তোমার জন্য কখনো কখনো

পাঠচক্রে তোমার বাবার সঙ্গে জাতীয় বিপ্লবের স্তর নির্ধারনী তর্কটা ছিল দুর্বোধ্য । আরো দুর্বোধ্য ছিল গ্লাসনস্ট আর পেরস্ত্রইকা নিয়ে সেই বিখ্যাত আলাপ……… কিন্তু তখন সবচাইতে দুর্বোধ্য ছিল তোমার চোখ। জল টলটলে অতল…

অথচ কমরেড মেননের উপসংহারের মতই স্বচ্ছ ছিল তোমার হাসি। একটা স্বস্তি নিয়ে বাসায় ফিরে যেতাম। অপেক্ষায় থাকতে থাকা আরো একটা সকালের, সকাল গড়িয়ে দুপুর পেরিয়ে বিকালের … তোমার বারান্দায় বসে আবারও লেনিন আর মাও অথবা চে। কেউ না এসে পৌঁছালে নিরোচ্চে একটু সুনীল …

একসাথে ভলগার পাড়ে তুষার ঢাকা জ্যোৎস্নায় হাত ধরে হাটার স্বপ্ন……

কখনো কখনো ছিয়াশির নির্বাচন আর এরশাদের পতনের রূপরেখা … কত ঝড় কত আলোচনা, সশস্ত্র বিপ্লব না গণতন্ত্র আর নির্বাচন… জাতীয় বিপ্লবের এই স্তরে সর্বহারা পার্টির হঠকারীতা আর আমাদের বিশাল বিপ্লবের সেই স্বপ্ন … সবার জন্য ভাত কাপড় …

এখুনি বেরিয়ে পড়ার তাগিদ ছিল নিজের ভেতর … ঘর ছেড়ে প্রলেতারিয়েতদের সাথে। কি ভীষণ ছেলেমানুষির দিন ছিল …

কি জানো, তোমার বাবার কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষণে ভুল হয়নি, যেমন হয়নি তোমার আমাকে চিনতে।

বলেছিলেন ৯১ এর আগে এরশাদ সরে যাবেন। উনি আমাদের জাতীয় বিপ্লবের প্রাক শর্ত বলেছিলেন তিনটা। আমাদের জাতীয় পাপ মোচনের তিন শর্ত আর এক ভবিষৎবাণী । শেখ সাহেব হত্যার বিচার হতে হবে, রাজাকারদের বিচার হতে হবে আর ধর্ম নিরপেক্ষতা সংবিধানে ফিরে আসতে হবে আর সব অন্যায়ের হাত ধরে উঠে আসবে মৌলবাদ … পোড় খাওয়া কর্মী, ভুল বলেননি।

তুমিও ভুল বলনি, তোমার গালে আমার হাত চেপে ধরে বললে, তোমার এই গাছাড়া পাস কাটানো স্বভাব বদলাবে না। তোমাদের বিপ্লব হবে না, আর তুমি সংসারীও হবে না … আমাদের সুনীল, সুবোধ এক হলেও স্বপ্ন আলাদা … তখন সবচাইতে দুর্বোধ্য ছিল তোমার চোখ। তখনও  তোমার ঠোঁট ছুয়ে দেখেছি, তোমার হাসি ছিল স্বচ্ছ ।

রাশিয়া ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হবার সাথে টুকরো হয়ে গেল আমাদের পাঠচক্র।  তোমার বাবার চোখের সেই অসহায় বিষণ্ণতা আমাকে আমাকে এখনো তাড়া করে …. কালো একটা মোটা ফ্রেমের চশমার পেছনে উনার বিষণ্ণ চোখ।

রাশিয়া ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হবার সাথে আরো ভাঙল আমাদের সুনীল সুবোধ আর ভলগার পাড়।উপসংহারের স্বচ্ছ তোমার হাসিটা ছিল বিদায়ের। তোমার চোখ জল টলটলে অতল।

১,৩৪৯ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “তোমার জন্য কখনো কখনো”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    কালকে দৌড়ের উপর ছিলাম।
    তাই কমেন্ট করা হয় নি।
    লেখা অসম্ভব ভালো হয়েছে।
    আপনার সিসিবির পথচলা আনন্দময় হোক।
    আমরাও আনন্দ পেতে থাকি।
    এইবার দেখেন নাবিল ভাই কে আনা যায় কিনা/// (সম্পাদিত)


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    যেকোন কিছু নারী ছাড়া হয় না।
    বিপ্লব ও হয় না।
    পাঠচক্র ও হয় না।

    হয়তো নারী অনুপ্রেরণা দায়িনী, শক্তির আঁধার।

    আইরন কার্টেন ফল করায় সারা পৃথিবী র মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
    শক্তির ভারসাম্য একটি জটিল বিষয়। দুইটি বিশ্বযুদ্ধ বাদ দিলে দেখেন আমরা সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছি ৯০ এর পর থেকে।

    অবশ্য দায়ভারটা কেবল রাশার নয় যে।তারা হেনতেনপ্রকারেণ সমাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখবেন।
    সেই লাল বিপ্লবের সময় সমাজতন্ত্র ছিলো সময়ের দাবি।
    ৮০ র দশকে তাই কিন্তু আউটডেটেড।

    কিন্তু সবার ঘুম ভাঙলে বাঙলার কমুনিষ্টদের ঘুম ভাঙেনি, আর মনে হয় না ভাঙবে এই জীবনে।

    পুতিন কে ভালো লাগে এই কারণে যে পাওয়ারটা ব্যালেন্স করার কাজটা করে যাচ্ছেন এই স্মার্ট লোকটি।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • অরূপ (৮১-৮৭)

      রাজীব, ৯০ পরবর্তী সময় কতটা ভয়াবহ ছিল সেটা এখন বোঝা যায় না।প্রজন্মের একটা বিশাল অংশ পুরাপুরি দিকশুন্য হয়ে গেল। কি পরিমান হতাশা ছিল ঐ সময়ে সেটা কোথাও বলা হয় না ( দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া ) ... অথবা আমার চোখে পড়ে নাই হয়তো


      নিজে কানা পথ চেনে না
      পরকে ডাকে বার বার

      জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    এই রকম প্রেমের লেখায় কঠিন কথা চলে।আসলো দাদা। সরি।
    প্রেম সবসময় হারিয়েই যায়।

    আরেকটি ইম্পরট্যান্ট কথা আছে আপনার লেখায় এরশাদ ৯১ এর আগে সরে যাবে।
    দেখা যাক আবার, তিনি বলেন নাই আমরা নামিয়ে ফেলবো।
    বলেছেন সরে যাবেন।
    এরশাদবিরোধী আন্দোলন যারা করেছেন তাদের ছোট করতে চাইছি না।
    কিন্তু আসলেই এরশাদ সরে গেছেন।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • অরূপ (৮১-৮৭)

      প্রেম হারায় কিনা সেটা নিয়ে একটা আলোচনা হতে পারে ... 😀 😀
      আর হ্যাঁ এখন প্রায়ই মনে হয় এরশাদ সরেই গেছিলেন ... যদিও তখন রাস্তায় থেকে তা মনে হয় নাই আমাদের কারো ...


      নিজে কানা পথ চেনে না
      পরকে ডাকে বার বার

      জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    অসাধারন হয়েছে অরূপদা। :boss:

    ব্লগে স্বাগতম। 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    অসাধারণ লেখা! অনেকেই যেমনটি বলেছেন, কবিতার মত...
    ৯০ এর পরের গণতান্ত্রিক শাসনামলে বাংলাদেশের বামপন্থীদের দেউলিয়াপনা প্রকটভাবে নাঙ্গা হয়ে পড়েছে। মানুষ তাদের আজ পরগাছা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনা।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : অরূপ (৮১-৮৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।