রেজা, ইকবাল ও আমি

ইকবাল ও রেজা। নাম দুইটা সবসময় একি ব্র্যাকেটে চলে আসে। তার সাথে আসে ১১ই নভেম্বর। প্রতি বছর যখন এই দিনটা আসে আমি রাতে আকাশের তারা দেখি। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু উত্তর খুজি।

রেজা, ইকবাল আর আমি একি ফরমে ছিলাম। আমাদের প্রথম টেস্টে রেজা হল ৪র্থ আর ইকবাল হল ৯ম। আমার অবস্থা বরাবরের মতই খারাপ।

ফরম মাষ্টার আমার সীট বসাল ইকবালের সামনে। যাতে আমার কিছু হেদায়াত হয়। একদম ঠান্ডা একটা ছেলে ছিল। একদম চুপচাপ। আমিও একটু একি ধরনের ছিলাম সেই সময়। তাই প্রথম প্রথম কথা হত না তেমন। একদিন প্রেপের সময় ঘুমাচ্ছিলাম। প্রেপ মনিটর নিশ্চই ভাল কোন ভাই ছিল। ইকবাল আমাকে ডেকে তুলে বলেছিল সময় এইভাবে নষ্ট করা ঠিক না। সেই থেকে যত প্রেপে ঘুমানর চেষ্টা করসি আমার সেই শান্ত উপদেশটা কানে বেজেছে। ধীরে ধীরে বন্ধুতের গভীরতা বারছিল। মাঝে মাঝে ও প্রেপের সময় খুব মন খারাপ করে থাকতো। বিশেষ করে কোনদিন পানিশমেণ্ট পেলে। আমি আর আমাদের সৌরভ ওকে হাসানোর চেষ্টা করতাম। ও হাসত। কিন্তু কিছুখন পরে আবার কেন জ়ানি ওর সেই সৌম্যতা ওর মাঝে চলে আসত।

রেজ়া ছিল এর হালকা বিপরীত। হাসিখুশি, চঞ্চল। খেলাধূলায়, পড়াশুনায়, আট’ সবকিছুতেই অসাধারন। এমন একটা ছেলে মনে হয় সব বাবা মার মনের চাওয়া হয়ে থাকে। আমার খুব বাজ়ে একটা অভ্যাস ছিল। হাস্যকর খারাপ অভ্যাস। সবাই হাসত। কিন্তু রেজাকে কখনই হাসতে দেখি নাই। ও আমাকে এসে বুঝাত।

দেখতে দেখতে ২য় সেমিস্টারটা শেষ হয়ে গেল। ছুটি থেকে আমরা ফিরতাম ট্রেনে করে। ইকবালের মুখে এক অসাধারন হাসি দেখা গেল। কিভাবে যেন আমাদের শাহজালাল হাইজের সীট আর তিতুমীর হাউজের সীট একসাথে পড়ে গেল। রেজা আমাদের সাথে ছিল স্রীমংগল পয’ন্ত। ইকবাল মনে হয় আশুগঞ্জ পয’ন্ত। খুবই হৈ চৈ হল পুরো রাস্তা।

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। তাই আমাদের একসাথের সময়টা কিভাবে যেন কেটে গেল। আমরা আমাদের এস্কারশনে গেলাম শ্রীমংগলে। চা বাগানে। প্রথম এস্কারশন তাই অন্যরকম উত্তেজনা। পুরো রাস্তা চিৎকার।চা কারখানা ঘুরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল বাংলাদেশ চা গবেষনা কেন্দ্রে। রেজার বাবা ওখানকার সায়েন্টিস্ট। সাভাবিক ভাবেই রেজার বাবা, মা আর ছোট ভাই এল। রেজা ভিপি স্যারের পারমিশন নিয়ে বাড়ি গেল কিছুখনের জন্য। আমার যতদূর মনে আছে রেজার বাবা আমাদের সবাইকে কোক কিনে দিছিলেন। বাসে আমি আর ইকবাল কাছাকাছি বসেছিলাম।

দেখতে দেখতে প্যারেন্টস ডে চলে এল। পারিবারিক সম্পক’তার কারণে ভিপি স্যারের সাথে দেখা করার সময় আমার বাবা মার সাথে রেজার বাবা মার দেখা হয়। আমার মনে আছে ভিপি স্যার বলে ছিল রেজার ভাল রেজাল্টেকে আমার ফলো করা উচিত। প্যারেন্টস ডের পরে রেজা খুবই খুশী ছিল। বলত পুরো সেমিস্টার শেষ হবার আগেই আমার তো বাবা মার সাথে ২বার দেখা হয়ে গেল। কে জানত নিয়তি সেই সময়ই ঠিক করে রেখেছিল যে সেই দেখাই ছিল তার শেষ দেখা।

আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা চলে এল। ও আর একটা ঘটনা শুরু হয়েছিল। সিলেটের কুয়াশা ভরা সকালে আমাদের সবাইকে বিশাল এক রোলার টানা লাগত। এর মাঝে আমাদের বাষি’কীর জন্য লেখা দিতে বলা হল। ইকবাল অসাধারন একটা সায়েন্স ফিকশন লিখেছিল। আমাকে পড়তে দিয়েছিলো। তখন বুঝতে পারি নাই। এখন লেখাটার কথা মনে পরলে বুঝি এক গভীর হাহাকার ছিল লেখাটার ভিতর।

১১ই নভেম্বর চলে এল। ঐ দিন ইংলিশ ২য় পরীক্ষা। স্টাফরা ঘোষনা দিল তাড়াতাড়ি রোলার নিয়ে চক্কর দিতে পারলে আগে ব্রেক আপ হয়ে যাবে। আমরা আমাদের গিয়ার উপরে উঠিয়ে দিসিলাম। পিছন ছিল স্টাফরা গাছের কঞ্চি নিয়ে। ইকবালকে সবাই জানত মকড়া হিসেবে। ও সব সময়ই সামনের দিকে থাকত। সেইদিন কেন যেন ও পিছনে গেল রোলারের সামনে। তারপর যা হয়েছিল তা আমি ৫ গজ দূরে থেকে দেখেছি। জ়ীবনের কাছে কেন যেন সেই কয়েকটা সেকেণ্ড এখনো থেমে থাকে।

সেই রাতে আমার বাবা আমাকে নিতে আসল। সবসময়ই আমি homesick থাকতাম। সবসময়ই চাইতাম কলেজ থেকে কবে ছুটি পাব। সেইদিন ছুটি পেলাম কিন্ত সেই ছুটিটা না পেলেয় মনে হয় ভাল হত। সেইদিন বাস করে ঢাকায় ফেরার সময়ই পুরো রাস্তা চোখের কোনা দিয়ে পানি পরেছিল। আমি তারার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। খুজছিলাম কিছু উত্তর।

আমি এই মূহুতে’ও তারার দিকে তাকিয়ে আছি। খুজছি উত্তর।বহু দূরে জাপানে। আমার প্রশ্নগুলো হয়ত সেই ১৩ বছরের বালকের থেকে ভিন্ন। দুইটা প্রাণের মুল্য কি এতই তুচ্ছ? যে আজো সেই দূঘ’টনার ক্কোন সঠিক উত্তর আমরা পেলাম না! কেনো সেই তদন্ত আজ়ো বাক্স বন্দি? সেই ঘটনার যেরে অনেক সিনিওর ভাই কলেজ থেকে আউট হয়েছে। তাদের জন্য আসলেই দায়ী কে? আমাদের সমাজ কি এতটাই ভগ্ন? আসলে আমরা প্রত্যেকেই জানি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর। যেটা আমরা জানি না সেটা হল কিভাবে এই প্রশ্নের উত্তরগুলো বের করতে হবে তার পথ।

সেইদিন বাসে ফেরার সময় নিজের অজান্তেই নিজের কাছে একটা প্রতীজ্ঞা করেছিলাম। নিজের ভিতর সারা জ়ীবন রেজা ইকবালকে বাচিয়ে রাখব। আমার সাথে মনে হয় আমার ব্যাচের অনেকেই একই প্রতীজ্ঞা করেছিল। সেই প্রতীজ্ঞা থেকেই জন্ম হয়েছে RIMO (Reza Iqbal Memorial Organization)র। রেজা ও ইকবাল এই দুইটা প্রাণের চেতনাকে বাচিয়ে রাখাই এর উদ্দেশ্য। আমরা আমাদের ব্যাচের সকলের সাহায্যে সিলেট ক্যাডেট কলেজের ৩য় ও ৪র্থ’ শ্রেণীর কম’চারীদের বাচ্চাদের একটা বাষী’ক বৃত্তির ব্যবস্থা করি। আমরা এখন প্রায় সকলেই ছাত্র। আমাদের ইচ্ছা সময়ের সাথে এর ব্যাপ্তি আরও বাড়ানোর।

ইসলাম ধম’ অনুসারে মৃত্যুর পর দুনিয়া থেকে মাত্র ৩টা উপায়ে মানুষ পূণ্য পায়। তার একটি হল পরিবারের মাধ্যমে। আমাদের কাছে রেজা ও ইকবাল ভাই। আর ক্যাডেটরা বিশাল এক পরিবার। আমি ধমে’র তাত্তিক গবেষনায় যেতে চাই না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। যাতে আমরা RIMO কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। হয়ত সবার উপদেশ ও সাহায্যের মাধ্যমে রেজা ও ইকবাল সবসময়ই বেচে থাকবে একি ব্র্যাকেটে সবার বুকের মাঝে। আল্লাহ তাদের আত্নাকে বেহেশতের চিরসুখ দিন।

আপনাদের যে কোন মন্তব্য বা উপদেশ আমাদের জানাবেন।

Numb – Linkin Park

১,৭৬৫ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “রেজা, ইকবাল ও আমি”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    RIMO এর সর্বাঙ্গীন মঙ্গল এবং সাফল্য কামনা করছি।
    রেজা, ইকবাল এর জন্য দোয়া করছি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে।
    সাথে সাথে ওদের পরিবার এবং এই চমৎকার বন্ধুদের জন্যেও শুভকামনা।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    ভাবছি,
    ক্লাস সেভেনে থাকতেই দুজন সতীর্থকে এইরকম হৃদয়ভাঙ্গা বিদায় যারা দিতে বাধ্য হয়েছে তারা পরবর্তী পাঁচটা বছর কিভাবে কাটিয়েছে ঐ একই চত্বরের ভিতর?


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  3. হাসনাইন (৯৯-০৫)
    ইসলাম ধম’ অনুসারে মৃত্যুর পর দুনিয়া থেকে মাত্র ৩টা উপায়ে মানুষ পূণ্য পায়। তার একটি হল পরিবারের মাধ্যমে। আমাদের কাছে রেজা ও ইকবাল ভাই। আর ক্যাডেটরা বিশাল এক পরিবার। আমি ধমে’র তাত্তিক গবেষনায় যেতে চাই না। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। যাতে আমরা RIMO কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। হয়ত সবার উপদেশ ও সাহায্যের মাধ্যমে রেজা ও ইকবাল সবসময়ই বেচে থাকবে একি ব্র্যাকেটে সবার বুকের মাঝে। আল্লাহ তাদের আত্নাকে বেহেশতের চিরসুখ দিন।

    মনের কথাগুলোই বললিরে। :boss:

    জবাব দিন
  4. তৌফিক (৯৬-০২)

    তোমাদের রিমো প্রচেষ্টায় সব পূণ্য যেন ওরা পায়।

    ক্যাডেট কলেজের বন্ধু হারানো খুব কষ্টের, তবু তোমাদের কষ্টটুকু মনে হয় না পুরোপুরি কখনো বুঝতে পারব। নিজের চোখের সামনে, তাও আবার দুইজন তরতাজা ছেলে !

    আল্লাহ ওদের ভালো রাখুন এবং দায়ী লোকদের যেন বিচার করেন।

    জবাব দিন
  5. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল 🙁 🙁 🙁
    আল্লাহ দোষীদের বিচার করুক।


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  6. রবিন (৯৪-০০/ককক)
    ক্লাস সেভেনে থাকতেই দুজন সতীর্থকে এইরকম হৃদয়ভাঙ্গা বিদায় যারা দিতে বাধ্য হয়েছে তারা পরবর্তী পাঁচটা বছর কিভাবে কাটিয়েছে ঐ একই চত্বরের ভিতর?

    আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তৌফিক (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।