“অবশ অনুভূতির চিঠি”

জানালার বাইরে ছিল অতি সাধারণ সবকিছু। একটি সবুজ ধানক্ষেত, আমের বাগান কনক্রিট রোড, ধুপি শপ, রেশন স্টোর, পানির ট্যাংক। প্রথম দিন যেমন নতুনত্ব ছিল সেদিনটাও কোন পার্থক্য ছিল না অনুভবের। জানালায় একবার দাড়িয়ে শেষবারের মত দেখলাম আমার ছবির ফ্রেমটা। জীর্ণ অথবা রংয়ের যত্নে লুকিয়ে থাকা রডগুলো ছুঁয়ে মনে হল ক্ষুদ্র অথচ প্রাণের কিছু অংশ রেখে যাচ্ছি। গতকাল রাত থেকে আমার অনুভুতিগুলো অনেকটা্ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এরপরও খুব খারাপ লাগছিল। এক একটা জায়গায় যাচ্ছিলাম এক একটা ঘটনার কথা মনে হচ্ছিল। গভীর রাতে হাউসের বেলকুনিতে বসে এফ এম রেডিও শোনা, গার্ডদের বোকা বানানোর জন্য ঘুমন্ত হাউস ডিউটি ক্যাডেটের কাছ থেকে বাঁশি নিয়ে…….. জোরে জোরে বাজানো। এরপর দোতলা খেকে মজা দেখা গার্ডদের উদ্ভ্রান্ত ছোটাছুটি!! বাঁশিটা কে বাজালো?

“আজ চলে যাচ্ছি। ক্ষুদ্র ৬টি বছর পার করে”।

Barclays প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল দেখার জন্য প্রেপ থেকে ছুটে আসা, লাইটস্‌ অফ এর পর কালো কম্বল দিয়ে জানালা ঢেকে আলো জ্বালানোর মজা, চুপচাপ বাথরুমে গেলে পরিচিত কোন ক্যাডেটের অপরিচিত সুরেলা কন্ঠের বাথরূম সিংগিং!!

গেমস্‌ এ দৌড় এর মাধ্যমে লন টেনিস ব্যাট ধরা, ছুটির দিনগুলোতে অপশনাল গেমস্‌ এ স্বতস্ফুর্ত দুরন্ত ক্যাডেট। পিটি কম্পিটিশনে যোগ দিতে বলার পরেও অমান্য করে ৭টা ইডি!!! তখন ১টা ইডি বিশাল কিছু……..

কেউ একজন চকোলেট আর কার্ড পাঠালেও তা এ্যাডজুটেন্ট অফিসে আটকে যাবার গল্প। কেউ একজন কে তা স্টাফের কাছ থেকে বের করার জন্য কত সাধনা।
প্রতিদিন ডাইনিং টেবিলে সবাইকে নিয়ে মজা করার দিনগুলো। স্পেশাল ডিনারের পুডিং আজও কোথাও খুঁজে পাইনি। কেন জানি সেই স্বাদটা আসে না।
বিরক্তিকর ডে-প্রেপ এর ঘুম অথবা গেমস্‌ এর টিম প্ল্যান। ডিনারের পর সেকেন্ড প্রেপ এ পড়াশোনা ছাড়া অন্য সবকিছু করার গল্প।
আমার কলেজ ছেড়ে চলে যাওয়া প্রথম ২.৫বছরের টেবিলমেট (মুশফিক-২১৪৪) এর সাথে ক্লাস সেভেনে রিস্ক নিয়ে স্যুপ পাস করা, টেবিলের নিচ দিয়ে পা-যুদ্ধ। অন্ধকারে চট্‌ করে চামুচ এর বদলে হাত দিয়ে একটু চেখে দেখা………. (খিচুরি খেয়ে যে একবার কি ধরাটাই খেয়েছিলাম)
একটা কিসসু হবে না চরিত্র থেকে কেমন করে যেন অনেক কিছু শিখে ফেলা। তারপর আবিস্কার করা আমি কিছুই পারতাম না!
গাছে ওঠার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্বেও রাতে ডাব পাড়তে গিয়ে প্রথম রাতে কুকুরের তাড়া, দ্বিতীয় দিনে ডাব পড়ে ফেটে যাওয়া ও ৩য় দিনে মেগা সাফল্য………
রাত বিরাতে ফোয়ারায় গোসল করার মজা পেতে গিয়ে কোদাল দিয়ে প্যাঁচ খুলতে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলা । পরদিন এমন একটা ভাব- আরে ফোয়ারার চাবিটা ভাঙল কে!!
এবং শেষ ইংলিশ ডিনারে মোবাইল চার্জ দিতে গিয়ে ইংলিশ ডিনারে ঢুকতে না পারার অভিজ্ঞতা, সবাই এটা দেখে মজা পেলেও ডিউটি অফিসারের কল্যানে পরবর্তীতে গণ হারে বুফে ইংলিশ ডিনার করলাম আমি আর দিপঙ্কর।

হাউস চ্যাম্পিয়ন করার জন্য বাচ্চা-বুড়ো সকলের সম্মিলিত অভিযান।
হঠাৎ মনে না আসা আরও কত কী!
“আরে কাঁদার কি আছে। যত্তসব! হাসি-খুশি মনে চলে যাব। আবার আসব মাঝে মাঝে।” জীবনের অংশ এটা, ব্যাপার না, কত কিছু বলেছিলাম সবাইকে। বোঝাতে চেয়েছিলাম নিজেকে….
অতঃপর পরদিন সকালে আবারো বুঝতে পারা আসলে বিদায় জিনিসটা কি। দুঃসহ যাতনা। কলেজ থেকে বাসটা বের হওয়া মাত্রই একটা নিজস্বতা হারানোর শূণ্যতা।

আজ ৪টি বছর পর ধুলোপড়া স্মৃতির ডায়েরী থেকে সেই ক্যাডেট হিসেবে শেষ দিন, ২০০৯ এর ৩১মের লেখাগুলোকে মুক্ত করে দিতে ইচ্ছে হল। বন্ধুদের সবার নাম উল্লেখ করলাম না । ৪০তম ব্যাচ এর সবাই এই গল্পের নায়ক। সবার অংশগ্রহনে আমাদের ক্যাডেট নামক মেগা সিরিয়ালের পূর্ণতা। আমরা ২০০৩ ইনটেক এর প্রথম ব্যাচ হিসেবে কলেজ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম ১জুন। এরপর সবাই জুন এর প্রথম সপ্তাহে। গল্পটি শুধু আমার না। সবার গল্প । সব ক্যাডেটদের গল্পের ছকটা হয়তো এমনই। শুধু স্থান কাল পাত্র বিশেষে পরিবর্তিত।
একটা কঠিন বাস্তবতা, একটা অপ্রিয় সত্য, জেনেও বুঝতে না চাওয়া একটা বাস্তবতা হল আমরা বলি বা মনে করি আমরা আলাদা হয়ে গেলেও একই আছি কাছাকাছি আছি। আমরা একটাই স্বত্ত্বা। আসলে আমরা একসাথে নেই থাকতে পারি না। আমরা সবাই নিজের কাজে পরিবারের কাজে এতটাই ব্যস্ত যে সময় আমাদের বুঝতে দেয় না আমাদের সীমাবদ্ধতা। সবশেষে একটাই কথা ….. সব মিথ্যা…… তোমরা যারা এখনও পড়ছ ক্যাডেট কলেজে, মনে রেখ এভাবে এত কাছে আর কখনোই পাবে না বন্ধুদের।

জানি অনেকেই এটা স্বীকার করতে চান না। কিন্তু আপনার মন ঠিকই জানে আপনি যা অস্বীকার করছেন তা সত্য। একদিন আপনি বুঝবেনই। আজ অথবা সময় নিয়ে। তবুও বারবার ফিরে আসে নতুন দিন। পুরোনো দিনের স্মৃতিকাতরতার চাদরে ঢেকে দেয় আমাদের। আমরা একসাথে থাকতে না পারলেও কাছে থাকার আকুলতা যেন শেষ হয় না।
“I always knew looking back on the tears would make me laugh, but I never knew looking back on the laughs would make me cry.”


“Saying goodbye, going away

Seems like goodbye’s such a hard thing to say
Touching a hand, wondering why
It’s time for saying goodbye

Saying goodbye, why is it sad?
Makes us remember the good times we’ve had
Much more to say, foolish to try
It’s time for saying goodbye

Dont want to leave, but we both know
Sometimes it’s better to go
Somehow I know we’ll meet again
Not sure quite where, and I dont know just when
You’re in my heart, so until then
Wanna smile, wanna cry
It’s time for saying goodbye”

১,৪৯১ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : ““অবশ অনুভূতির চিঠি””

  1. হারুন (৮৫-৯১)

    "জানালায় একবার দাড়িয়ে শেষবারের মত দেখলাম আমার ছবির ফ্রেমটা। জীর্ণ অথবা রংয়ের যত্নে লুকিয়ে থাকা রডগুলো ছুঁয়ে মনে হল ক্ষুদ্র অথচ প্রাণের কিছু অংশ রেখে যাচ্ছি" - স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম, খুব সুন্দর লেখা।


    শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা..

    জবাব দিন
  2. 731

    এমন লেখা পড়লে বড় কষ্ট হয়। মনে পড়ে যায় হাজারো ফেলে আসা স্মৃতি...... বুকের ভেতর অনেক বড় শুন্যতা অনেক হাহাকার মুহূর্তে শেকড় শুদ্ধ ডালপালা নাড়া দিয়ে যায়, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই সময়টায় ...... আরও অনেক কিছু। বলে বঝান যায়না......

    চমৎকার লেখা।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হারুন (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।