে সেটা কি ওর গায়ে লাগবে? কিংবা ডেডা বলবে তখন কি আমার গায়ে ?

ডেডা, মালাউন, মালু ইত্যাদি শব্দগুলি এই মধ্য রাতেও তাড়া করে ফিরছে। আমি খুবই দুঃখিত, অনুভূতি শেয়ার করলাম। কাউকে লজ্জিত বা আঘাত করার জন্য লেখা না।

২,০৫৭ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “চুয়াল্লিশ বছর পরও”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    সেই কবিতা শুনেন নাই,
    "মালাউনকা বাচ্চা কাই নেহি আচ্ছা,
    যো ভি আচ্ছা, ও ভি শুয়ারকা বাচ্চা।"

    অবশেষে আমরা সবাই (???) মৌলবাদী।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)

    আমরা দুঃখিত ও লজ্জিত ভাই।
    লেখাপড়া শিখেছি, কিভাবে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে হয় তাও শিখেছি;

    কিন্তু মানুষ হতে হয় কিভাবে, তা শিখিনি আজও। 🙁


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  3. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙁 🙁 🙁 🙁

    ফেইসবুকের গোবর সমৃদ্ধ কতিপয় বন্ধুদের থেকে এর থেকে বেশী কিছু অবশ্য আশাও করিনা, দাদা! আমাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাপটা মাঝেমাঝেই হিসহিসিয়ে ওঠে ফেবুর পাতায় জানি। ময়মনসিংহে ঈদে, পূজোয় খুব আনন্দ করেছি বন্ধুরা এক সাথে, জানো! কিন্তু এরই মাঝে কেউ কি বলেনি যে, হিন্দু হিন্দু তুলসী পাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা??? বলেছে বহুবার। যে বলেছে সে কিন্তু ছোট একটা মানুষ, না বুঝেই বলেছে আমি জানি। বড় একজন কিন্তু এসে তাকে শুধরে দেয়নি সেটাও দেখেছি ওই ছোটবেলাতেই!

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      তখন করেছেন, আমিও গিয়েছি।
      কিন্তু আমি যদি মুসলমান হতাম তবে আমার সন্তানদের হিন্দু দের পুজায় যেতে দিতাম না।
      পুজার খাবার কার উদ্দেশ্যে বলেন? পুজা কার উদ্দেশ্যে?
      তাহলে তাতে কি মুসলমান অংশ নিতে পারে?

      নবী মক্কা জয়ের পর কি প্যাগানদের তাদের ধর্ম পালন করতে দিয়েছিলেন!!!


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
      • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

        কে হিন্দু কে মুসলমান কখনো ভাবিনিতো! মানুষের গায়ে যে ধর্মের লেবাস থাকে সেটা তো জেনেছি অনেক পরে!

        ময়মনসিংহে আমাদের বাড়ির নিচতলায় তিনটে হিন্দু পরিবার থাকতো। পূজো এলে মাসিমারা লুচি, নারকোল নাড়ু, বেগুন ভাজা পাঠাতেন আমাদের জন্য। ভোরে অই বাড়ির দিদিমা তুলসি তলায় জল ঢালতেন দেখতে পেতাম ওপরতলার গ্রিলে মুখ রেখে। সন্ধ্যাবেলা উলুধ্বনি শুনে বুঝতে পারতাম পড়তে বসার সময় হলো বলে! আমার বাবা আমাদের নিয়ে পূজোর মন্ডপে গেছেন বহুবার। কিশোর কুমারের গান বাজতো মাইকে। শহর জুড়ে উৎসব শুরু হতো।

        পূজোর খাবার কার জন্য এই ভাবনা আসেনি মনে কখনোই। বরং পূজো এলে তিলের নাড়ু আর লুচির সাথে আমরা যে মাসিমার হাতের লাবড়া খেতে পারবো সেটিই আমাদের আনন্দের কারণ ছিল। জীবন কে সহজ করে দেখি আমি। এখানে আমার বাড়িতে ক্রিসমাস এলে তারা সব বন্ধুদের মতো নিজের ক্রিসমাস ট্রি সাজায় অনেক উৎসাহে। এক একটা অরনামেন্টস লাগাতে লাগাতে তারা কত কথাই না বলে! দিওয়ালীতে আমি মন্দিরে গিয়ে আলোকসজ্জা দেখি আমার সাদা বন্ধুদের সাথে। অথবা ঈদ এলে মুর্গীর রোস্ট আর গরুর কাবাবের সাথে টেবিলে দু'চারজন হিন্দু অথবা ক্রিশ্চান বন্ধুকে খেতে বলি। এটাই সেলেব্রেশন অব লাইফ!

        জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    যদিও “ডেডা” কথাটা আগে কখনো শুনিনি, বুঝতে অসুবিধে হয়না যে কথাটা অপমানজনক।
    অরূপ, তোমার লেখাটা পড়ে তোমার আর স্বাত্তিক এর কাছে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে এবং বেশ লজ্জিত বোধ করছি।

    জবাব দিন
    • অরূপ (৮১-৮৭)

      এই লেখাটা লিখতে লিখতে আমি ভাবছিলাম, অনেক মানুষকে, অনেক ভালো মানুষকে আমি কি লজ্জায় ফেলে দেবো। সত্যি বলছি, আমি কাউকে লজ্জা দেবার জন্য লিখিনি। অসম্ভব মন খারাপ নিয়ে লিখেছি। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে আগের মানসিকতার পরিবর্তন হবে আশা করেই আগাচ্ছি আমরা। মাঝে মাঝে হতবাক হয়ে দেখি আমাদের এই পথ আসলে কোন দিকে যাচ্ছে। আমাদের বাসার সামনে ঐ লেখা আর ফিরে আসেনি বা আমার স্কুলেও আমাকে আর শুনতে হয়নি তার কারণ কেউ না কেউ সামাজিক এই ভুলটাকে শুধরে দিয়েছিলেন।
      এই ভুলগুলি শোধরানোই সবচেয়ে জরুরী।


      নিজে কানা পথ চেনে না
      পরকে ডাকে বার বার

      জবাব দিন
  5. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    "কাউকে লজ্জিত বা আঘাত করার জন্য লেখা না"
    কিন্তু তাও আমি লজ্জিত, আহত।
    এই মুহুর্তে কিছু করতে পারছি না তবে ভবিষ্যতে আমার ফ্রেন্ড লিস্টের কাউকে এই রকম কিছু লিখতে দেখলে তাকে সেটা জানিয়ে তারপরে তাকে ব্লক করে দেবো।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  6. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    অরূপ দা',
    প্রথমে শিরোনাম নিয়ে - চৌচল্লিশ না হয়ে চুয়াল্লিশ হবে আমার মতে।

    একটা জিনিস উপলব্ধি করছিলাম গেল কয়েক বছরে। অনুভূতিটাকে/ অপমানটাকে শেয়ার করা উচিত। ছোটবেলায় করিনি -- এমন না যে ভয়ে করিনি (ভয় ব্যাপারটা বোঝার বয়স হয়নি বইলেই বোধ হয়) -- করিনি কাছের মানুষগুলো লজ্জা পাবে বলেই। আমার কাছে মনে হয় -- সুস্থচিন্তার মানুষেরাই সংখ্যালঘু, বিবেকবান মানুষেরা সংখ্যালঘু। অপমান গায়ে মাখতে কে চায়, তবু যেন লেগে যায় --- ধর্মের, লিঙ্গের, জাতিসত্তার, অর্থের, বিদ্যার -- কিসের দিক দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত অন্যকে অপমান করছিনা? সবার না কি সমান হবার কথা ছিল! সে কথা কি একটা মহা ভুল বা ডাহা মিথ্যা ছিল?

    জবাব দিন
  7. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আমি দুঃখিত এবং লজ্জিত দাদা কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আশেপাশের এত এত তথাকথিত 'শিক্ষিত' ও'সমাজ সচেতন' মানুষদের মাঝে এখনো এ ধরনের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনা দেখি যে মাঝে মাঝে রীতিমত ভয় পেয়ে যাই। নূপুরদার মত আমারো মনে হয় সুস্থচিন্তার মানুষেরাই সংখ্যালঘু, বিবেকবান মানুষেরা সংখ্যালঘু।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাবিনা (৮৩-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।